বঙ্গমাতা – অমিতাভ প্রহরাজ

রবীন্দ্রনাথ লাইভ সংখ্যায় অমিতাভ প্রহরাজ
রবীন্দ্রনাথ লাইভ সংখ্যায় অমিতাভ প্রহরাজ

প্রেক্ষাপট : ‘চৈতালী’ কাব্যগ্রন্থের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতাটি যেসময় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন সেই সময়কে ভারতে ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রাকসূচনা পর্ব বলা যেতে পারে। এই সময়কালেই, কয়েক বছর আগে-পরে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটছে, রাজা রবি বর্মা ‘ভারত মাতা’ ছবিটি আঁকছেন, লেখা হচ্ছে ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘আনন্দমঠ’। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পরাধীন ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছেন ‘জাতীয়তাবাদ’-এর সূত্রে। কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলা উত্তাল হবে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে। রবীন্দ্রনাথ প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে ক্রমে সক্রিয় হয়ে উঠবেন সেই আন্দোলনে।

‘বঙ্গমাতা’ কবিতাটি তার কিছুকাল পূর্বে (১৩০৩ বঙ্গাব্দে) লেখা। এই কবিতায় চূড়ান্ত সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা পূর্বে নিস্ক্রিয়তার ও আত্মকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে কবির সামালোচনা ও আহ্বান চোখে পড়ে।

আজ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গও এক সামাজিক-রাজনৈতিক পালাবদলের মুখে। এই সময়ে, সমকালের কবি অমিতাভ প্রহরাজ রবীন্দ্রনাথের সে’দিনের বয়সের কাছাকাছি। আমরা দেখতে চাই, অমিতাভ তাঁর সহনাগরিকদের কাছে কোন বার্তা, আহ্বান প্রেরণ করেন।

বঙ্গমাতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।

প্রতিস্থাপন :: অমিতাভ প্রহরাজ

ভুতভুগোলের দেশে

দেবা বললে, প্রতিস্থাপন। দেড়েল বুড়োর কবিতা। যে বয়সে লেখা কবিতা, সে বয়সের একজনকে দেওয়া হচ্ছে প্রতিস্থাপনের জন্য। ভারি ভালো কথা। আমাকে তাই চল্লিশের কাছাকাছি রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিলে। কি উৎকট বিৎকট লেখা, বেছে বেছে আমাকেই। দাউদাউ হয়ে গেছিলো পুরো। প্রথমে তো প্রতিস্থাপন কী, তা নিয়ে ফুল ঘেঁটে গেলাম। বলা ছিলো, বিনির্মান নয়, প্রতিস্থাপন। ইন্দ্রকে মধ্যরাত্রের কিছু ফোনের পর বুঝলুম রবীন্দ্রনাথের জায়গায় আমাকে বসাতে হবে। সময়ের জায়গায় এই সময়। সে ঘটনার, প্রসঙ্গ, পরিস্থিতির জায়গায় এই ঘটনা, প্রসঙ্গ পরিস্থিতি। কি বেজায় আটকে গেলুম। বিদঘুটে এক ছন্দে লেখা কবিতা বঙ্গমাতা। বেছে বেছে আমাকে এটাই দিতে হলো দেবাকে। তারপর দেবার তাগাদা। যতবার শুরু করি, কবিতাটা পড়ে সব আটকে যায়। জাস্ট সব। দেড়েল বুড়োর গান যত ট্রিগারিং, তার কবিতা ঠিক ইকুয়ালি এ্যান্টিট্রিগারিং। সো কলড অনুপ্রেরণার কোনো জায়গাই নেই, হয় নকল করো, আর নয়তো দূর থেকে পড়ো। অন্তরঙ্গ হয়ে লেখাটিকে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো স্কোপই নেই। ফুল, দরজা জানালা বন্ধ। দেবা বলে “তুই দিবি কি, দিবিনা?”। বহুদিনের সুনাম লেখা না দেওয়ার। শালা, এমন কখনো হয়নি, জাস্ট লিখতে পারছিই না। মানে পারছিনা। কাল দেবা আল্টিমেটাম দিলে। আমি বললুম, আজই দিচ্ছি। রাত্রিবেলা ফিরে লিখবো, পড়াতে গেছি ৯ কিমি দূরে, বাতাসে প্রায় ৭০০% আদ্রতা, সাড়ে নটায় বেরিয়ে দেখি সাইকেল টায়ার পাংচার। অনবদ্য মন পরিস্থিতি। সাইকেল হাঁটাতে হাঁটাতে, ঘেমে নেয়ে ফিরছি। এখানে বিজেপি জিতেছে, মোড়ে মোড়ে খোল কর্তাল সহ “জয় শ্রীরাম” (শুনলেই মনে হয় আলাইকুম আসসেলাম এর মতো ‘রাম রাম জয়শ্রী’ বলি উত্তরে)। ভাবলুম, এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথকে রিপ্লেস করি অমিতাভ প্রহরাজের জায়গায়, দুঃখেষনুদ্বিগ্নমনা মানুষ, কষ্ট কম হবে। মাথা টুপ্পুস ঝুপ্পুস ঘামে, দুর্গাপুরের রাস্তার ঝাঁকড়ুঝাকুম গাছগুলি স্থির, নিবাতনিঃষ্কম্প। তলা দিয়ে যেতে যেতে, রাস্তাটি যা আরো আট কিমি, তার চেয়ে অপদার্থ আর কাউকে মনে হলো না। স্নেহতল দীর্ঘতম অপদার্থে ঢাকা।

প্রতিস্থাপনের পর মনে হলো, এখানে থামা যাবে না। তাই একটা প্রতিস্থাপনের পর রয়েছে। প্রতিস্থাপনে বহুদিন বাদে ক্লাসিকাল ধাঁচায় লিখতে ইচ্ছে হলো, লিখলুম।

প্রতিস্থাপন-

স্নেহতল অবিকল দীর্ঘতম অপদার্থে ঢাকা
তরুণী জেনেছে তরুটির কি অকথ্য প্রশাখা
বিষাদে ক্ষ্যাপা ঘাস খিলখিল জ্বলে ওঠে জলে
ধূলোকবুলের ঘরে গুহাটি সুভেজা অতলে

স্নেহতল অবিকল ঋজুগন্ধ অপদার্থ মাখা
মহিলা তরলগুলি গৃহঢালা উন্মাদে রাখা
তদন্ত অন্তরে যাও অঘোর জোছনার ছানা
জিহ্বাজর্জর পদ্ম জাহাজডুবির বিছানা
এসব চিনেছো? দেখেছো কঙ্কালিনী ভাষা?
শব্দে হাড় বাজে, করোটি কোকিলের পোকা
এমন দেখেছো কিছু ভাঙা অঙ্কুরগন্ধ ঝরোখা
পাতা দিগ্বিদিকে বেজে ওঠে বাসনের কাঁসা

এই ভুতভুগোলের দেশে নির্জন অপদার্থ রাতে
বঁটিতে কাটো শিশু চীলের চীৎকার মাখাও তাহাতে
লাবণ্য আনো, জন্মপথ লবণ আন্দোলনে ঢাকা
শিশুমাংস, রামপোড়া যীশুপোড়া, ধর্মগন্ধ আঁকাবাঁকা

এখানে স্নেহ করো তুমি, ঢং করো, ঢং, কেমন বেহায়া
শিশুটিকে ব্লেডে চাঁছো, শিশু দিক তীক্ষ্ণ শিসের মায়া

স্নেহতল অবিকল ইতিহাস, দীর্ঘ অপদার্থে ঢাকা
জননী জানাও তাহাকে জননে কি অকথ্য শলাকা


প্রতিস্থাপনের পরে-

যেকোন লেখাই আরেকটা লেখা, যার,
একটা লেখা তোমায় লিখতে হবে
একটা শিশুকে ব্লেড দিয়ে চাঁছো
যতক্ষণ না সে শিস দেয় বোতাম দেওয়া শব্দ ফুরোলে
মেজাজ হারানো বটগাছটির দিকে দেখো একবার
শান্ত খাতার নাম দেখা যাবে
নতজানু ঈগলেরর ডানায় প্রেমের হাঁটু
এ এক অচল নুরানি
ধীরে ধীরে যত নিকট জুড়োয়…
আমাদের বাঘগুলি
ঝাপসা হতে চায়, বাঘের করুণা দেখে
হিন্দি সিনেমার ছোট ছেলে আঙুল তুলে বলবে “জানু”, “জানু”

জীবন সুস্নিগ্ধ জাহাজের
পার্মানেন্ট কিশোরকুমার, তার মেহফিল-এ-গালীব জেগেছে আহাকার
পৃথিবী শক্ত, পাহাড় শক্ত, চাঁদ শক্ত, জাহাজ শক্ত
হারানো জাহাজের এ্যাঙ্গেল থেকে সমুদ্রটিও শক্ত শক্ত জায়গায় ভরপুর
আমি কি এখনো বুঝছেনা
শুধুমাত্র গর্ভ দিয়ে তৈরী পাগলটি আমরা বোঝেনা?
প্রসবে বানানো মুখ, প্রসবে বানানো বুক
আমি কি এখনো জানেনা,
পাগলের কোন তুমি নেই? এমনই প্রসবময়তা
খরগোশও কর্কশ হয়ে যায়
দুচোখে শজারু নড়ে অনেক তাকালে
এমন মরীয়া লাগলে আমাদের স্তনে শক্ত ঘটে যায়
হয়তো এই সেই অন্তিম আলতামিরাক্যাল
যেখানে আরেকটি লেখার শেষে
একটি যেকোন লেখা লিখে যেতে হয়
যার ছায়াটি হারালেই তবে দেখা যায়
তোমার যেকোন স্তন অনায়াসে অফুরন্ত হয়ে ওঠে

Facebook Comments

Leave a Reply