রাশিয়ার চিঠি – দেবাশিস দত্ত

প্রেক্ষাপট : ‘রাশিয়ার চিঠি’ রবীন্দ্রনাথের অন্যতম আলোচিত অবলোকন। জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে উপনীত রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবোত্তর একটি দেশে সমাজ গঠনের নতুন কর্মকাণ্ড দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই মুগ্ধতা, পর্যবেক্ষণ ধরা আছে তাঁর চিঠির ছত্রে ছত্রে। সেই অন্তর্ভেদী পর্যবেক্ষণে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের প্রতি বিস্ময়ের পাশাপাশি এক সাবধানবাণীও ফুটে ওঠে। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার বিস্ময়কর অগ্রগতির সমস্রোতে যান্ত্রিকতা কবির নজর এড়িয়ে যায় নি। পরবর্তীকালে আমরা দেখি রাশিয়ায় বিপ্লবের পতন ঘটে, ভেঙ্গে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
পত্রিকা সম্পাদক, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, রাজনৈতিক আলোচক দেবাশিস দত্ত ১৯৮৭ সালে রাশিয়া গিয়েছিলেন। রাশিয়া থেকে ফেরার মাত্র চার বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হয় সোভিয়েত। তারপর অতিক্রান্ত হয়েছে দুটি দশক। এক মেরুর এই বিশ্বে অতিদক্ষিণপন্থার রক্তচক্ষু আজ প্রাত্যহিক। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা সেকারণে রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’র প্রতিস্থাপন দেখতে চেয়েছি একদা মস্কোতে ছ’মাস কাটানো দেবাশিস দত্তের কলমে।
রাশিয়ার চিঠি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মস্কৌ রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে।
চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হবার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সব চেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায়কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়েমরে—জীবনযাত্রার জন্য যত-কিছু সুযোগ সুবিধে সব-কিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে—উপরের সবাইআলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।
আমি অনেক দিন এদের কথা ভেবেছি, মনে হয়েছে এর কোনো উপায় নেই। এক দল তলায় না থাকলে আর-এক দল উপরে থাকতেই পারে না, অথচ উপরে থাকার দরকার আছে। উপরে না থাকলে নিতান্ত কাছের সীমার বাইরে কিছু দেখা যায় না; কেবলমাত্র জীবিকানির্বাহ করার জন্যে তো মানুষের মনুষ্যত্ব নয়। একান্ত জীবিকাকে অতিক্রম করে তবেই তার সভ্যতা। সভ্যতার সমস্ত শ্রেষ্ঠ ফসল অবকাশের ক্ষেত্রে ফলেছে। মানুষের সভ্যতায় এক অংশে অবকাশ রক্ষা করার দরকার আছে। তাই ভাবতুম, যে-সব মানুষ শুধু অবস্থার গতিকে নয়, শরীরমনের গতিকে নীচের তলায় কাজ করতে বাধ্য এবং সেই কাজেরই যোগ্য, যথাসম্ভব তাদের শিক্ষাস্বাস্থ্য-সুখ সুবিধা রজন্যে চেষ্টা করা উচিত।
মুশকিল এই, দয়া করে কোনো স্থায়ী জিনিস করা চলে না; বাইরে থেকেউপকার করতে গেলে পদে পদে তার বিকার ঘটে। সমান হতে পারলে তবেই সত্যকার সহায়তা সম্ভব হয়। যাই হোক, আমি ভালো করে কিছুই ভেবে পাই নি, অথচ অধিকাংশ মানুষকে তলিয়ে রেখে, অমানুষ করে রেখে, তবেই সভ্যতা সমুচ্চে থাকবে এ কথা অনিবার্য বলে মেনে নিতে গেলে মনে ধিক্কার আসে।
ভেবে দেখো-না, নিরন্ন ভারতবর্ষের অন্নে ইংলণ্ড্ পরিপুষ্ট হয়েছে। ইংলণ্ডের অনেক লোকেরই মনের ভাব এই যে, ইংলণ্ড্কে চিরদিন পোষণ করাই ভারতবর্ষের সার্থকতা। ইংলণ্ড্ বড়ো হয়ে উঠে মানবসমাজে বড়ো কাজ করছে, অতএব এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে চিরকালের মতো একটা জাতিকে দাসত্বে বদ্ধ করে রেখে দিলে দোষ নেই। এই জাতি যদি কম খায়, কম পরে, তাতে কী যায় আসে—তবুও দয়া করে তাদের অবস্থার কিছু উন্নতি করা উচিত, এমন কথা তাদের মনে জাগে। কিন্তু এক-শো বছর হয়ে গেল; না পেলুম শিক্ষা, না পেলুম স্বাস্থ্য, না পেলুম সম্পদ।
প্রত্যেক সমাজের নিজের ভিতরেও এই একই কথা। যে মানুষকে মানুষ সম্মান করতে পারে না সে মানুষকে মানুষ উপকার করতে অক্ষম। অন্তত যখনই নিজের স্বার্থে এসে ঠেকে তখনই মারামারি কাটাকাটি বেধে যায়। রাশিয়ায় একেবারে গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যা সমাধান করবার চেষ্টা চলছে। তার শেষ ফলের কথা এখনো বিচার করবার সময় হয় নি, কিন্তু আপাতত যা চোখে পড়ছে তা দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। এতকাল সমাজের অধিকাংশ লোক শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত—ভারতবর্ষ তো প্রায় সম্পূর্ণই বঞ্চিত। এখানে সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনো মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এজন্যে কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম। শুধু শ্বেত-রাশিয়ার জন্যে নয়—মধ্য-এশিয়ার অর্ধসভ্য জাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলেছে; সায়েন্সের শেষ-ফসল পর্যন্ত যাতে তারাপায় এইজন্যে প্রয়াসের অন্ত নেই। এখানে থিয়েটারে ভালো ভালো অপেরা ও বড়োবড়ো নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের। কোথাও এদের অপমান নেই। ইতিমধ্যে এদের যে দুই-একটা প্রতিষ্ঠান দেখলুম সর্বত্রই লক্ষ্য করেছি এদের চিত্তের জাগরণ এবং আত্মমর্যাদার আনন্দ। আমাদের দেশের জনসাধারণের তো কথাই নেই, ইংলণ্ডের মজুরে শ্রেণীর সঙ্গে তুলনা করলে আকাশপাতাল তফাত দেখা যায়। আমরা শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছি এরা সমস্ত দেশজুড়ে প্রকৃষ্টভাবে তাই করছে। আমাদের কর্মীরা যদি কিছুদিন এখানে এসে শিক্ষা করে যেতে পারত তা হলে ভারি উপকার হত। প্রতিদিনই আমি ভারতবর্ষের সঙ্গে এখানকার তুলনা করে দেখি আর ভাবি, কী হয়েছে আর কী হতে পারত। আমার আমেরিকানসঙ্গী ডাক্তার হ্যারি টিম্বর্স্ এখানকার স্বাস্থ্যবিধানের ব্যবস্থা আলোচনা করছে—তার প্রকৃষ্টতা দেখলে চমক লাগে—আর কোথায় পড়ে আছে রোগতপ্ত অভুক্ত হতভাগ্য নিরুপায় ভারতবর্ষ! কয়েক বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষের অবস্থারসঙ্গে এদের জনসাধারণের অবস্থার সম্পূর্ণ সাদৃশ্য ছিল—এই অল্পকালের মধ্যেদ্রুত বেগে বদলে গেছে—আমরা পড়ে আছি জড়তার পাঁকের মধ্যে আকণ্ঠ নিমগ্ন।
এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যেএকদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচবানিয়েছে—কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না—সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।
এখানকার ছেলেদের মধ্যে বিভাগ করে কর্মের ভার দেওয়া হয়েছে দেখলুম, ওদের আবাসের ব্যবস্থা সম্বন্ধে একদল স্বাস্থ্য, একদল ভাণ্ডার ইত্যাদি নানারকম তদারকের দায়িত্ব নেয়; কর্তৃত্ব সবই ওদের হাতে, কেবল একজন পরিদর্শক থাকে। শান্তিনিকেতনে আমি চিরকাল এই-সমস্ত নিয়ম প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছি-কেবলই নিয়মাবলী রচনা হয়েছে, কোনো কাজ হয় নি। তার অন্যতমকারণ হচ্ছে, স্বভাবতই পাঠবিভাগের চরম লক্ষ্য হয়েছে পরীক্ষায় পাস করা, আরসব-কিছুই উপলক্ষ; অর্থাৎ হলে ভালোই, না হলেও ক্ষতি নেই। আমাদের অলস মনজবরদস্ত দায়িত্বের বাইরে কাজ বাড়াতে অনিচ্ছুক। তা ছাড়া শিশুকাল থেকেই আমরা পুঁথি মুখস্থ বিদ্যাতেই অভ্যস্ত। নিয়মাবলী রচনা করে কোনো লাভ নেই; নিয়ামকদের পক্ষে যেটা আন্তরিক নয় সেটা উপেক্ষিত না হয়ে থাকতে পারে না। গ্রামের কাজ ও শিক্ষাবিধি সম্বন্ধে আমি যে-সব কথা এতকাল ভেবেছি এখানে তার বেশি কিছু নেই—কেবল আছে শক্তি, আছে উদ্যম, আর কার্যকর্তাদের ব্যবস্থাবুদ্ধি। আমার মনে হয়, অনেকটাই নির্ভর করে গায়ের জোরের উপর—ম্যালেরিয়ায় জীর্ণ অপরিপুষ্ট দেহ নিয়ে সম্পূর্ণ বেগে কাজ করা দুঃসাধ্য; এখানকার শীতের দেশের লোকের হাড় শক্ত বলেই কাজ এমন করে সহজে এগোয়। মাথা গুনতি করে আমাদের দেশের কর্মীদের সংখ্যা নির্ণয় করা ঠিক নয়, তারা পুরো একখানা মানুষ নয়।
ইতি
২০ সেপ্টেম্বর ১৯৩০
প্রতিস্থাপন :: দেবাশিস দত্ত
বন্ধুবরেষু,
সেদিনগুলোর কথা জানতে চেয়েছ। দিনগুলো অনেক পুরনো হয়ে গেছে। হুবহু মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। কথার নিয়মই তাই। কিছু বাদ পরে, কিছু জুড়ে যায়। সেদিনে ডাইরি লিখতাম। লিখছিলাম, তাও হারিয়ে গেছে। অথবা কেউ বিমান বন্দরেই তুলে নিয়েছে নিজের মনে করে, হয়তো রেখেছে যত্নেই, অথবা যে জন্যে তুলে নিয়েছিল, সে আগ্রহ পরে না টেকায় চিরতরে হারিয়ে গেছে। বলতে পারি সেদিনের ডাইরি লেখাটা কোন কাজেই লাগল না। তাই আজ যা লিখছি, বলছি, সেটা কিছুটা স্মৃতি থেকে, কিছুটা বয়ে যাওয়া সময়ের স্রোতে আছাড় খেয়ে খেয়ে, পাল্টে পাল্টে। শুদ্ধ পরিভাষায় বলতে পারো, দেখা আর শোনার বিনির্মিত ভাষ্য।
যেখানকার কথা বলছি, সে জায়গাটা নিয়ে দারুণ একটা গর্ব ছিল। সেই গর্বটা একদিনে তৈরি হয়নি। মাত্র ইজের প্যান্ট ছেড়ে সেভেন এইটে যখন পড়ি তখন থেকেই পেতাম একটা সচিত্র পত্রিকা। ছবি দেখতাম, খুঁটিয়ে পড়তাম, জানতে পেতাম দেশটার কথা, দেশের মানুষ তাদের উন্নয়নের কথা, বিজ্ঞানের নতুন নতুন সাফল্য আর নানা আবিষ্কারের কথা, কাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যে’র কথা – এক সময়ে ‘অভাবের অভাব’ ঘটে গেল … কেউ ঘাঁটাতে সাহস করে না … সে অনেক অনেক কথা। এমন এক দেশ রবি ঠাকুরও যাকে নিয়ে বলেছেন, না এলে ‘তীর্থ দর্শন’ অপূর্ণ থেকে যেত, সেটা কলেজে পড়ার সময়ে জেনেছিলাম। পড়ার সাথে সাথে জিজ্ঞাসাও ছিল অনেক, চিঠি লিখে জানতে চাইতাম উড স্ট্রিটে। জবাব পেতাম, আগ্রহ বাড়ত, সেই থেকে মনের মধ্যে, চিন্তা চেতনায় নির্মিত হয়েছিল একটা ছবি – আমরাও তো নির্মাণ করতে পারি এমন একটা দেশ, মানুষ, সমাজ, সভ্যতা। তখন থেকে অবচেতনেই ‘যদি একবার যাবার সুযোগ পেতেম’ গোছের একটা ‘স্বপ্ন’ একটা ‘সাধ’ বাসা বেধেছিল !! কাউকে কোনদিন তা প্রকাশ করিনি। যাবার সুযোগ হঠাতই এলো … বিশ্বাস করতে পারিনি … সেটা অনেক কাল পরে।
সালটা উনিশশো সাতাশি – তখনও দেশটা ছিল। আনাচে কানাচে অল্প বিস্তর প্রশ্ন দানা বেঁধেছে, অথচ কেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে না সাহসে ভর করে, উত্তর যাও বা আসছে কেমন যেন যান্ত্রিক, সক্ষমতা সত্ত্বেও অক্ষমতার প্রকাশ ঘটছিল – একদিন ফোন পেলাম … ‘তীর্থে’ যাবার সুযোগটা ‘চিন্তামণি’ যুগিয়ে দিলো। আর ঘুরে আসার চার বছর পরে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ল – অসুখটা কী ছিল … ধরা পড়লো না কেন, নিরাময় সম্ভব হল না কেন ইত্যাকার ভাবনায় কষ্ট হয়েছিল খুব … ভাবতে আজও পারি না দেশটাই আজ আর মানচিত্রে নেই … অস্তিত্ব আছে তবে অন্য নামে ভিন্ন চরিত্রে – তারও পরে কেটে গেছে আঠাশটা বছর!! কম কথা নয়। ইতিমধ্যে অনেক ভুলেছি … অনেক মনে নেই … অনেক ব্যাক ফুটে চলেছে আর এক নির্মাণ পর্ব। ট্রাম্প বল করছেন তো স্ট্রেট ড্রাইভ করছেন পুতিন … কখনও ছক্কা কখনও বোল্ড আউট। এভাবেই সময় গড়িয়ে চলেছে কোথায় … কেউ নিশ্চিত নয়, নিশ্চিন্তও নয়। এদিকে বাহান্ন সাল থেকে আমরা সঙ্গিন উঁচিয়ে চলেছি এক নয় বহু দিশায়—[এক] সার্বভৌম, [দুই] সমাজতান্ত্রিক, [তিন] ধর্মনিরপেক্ষ, [চার] গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’র তালাশ করতে করতে। কি এর মানে ? মানে এখন যাত্রা এক ‘ধর্মরাষ্ট্রের’র দিকে ? কেবল দিশা পায়নি যারা ‘আত্মশ্রমফলবঞ্চিত’… কেই বা দেবে ? ছিন্ন ভিন্ন হবার চুয়াত্তর বছর পর শপথ “উই দ্যা মাল্টিন্যাশনাল পিপল অব রাশিয়ান ফেডারেশন, ইউনাইটেড বাই অ্যা কমন ফেট অন আওয়ার ল্যান্ড, এস্টাব্লিশিং হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস, সিভিক পিস অ্যান্ড অ্যাকর্ড, প্রিজারভিং দ্যা হিস্টরিকালি এশটাব্লিশড স্টেট ইউনিটি , প্রসিডিং ফ্রম দ্যা ইউনিভারসালি রিকগনাইজড প্রিন্সিপলস অফ ইকুয়ালিটি অ্যান্ড সেলফ ডিটারমিনেশন অব পিপলস, রেভেরিং দ্যা মেমরি অফ অ্যানসেসটরস হু হ্যাভ কনভেড টু আস … বিলিফ ইন দ্যা গুড অ্যান্ড জাস্টিস, রিভাইভিং দ্যা সভারেন স্টেটহুড অব রাশিয়া… ডেমোক্র্যাটিক বেসিক … ” অনেক কিছু যা ‘দশ দিন’-এর মত প্রাণিত করে না। কিম আশ্চর্যম অতঃপরম … সে অনেক কথা …
ছ’ মাস ছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মাত্র দু’ সপ্তাহ।
আগস্টে যখন পৌঁছলাম, তখন রাত, চারপাশের কিছুই ঠাহর করতে পারছি না, রুশি সঙ্গীরা যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে যাচ্ছি, সমস্যা হল ভাষার, সমাধানও হল পেলাম একজন ইন্টারপ্রেটর, একটা বাড়িতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হল। রাত কাটতেই সকালে উঠে, আসলে উঠতে হয়নি, উত্তেজনায় ঘুমই হয়নি, স্নান খাওয়া সেরে গাড়িতে সঙ্গীদের সঙ্গে আসা হল একটা অফিসে, ছবিটবি তুলে, সেখান থেকেই পেলাম ছ’ মাস ‘থাকার’ ছাড়পত্র। তারপর এসে পৌঁছলাম সেই মারক্সিস্ট লেনিনিস্ট ইন্সটিট্যুটে, এক একটা পদক্ষেপ উত্তেজনায় ভরিয়ে দিচ্ছে মন প্রাণ দেহ – সত্যি ভাবিনি তো কোনদিন এমন একটা ইন্সটিট্যুটে আসতে পারব ! হস্টেলেই থাকার ব্যবস্থা। একজন ভারতীয় ডাক্তার, আমাদের জেলাতেই বাড়ি ছিল, ডাক্তারি পড়তে গিয়ে একজন রুশি মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই থেকে গেছেন – উনি খবর রাখেন, আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। ঠাণ্ডা তখনও পড়েনি, একটা জামা গায়ে দিয়ে বেরনো যায়, গাছের পাতা ঝরতে মাত্র শুরু করেছে। ছ’ মাসের অভিজ্ঞতা কম নয়! আজ মেলাই, মেলাতে বাধ্য – অনেক সাফল্যের মধ্যে কি লুকিয়ে থাকে কোন ‘বিপর্যয়’ সম্ভাবনাও! কখনও দেখা যায়, অন্ধ হলে আর দেখা যায় না !
রাশিয়া সম্পর্কে ভাল গল্প, সাফল্যের গপ্পোই বরাবর শুনেছি – কোথাও কারও কাছে কোন ত্রুটির কথা, ব্যর্থতার কথা শুনি নি – অথবা ত্রুটিটাও সাফল্যের মোড়কে দেখতে শেখানো হয়েছিল, তাই শিখেছিলাম। প্রশ্ন করি নি, প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিলাম – প্রশ্ন করা বেয়াদপি, এমনটাই মনে হতে শুরু করেছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’-তে তীর্থ দর্শন পড়া থাকায় এবং ধমনীতে ‘বেয়াদপি’র স্বাভাবিক জন্মদাগ থাকায় একটু ভিন্নভাবে রাশিয়া দেখেছিলাম। প্রশ্ন উঠেছিল, বিতর্ক হয়েছিল। মীমাংসা হয়নি।
অনেক ঘটনা আছে। দুটোর খোঁচা এখনও বিঁধছে।
হস্টেলে রুম এলটমেন্ট হয়ে যাবার পর দিন একজন মহিলা এলেন আমার রুমে। এ’কথা সে’কথার পর তিনি চোস্ত ইংরেজিতে সোজাসুজি বললেন – ‘পেস্ট আছে? পারফিউম? এনি ডলার?’ অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম তাঁর মুখের দিকে! অগত্যা যা ছিল দিয়েছিলাম ওঁকে। অমন একটা দেশের মানুষ এমন ‘হাংরি’ কেউ হয়? অমন একটা দেশের মানুষ ! কি না থাকলে এমনটা হয়!! খুব অবাক হয়েছিলাম। তিনি ছিলেন একজন অধ্যাপিকা। নামটা বললাম না। এখানে পুনে ইউনিভারসিটিতে বেশ কয়েক বছর গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। আজ হয়তো তিনি আর বেঁচেও নেই। সে সময়ে ১৯৮৮ সালে এখানে ত্রিপুরায় নির্বাচন হচ্ছিল। একদিন আলোচনায় উঠে এসেছিল নির্বাচন প্রসঙ্গ। কী হবে এ প্রশ্নের জবাবে আমরা ভারতীয় যারা ছিলাম একবাক্যে বললাম মানিকবাবু জিতবেন। তিনি একমত হন নি। বলেছিলেন ‘তোমরা মেজরিটি তাই তোমাদের মত গ্রাহ্য হোক। কিন্তু আমার মনে হয় বামেরা জিতবে না। একটা দীর্ঘ বিশ্লেষণ হাজির করেছিলেন। তবুও বলেছিলেন, ‘আমি মাইনরিটি, মতটা কেবল নোট করে রাখ।’ অনেক সময়েই বা প্রায় সব সময়েই ‘মাইনরিটি মত’ এমনকি ‘ডেমোক্র্যাটিক সেন্ট্রালিজম’ এর আওতাতেও গ্রাহ্য হয় না। দিল্লী ফিরে আসার পর খবর পেলাম ত্রিপুরায় বামপন্থীরা হেরে গেছে। বুঝেছিলাম বিশ্লেষণে ‘গভীরতা’ না থাকলে হার দেখতে পাওয়া যায় না।
কয়েকদিন বাদে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম শহরটা ঘুরে দেখব বলে। কিছুটা গিয়েই বিশাল মাপের হোঁচট খেলাম। ভাবতেই পারিনি অমনটা দেখব। দেখলাম আমাদের নদীয়ার সেই ইস্কন পার্টি – গৌর নিতাই এর সাজে আট দশজন সাহেব খোল করতাল হাতে নগর সঙ্কীর্তনে বেরিয়েছে। মুখে সেই নাম … হরে কৃষ্ণ হরে রাম … সেই সুর উচ্চারণে পরমানন্দে বিশ্বাস ভর করে ‘মুক্তি’র সন্ধানে ওঁরা চলেছে। কোথাও কোন বাধা নেই। কয়েকদিন পড়ে আলোচনায় তুলেছিলাম বিষয়টা। জানলাম আপন বিশ্বাস অনুযায়ী ভজন পূজন সাধন, যদি কারও ক্ষতি না করে তবে তাতে নাকি কোন আপত্তি নেই। সে তো খুবই ভালো কথা। কিন্তু ১৯১৭ সালে বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের বহু পরাধীন জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখানো দেশটায় মাত্র ৭০ বছরেই ‘মুক্তি’র সন্ধানে নগর সঙ্কীর্তনে বেরোতে হল? সেদিনেই মনে হয়েছিল শেকড় গড়িয়েছে তো অনেক দুর।
আর একটা ঘটনা। মাঝে মাঝে মার্কেটে যেতাম। কোঅপারেটিভ সব্জী মার্কেট। টম্যাটোর দাম করেছিলাম। জানা ছিল সব জিনিষের বাঁধা দাম। অ্যাডমিনিস্টারড প্রাইস … ৫০ বছর কোন জিনিষের দাম বাড়েনি। মেট্রো চড়ুন ৫ কোপেক, চিঠি লিখুন ৫ কোপেক, এক কাপ চা নিন ৫ কোপেক ইত্যাদি অনেক কিছুই যা ছিল তাই। অথচ সেই বাজারে টম্যাটোর তিন রকম দাম শুনেছিলাম। কেন? প্রশ্নটা মনের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বললাম। ‘ওসব ছোট ব্যাপার, ছেড়ে দাও’– বন্ধুরা বলেছিল। [কী করে বোঝাই কোন কিছুই ‘ছোট’ নয়। বড় হতে পারে, ঘুরিয়ে দিতে পারে যখন তখন।] একটা সেমিনারে অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় সঞ্চালককে দুম করে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলাম। যেখানে অ্যাডমিনিস্টারড প্রাইস নীতিগতভাবে চালু সেখানে একই বাজারে টম্যাটোর তিন রকম দাম কেন? যে উত্তর পেয়েছিলাম তা হল: এক] ফ্রিজড মানে ঠাণ্ডাঘরে রাখার জন্য এক রকম দাম (নিয়ন্ত্রিত); দুই] ফ্রেস মানে টাটকা যা ফ্রিজে রাখা হয়নি সেজন্যে তার একটু বেশি দাম, তিন] চাষি যিনি নিজে চাষ করে বাজারে বিক্রয়ের জন্য এনেছেন তার আর একটু বেশি দাম। অর্থনীতি তেমন না জানলেও উত্তর খুশি করেনি। অনেক বার প্রশ্নটা করেছি, ওঁরা বিরক্ত হতেন… আজ আর প্রশ্নটা করার যায়গাটা নেই, হয়তো মানেও হয় না।
রবীন্দ্রনাথ যা দু সপ্তাহেই দেখেছিলেন চুয়াত্তর বছরেও যা সবাই মিলেও দেখিনি – ছাঁচটা ফেটে যেতে পারে এমন একটা সাবধান বাণী থাকা সত্ত্বেও আমল দেই নি কেউ …
ছাঁচের কথাই যখন উঠলো একটু ভাবা যেতে পারে বিষয়টা নিয়ে! যেমন এখানে চুয়াত্তর বছর আগে ২৬ নভেম্বর ১৯৪৯ বানানো ছাঁচে বলা হল: “উই, দ্যা পিপল অব ইন্ডিয়া হ্যাভিং সলেমনলি রিজল্ভড টু কনসটিটিউট ইন্ডিয়া ইন টু অ্যা সভারেন, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক”। স্পষ্ট কিছু বোঝাল না ? এই ছাঁচটা যারা বানালেন তাঁরাই পরে সেটা বদলে স্পষ্টীকরণ করলেন “… সভারেন, সোশ্যালিস্ট, সেকুলার, ডেমোক্র্যাটিক” বলে। ‘আত্মফলবঞ্চিত’দের সমর্থন (!) উভয় দিকেই। কলিজা প্রশস্ত হলে ‘সার্বভৌম’ এই ছাঁচ দিয়ে সব কিছু বোঝানো যেত। কিন্তু তা যায়নি। দুর্ভাগ্য। সেজন্য সোশ্যালিস্ট, সেকুলার, ডেমোক্র্যাটিক শব্দ জুড়তে হল। তাতেও কিছু কি দাঁড়াল! সোশ্যালিস্ট এই ছাঁচ দিয়ে সেকুলার, ডেমোক্র্যাটিক বা ডেমোক্র্যাটিক বলতে সেকুলার কোনটাই বোঝা গেল না। প্রতিটি যেখানে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছাঁচ হতে পারে সেখানে সবগুলো নিয়ে একটা অর্থহীন ছাঁচ তৈরি হল। সেটাও ভেঙ্গে নতুন ছাঁচ তৈরির চেষ্টা শুরু হয়েছে। ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হল সেই ছাঁচের একটা মডেল। যা হবে ডেমোক্র্যাটিক্যালি – হাত তুলে, নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে! গণতন্ত্র একটা ছাঁচ, একটা ধারণা যা সবার কাজে লাগে – অনেকটা জলের মত, যে পাত্রেই রাখা যাক তারই ছাঁচে মানিয়ে নেয় …
ইতি-
দেবাশিস
Posted in: Cover Story, May 2019