নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ – বিশ্বরূপ বিশ্বাস

রবীন্দ্রনাথ লাইভ সংখ্যায় বিশ্বরূপ বিশ্বাস
রবীন্দ্রনাথ লাইভ সংখ্যায় বিশ্বরূপ বিশ্বাস

প্রেক্ষাপট :  “সদর স্ট্রীটের রাস্তাটা যেখানে গিয়া শেষ হইয়াছে সেইখানে বোধ করি ফ্রী-ইস্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায়। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম। তখন সেই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল। চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম, একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেইদিনই ‘নির্ঝরের স্বপভঙ্গ’ কবিতাটি নির্ঝরের মতোই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল। লেখা শেষ হইয়া গেল কিন্তু জগতের সেই আনন্দরূপের উপর তখনো যবনিকা পড়িয়া গেল না।”
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন… জীবনস্মৃতিতে  ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ নিয়ে। পড়তে পড়তে মনে হয়, কত বদলে গেছে সব… দু’ দুটো বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ… এই যে ব্যবহার — “পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয়” আজ সেখানে সকালের মুত মোতে ট্রেন মিস করা সভ্যতা। অথচ আমাদের ভাষাটাও  তৈরি হয়নি। নিজের শ্রেণি ও সময়কে চিহ্নিত করতে পারা এক বিষয়, প্রিটেনশন আরেক। ফলে, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ আজকের দিনে কেমন হতে পারে, তা বোঝার জন্য হাত পাততেই হয় এমনই এক তরুণের কাছে যে নির্ভার, ভণিতাহীন… ফ্রেশ।  

আমরা পেলাম বিশ্বরূপকে।

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি এ প্রভাতে   প্রভাতবিহগ
কী গান গাইল রে!
অতি দূর দূর        আকাশ হইতে
ভাসিয়া আইল রে!
না জানি কেমনে    পশিল হেথায়
পথহারা তার একটি তান,
আঁধার গুহায় ভ্রমিয়া ভ্রমিয়া
গভীর গুহায় নামিয়া নামিয়া
আকুল হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ছুঁয়েছে আমার প্রাণ।
আজি এ প্রভাতে   সহসা কেন রে
পথহারা রবিকর
আলয় না পেয়ে     পড়েছে আসিয়ে
আমার প্রাণের ‘পর!
বহুদিন পরে         একটি কিরণ
গুহায় দিয়েছে দেখা,
পড়েছে আমার      আঁধার সলিলে
একটি কনকরেখা।
প্রাণের আবেগ রাখিতে নারি
থর থর করি কাঁপিছে বারি,
টলমল জল করে থল থল,
কল কল করি ধরেছে তান।
আজি এ প্রভাতে   কী জানি কেন রে
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।
জাগিয়া দেখিনু, চারিদিকে মোর
পাষাণে রচিত কারাগার ঘোর,
বুকের উপরে       আঁধার বসিয়া
করিছে নিজের ধ্যান।
না জানি কেন রে   এতদিন পরে
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।
 
জাগিয়া দেখিনু আমি আঁধারে রয়েছি আঁধা,
আপনারি মাঝে আমি আপনি রয়েছি বাঁধা।
রয়েছি মগন হয়ে আপনারি কলস্বরে,
ফিরে আসে প্রতিধ্বনি নিজেরি শ্রবণ-‘পরে।
দূর দূর দূর হতে ভেদিয়া আঁধার কারা
মাঝে মাঝে দেখা দেয় একটি সন্ধ্যার তারা।
তারি মুখ দেখে দেখে       আঁধার হাঁসিতে শেখে,
তারি মুখ চেয়ে চেয়ে করে নিশি অবসান।
শিহরি উঠে রে বারি,দোলে রে দোলে রে প্রাণ,
প্রাণের মাঝারে ভাসি        দোলে রে দোলে রে হাসি,
দোলে রে প্রাণের ‘পরে আশার স্বপন মম,
দোলে রে তারার ছায়া সুখের আভাস-সম।
 
মাঝে মাঝে একদিন আকাশেতে নাই আলো,
পড়িয়া মেঘের ছায়া কালো জল হয় কালো।
আঁধার   সলিল ‘পরে     ঝর ঝর বারি ঝরে
ঝর ঝর ঝর ঝর,দিবানিশি অবিরল–
বরষার দুখ-কথা,বরষার আঁখিজল।
শুয়ে শুয়ে আনমনে দিবানিশি তাই শুনি
একটি একটি ক’রে দিবানিশি তাই গুনি,
তারি সাথে মিলাইয়া কল কল গান গাই–
ঝর ঝর কল কল–দিন নাই, রাত নাই।
এমনি নিজেরে লয়ে রয়েছি নিজের কাছে,
আঁধার সলিল ‘পরে আঁধার জাগিয়া আছে।
এমনি নিজের কাছে খুলেছি নিজের প্রাণ,
এমনি পরের কাছে শুনেছি নিজের গান।
 
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত-পাখির গান।
না জানি কেন রে         এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে        উথলি উঠেছে বারি,
ওরে       প্রাণের বাসনা  প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।
থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়,
বাহিরিতে চায়,         দেখিতে না পায়
   কোথায় কারার দ্বার।
প্রভাতেরে যেন লইতে কাড়িয়া
আকাশেরে যেন ফেলিতে ছিঁড়িয়া
উঠে শূন্যপানে–পড়ে আছাড়িয়া
করে শেষে হাহাকার।
প্রাণের উল্লাসে ছুটিতে চায়
ভূধরের হিয়া টুটিতে চায়,
আলিঙ্গন তরে ঊর্ধ্বে বাহু তুলি
আকাশের পানে উঠিতে চায়।
 
প্রভাতকিরণে পাগল হইয়া
জগৎ-মাঝারে লুটিতে চায়।
কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারিদিকে তার বাঁধন কেন?
ভাঙ্‌ রে হৃদয় ভাঙ্‌ রে বাঁধন,
সাধ্‌ রে আজিকে প্রাণের সাধন,
লহরীর পরে লহরী তুলিয়া
আঘাতের পর আঘাত কর্‌।
মাতিয়া যখন উঠিছে পরান,
কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!
উথলি যখন উঠিছে বাসনা,
জগতে তখন কিসের ডর!
 
সহসা আজি এ জগতের মুখ
নূতন করিয়া দেখিনু কেন?
একটি পাখির আধখানি তান
জগতের গান গাহিল যেন!
জগৎ দেখিতে হইব বাহির,
আজিকে করেছি মনে,
দেখিব না আর নিজেরি স্বপন
বসিয়া গুহার কোণে।
আমি       ঢালিব করুণাধারা,
আমি       ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি       জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা;
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া,
দিব রে পরান ঢালি।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব
হেসে খলখল গেয়ে কলকল
তালে  তালে দিব তালি।
তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া–
যাইব বহিয়া–যাইব বহিয়া–
হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া
গাহিয়া গাহিয়া গান,
যত দেব প্রাণ       বহে যাবে প্রাণ
ফুরাবে না আর প্রাণ।
এত কথা আছে     এত গান আছে
এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে      এত সাধ আছে
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।
 
এত সুখ কোথা     এত রূপ কোথা
এত খেলা কোথা আছে!
যৌবনের বেগে      বহিয়া যাইব
কে জানে কাহার কাছে!
অগাধ বাসনা        অসীম আশা
জগৎ দেখিতে চাই!
জাগিয়াছে সাধ      চরাচরময়
প্লাবিয়া বহিয়া যাই।
যত প্রাণ আছে ঢালিতে পারি,
যত কাল আছে বহিতে পারি,
যত দেশ আছে ডুবাতে পারি,
তবে আর কিবা চাই!    
পরানের সাধ তাই।
 
কী জানি কী হল আজি জাগিয়া উঠিল প্রাণ,
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান–
“পাষাণ-বাঁধন টুটি, ভিজায়ে কঠিন ধরা,
বনেরে শ্যামল করি, ফুলেরে ফুটায়ে ত্বরা
সারাপ্রাণ ঢালি দিয়া,
জুড়ায়ে জগৎ-হিয়া–
আমার প্রাণের মাঝে কে আসিবি আয় তোরা!’
 
আমি যাব, আমি যাব, কোথায় সে, কোন্‌ দেশ–
জগতে ঢালিব প্রাণ,
গাহিব করুণাগান,
উদ্‌বেগ-অধীর হিয়া
সুদূর সমুদ্রে গিয়া
সে প্রাণ মিশাব আর সে গান করিব শেষ।
 
ওরে, চারিদিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর!
ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ কারা, আঘাতে আঘাত কর্‌!
  ওরে,আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এয়েছে রবির কর!

প্রতিস্থাপন :: বিশ্বরূপ বিশ্বাস

মদমগ্ন কিচিরমিচির

সকাল থামালো এসে সকালের লরি অন্যত্র-বাড়ি। শুভ্রবস্ত্রে

নামানো বিকালে পেট্রল কম দিয়ে গাড়ি চালাবে

অনেকে। কিংবা অন্যকেউ। আবার বোধহয় গল্পের শহরে

প্রবলেম হবে গ্রামের। আবার বোধহয় কারাগার কাঁপিয়েছেন

পাখিদের কিচিরমিচির। কিংবা মদমগ্ন-ড্রাইভার


রুধিরের কাছাকাছি থেমে গ্যাছে

দেমাগি জীবন। দারুণ হ’য়েছে। পরাণের লহরী নেমে

গ্যাছে পাষাণের গায়।


চায় সকাল সন্ধের তারা রাশি রাশি। যায়

সকাল ছমছমে ফ্রিজে নিজে নিজে।


ঘুম ভেঙে উঠে আবার ভালোলাগে ঘুম। চোখ

স্টক করে চোখের ঘুম। জ’মে যাওয়া মরশুমে বরফ

কত কম দ্যাখো। স্পর্শে কত বেশী দ্যাখো পাহাড়ের ঠাণ্ডা।


এই শীতলতায় কাবার হিমের ঢেউ। যখন সঙ্গীতে সঙ্গীন

নেই কেউ : তখন কাহানী দাঁড়াক জ্যান্ত আড্ডায়।


সেই সাক্ষাতের সনে হারমোনিয়ামে হোক সোনার

বাউলগান। সকল প্রতাপ ছিন্ন ক’রে সেই সকালের লোক

নবমেঘপক্ষে রাস্তাঘাটের উৎপাতে যেন অনন্ত

আশমান চায়।


সূর্যের রাঙা দরজায় সারা-প্রভাত।।

Facebook Comments

Leave a Reply