বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদ ও আবহমানের বাঙালীর প্রতিরোধ – শুভদীপ মৈত্র

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে….

কথা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ নিয়ে আমি কেন লালনেরে স্মরণ করলেম, এ কেমন অনাসৃষ্টি ব্যাপার? এমন যাদের মনে হতে পারে তাদের প্রথমেই বলি আমি সত্যিই এই জাতীয়তাবাদ জিনিসটা বুঝি না – জাত বুঝি। এ তো আজকের ব্যাপার নয় প্রায় হাজার দুই বছর ধরে এই উপমহাদেশের ভূখণ্ডে তা না বুঝে অস্তিত্বই সম্ভব নয়। জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশানালিজম কারে কয় এ জানতে পারলাম এই তো সেদিন, ওই দুহাজারের নিরিখে যাকে নেহাত নিমেষ বলা যায়। ভাষাভিত্তিক যে ন্যাশানালিজম-এর ধারণা ও জাতি সত্ত্বার পরিচয় আমরা বুঝি তা উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শুরুতে এসে মান্য হয় এদেশে এবং তা ইংরেজদের হাত ধরে। অর্থাৎ এ ধারণা বিলাতি, যেমন আমাদের প্যান্টালুন পোশাকটি। এটা উরোপীয় ‘লিঙ্গুইস্টিক মনিজম’ থেকে এসেছে কারণ ভারতে ভাষার ধারণা জাতিভিত্তিক নয়। যেমন বাঙলা ভাষা সেই চর্যাপদের সময় থেকে আজ পর্যন্ত যে ভৌগলিক অঞ্চলের মুখের ভাষা, সেই অঞ্চলের মানুষ নিজেদের এক অখণ্ড বাঙালী জাতি ভাবত এমন ইতিহাস দেখা যায়নি। নেশান এর অর্থ অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, a large body of people united by common descent, history, culture, or language, inhabiting a particular state or territory। এর অনুবাদ হিসেবে আমরা যে শব্দটা পেয়েছি তার গোরায় যে গলদ তা চোখে পড়ার মতো। জাতি, যার উৎপত্তি জাত থেকে। তাহলে আমাদের জাতীয়তাবাদ বুঝতে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্যান্য ধারণগুলো খানিক নেড়েচেড়ে দেখার দরকার আছে।

জাত ও বর্ণ প্রথার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এর বীজ। বর্ণকে ক্লাস হিসেবে দেখেছেন ঐতিহাসিকরা এবং তার কারণ হল যে কাজ অনুসারে যে চতুর্বর্ণ বেদের আশ্রয় তা হেরিডিটারি বা জন্মগত ছিল না এমন কথা বলা হয় – সে হয়তো বৈদিক যুগের শুরুতে ছিল না, কিন্তু বর্ণ শব্দটা যে প্রথম থেকেই আর্যদের রেসিয়াল বা জাতিগত পরিচয় তা এড়ানো যায় কীভাবে? আর্যীকরণ ভারতে যখন থেকে শুরু হয় এবং আর্যদের আগ্রাসনের সময় থেকেই একমাত্র চতুর্বর্ণ  দিয়ে সম্ভব হয়নি এ দেশের ক্ষমতার হায়ারার্কি বা কাঠামো তৈরি। তারা বহু জাতের অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং বর্ণ চার হলেও জাত বহুতর এ মনুসংহিতাতেও পাওয়া যায়। বিজিত দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ সেই জাতের মধ্যেই অন্তর্গত এবং এই জাতের মিশ্রণ ঘটলে তার থেকে উদ্ভূতদের পরিচয়ও নির্দিষ্ট করা হয়। জাতি হিসেবে ভারতীয় হওয়াটা তাই ঔপনিবেশিক যুগের আগে অসম্ভব। এ পরিচিতি মুসলমান শাসনের আগেও ছিল না। অথচ দেখা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক যুগে যখন এই পরিচিতি নির্মাণ শুরু হল – তখন প্রাচীন জাতি ও উরোপীয় ন্যাশানালিটিকে মিলিয়ে তৈরি করা হল এক বকচ্ছপ। যার নাম হওয়া উচিত ছিল ইন্ডিয়ান মাল্টি ন্যাশানাল কংগ্রেস সে হয়ে গেল ন্যাশানাল কংগ্রেস। এদিকে ভাষাভিত্তিক পরিচয়গুলোও বাদ দেওয়া গেল না, সেই জাতীয় কংগ্রেসই ভাষাভিত্তিক অঞ্চলভাগ করল ১৯২১ সালে তার কাজের সুবিধের জন্য। এবং পরিসংখ্যান বলছে স্বাধীনতার পর ১৯৫৬ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে ২১টি রাজ্য তৈরি হয় নতুন করে যার ভিত্তি ছিল ভাষাভিত্তিক পরিচিতি। সেই হিসেবে দেখলে ভারত এক বহুজাতিক সংযুক্ত রাষ্ট্র যার কোনো একমাত্রিক জাতীয়তাবাদ সম্ভব নয়। অথচ আমরা স্বাধীনতা আন্দোলনকে বলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ঔপনিবেশিকতা বিরোধী আন্দোলন নয়। তার মানে একই সঙ্গে দু ধরনের  জাতীয়তাবাদের ধারণা গড়ে উঠছিল এ দেশে উনিশ থেকে বিশ শতকে? তার একটা ভাষাভিত্তিক হলে অপরটি কী?

এই অপরটা নিয়েই গোলমাল। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ একটা প্রচ্ছন্ন হিন্দুরাষ্ট্রের মিথ। এই পরিচিতি তৈরি হচ্ছে নব্য মার্কেন্টাইল পুঁজি ও সামন্ততন্ত্রের হাত ধরে। এদেশে পুঁজিবাদ সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে না গিয়ে রফায় তৈরি করেছে আধুনিক ভারতের চেহারা। ফলে তার তৈরি জাতীয়তাবাদের মধ্যে পুরনো সমাজ কাঠামো যা ধর্মীয় বা সহজে বললে মনুবাদী – সেই সমস্ত-দিকগুলো রয়ে গেছে পুরোদমে। ফলে সে যখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কথা বলে সমগ্র দেশের মানুষকে এক ছাতার তলায় দেখতে চায় তখনও তার কাঠামো ছাড়তে পারে না। সংবিধানে যে সাম্যের কথা রয়েছে সেই সাম্য সামাজিক স্তরে কোনোদিনই দেখা যায়নি – এবং এদেশে সমাজ বাদ দিয়ে কোনো ক্ষমতাই আসলে ক্ষমতা নয় এমনকি এই একুশ শতকেও।

এই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নির্মাণ আধুনিক ভারতের পক্ষে ক্ষতিকারক, কারণ তা সংযুক্ত রাষ্ট্রের ধারণার বিরোধী। একমাত্রিক ভারতীয় পরিচিতি বিশ শতক জুড়ে যা তৈরি হয়েছে দেখা যাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী, যা এমন একটা কাঠামো চাইছে যেখানে ভিন্ন ধর্মের মানুষ শুধু নয় উচ্চ বর্ণবাদে বাকি সবাইকেই পায়ের তলায় রাখতে চাইছে। আধুনিক পৃথিবীতে পরিচিতি বহুমাত্রিক – লিঙ্গ, জাতি, ভাষা, শ্রেণী পরিচিতি নিয়ে লড়াই চলছে – এর বিপরীতে যে ভারতীয় পরিচয় তৈরির চেষ্টা হচ্ছে তা প্রচ্ছন্নভাবে সনাতন মনুবাদী নিয়মের। এবং তা ভয়ঙ্করভাবে অসাম্যের কাঠামো। হিন্দু জাতি পরিচিতি জাতপাত বিরোধী যে সাম্যের লড়াই তার ঠিক বিপরীত, তাই সেই লড়াই লড়তে গেলে হিন্দু জাতি পরিচিতির বিরোধিতা করতেই হবে।

এবার আসা যাক দ্বিতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণায় যা ভাষাভিত্তিক ও জাতিসত্ত্বার পরিচিতি দিয়ে তৈরি। বাঙালীর যে পরিচিতি সেই পরিচিতি ভাষাভিত্তিক জাতিসত্ত্বার পরিচিতি, সেই পরিচিতি একই সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পরিচিতির সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে পারে? প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয় কারণ অস্বীকার করার উপায় নেই এই ভূখণ্ড রাজনৈতিকভাবে তার সঙ্গে যুক্ত বহুদিন। এই যে আধুনিক হিন্দু জাতীয়তাবাদ তার পিছনে বর্ণহিন্দু বাঙালীর অবদান কম নয় – সমস্যার সূচনা এখন থেকেই। আধুনিক জাতীয়তাবাদের যে নির্মাণ হল এদেশে উনিশ শতকে তার প্রবক্তারা কোথা থেকে এলেন? কারা তারা? কারণগুলো কী? সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো ও পুঁজির যে আপোষের কথা আগেই লিখেছি তার প্রথম গবেষণাগার এই বাংলা। ঔপনিবেশিক যে অর্থনৈতিক শোষণ তার ফল বিদেশি শাসক বাদ দিলেও যারা ভোগ করেন তারা এখানকার উচ্চবর্ণ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, মার্কেন্টাইল অর্থনীতিতে মূলধনের যোগান, শাষণব্যবস্থায় আমলা, আদালতে বিচারক, বিদেশি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসারে শিক্ষক – এই সমস্ত জায়গায় উচ্চবর্ণের বাঙালীর যোগদান তাদের ক্ষমতার অঙ্গ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। ঔপনিবেশিক লুট যখন সারা বাংলার মানুষকে গরিব থেকে আরো গরিব বানাচ্ছে এই বাবুরা তখন ফুলে ফেঁপে উঠছে – আর তারাই তৈরি করছে আগামী শাসনব্যবস্থার কাঠামো ব্যবহারিক ও বৌদ্ধিক স্তরে। বঙ্কিমচন্দ্র এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর উদাহরণ। ভয়ঙ্কর বলার কারণ রয়েছে – এ নয় বঙ্কিম সম্পূর্ণ ইতিহাস উপেক্ষা করে গেছেন, কারণ তিনি যাকে বলে আমাদের পোস্ট-ট্রুথ যুগের মানুষ নন। বরং ইতিহাস স্বীকার করেই তিনি প্রথম যে আধুনিক জাতি পরিচয় তৈরি করতে চেয়েছেন তার বিষবৃক্ষের ফল আমাদের এখনকার উগ্র রাজনৈতিক হিন্দুত্ব। তিনি সরাসরি লিখছেন, ‘এক্ষণে ভারতবর্ষের সঙ্গে ইংরেজদিগের যা সম্বন্ধ, বাংলার সহিত আর্যদিগের সে সম্বন্ধ ছিল’ (বঙ্গে ব্রাহ্মণাধিকার) – এ কথা সরাসরি লিখে যে গর্বের ইতিহাস তিনি তৈরি চেয়েছেন তা আর্য গর্ব। এর পিছনে উদ্দেশ্য দুই – প্রথমত, নিজেদের শাসকের সঙ্গে একাসনে দেখা ও দ্বিতীয় অবশ্যই মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যকে পুনর্প্রতিষ্ঠা। বঙ্কিমের এই দর্শন এখানে উদাহরণ হিসেবে স্পষ্ট করে যে বাঙলায় ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতীয়তাবাদের পরীক্ষা শুরু হয়, বিবেকানন্দের হাত ধরে তা স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে বেড়ে ওঠে। এ তত্ত্ব নয়, বুঝতে বাকি থাকে না যখন দেখি দেশভাগ ও তার আগের যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেহারা এই বাংলায়। বিশ শতকের কয়েকটা ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায় যে বাঙালীর জাতি পরিচিতির সমস্যা এবং তার বিভ্রান্তি। একদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, তারপরেই আবার দাঙ্গা ও দেশভাগ, আবার তারপরেই ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। একশ বছরের মধ্যে এমন পরস্পর বিরোধী ঘটনা ঘটে কী করে? নাকি এ আসলে পরস্পর-বিরোধী নয় একটা অন্তঃশীলা ব্রাহ্মণ্য জাতীয়তাবাদ ও জাতিসত্ত্বার দ্বন্দ্ব, যা এতই নিজস্ব ও অন্তর্গত যে আমরা ঠাওর করতে পারি না।

বাঙালীর পরিচয় কি – এ এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। যেখানে ভারত রাষ্ট্র এন আর সি বা ন্যাশানাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনশিপ তৈরি করে একটা ভারতীয় নাগরিক পরিচয় তৈরি করতে চাইছে তাকে বুঝতে হবে। একটি দেশের নাগরিক কারা তার নিশ্চয়ই তালিকা বা পরিসংখ্যান বা নথী যাই হোক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এই তালিকার নামটা দেখলেই তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ জাগে – ন্যাশানাল কেন? তবে কী জাতিগত বিভিন্নতা মুছে ফেলাই এর উদ্দেশ্য? গোটা পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতে এই তালিকা একটা এমন টাইম বোম যা গৃহ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে। এই সমগ্র নিয়ে আলোচনা না করে বাঙালী পরিচয় নিয়ে কথা বললেই স্পষ্ট হয় বিষয়টা – বাঙালী জাতি হিসেবে দুই দেশে বিভক্ত বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গ। এর এক অংশ ভারতীয় নাগরিক অবশ্যই কিন্তু তার বাঙালী পরিচিতি বাদ দিয়ে নয়। সে বাদ দেওয়া অসম্ভব কারণ তা সম্ভব হলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হতো না। ফলে এই জাতিগত পরিচয় বাঙালীর নিজস্ব এবং সার্বভৌম। এই পরিচয় নিয়ে এত সমস্যা কেন একমাত্রিক হিন্দু ভারতীয় পরিচিতির প্রবক্তাদের? আরএসএস থেকে পূর্বতন কংগ্রেসে বহুবার চেষ্টা করেছে কখনো ধর্ম তো কখনো ভাষার মাধ্যমে সেই পরিচিতিকে বিলুপ্ত করে দিতে। এর পিছনের কারণ হল আজকের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্হানঅলারা সনাতন, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের উত্তরসূরি যারা এই বাংলায় বহুদিন ধরে চেষ্টা করে এসেছে নিজদের প্রভুত্ব কায়েম করতে। কখনো কিছুটা সফল হয়েছে কখনো আবার পিছিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু এ লড়াই থামেনি কখনোই।

এ শুনে অনেকে আশ্চর্য হতে পারেন, আমাদের ইতিহাসে এমন কথা কোথায় লেখা, কারণ আমাদের শিশুপাঠ্য ইতিহাস সে কথা বলে না। অথচ লিখিত ইতিহাস ও প্রাচীন সাহিত্য দর্শন ধর্ম সব কিছুর মধ্যেই রয়ে গেছে তা ছায়ার মতো। এই ছায়াটা খুঁজলে ইতিহাসের একটা অপর পাঠ সম্ভব। যে পাঠ চোখ খুলে দিতে পারে এই বহুদিনের চলে আসা সংঘর্ষ সম্পর্কে।

বাংলায় উচ্চবর্ণের ইতিহাস কতদিনের? বাঙালীকে আমরা আর্যজাতি ধরে নিয়ে ও তার মূল ভাষা আর্য ভাষা এমনটা ধরে নিয়ে যে শাসকের ইতিহাস লিখে চলেছি তা আসলে কতজন বাঙালীর ইতিহাস – এই জায়গা থেকে ভাবতে শুরু করলে অবাক করে দেবে। বাংলা ভাষার দিকেই তাকানো যাক, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখছেন যে এমনকি মহাভারতের রচনাকালেও (২০০ বি সি ই থেকে ২০০ সি ই) বাংলায় আর্যীকরণ তেমন হয়নি যদিও মহাভারতে এ দেশের উল্লেখ আছে। খৃষ্ট-জন্মের কয়েক শ’ বছর আগে ভৌগলিকভাবে গঙ্গা-পদ্মা শাখানদী উপনদীর প্রণালী ছিল অন্যরকম এবং তখনকার মূল বাসিন্দা পৌণ্ড্র, বঙ্গ, রাড়া ও শুমহ। এছাড়াও কৈর্বত, চণ্ডাল, ডোম ইত্যাদি জাতির মানুষেরা ছড়িয়ে ছিল গোটা ভূখণ্ডে। এছাড়া ছিল মন খামর ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। তাম্রলিপ্ত ছিল শুমহদের রাজধানী যাকে ডামালিপ্ত বা দামালিও বলা হয়েছে – হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে এই শব্দটা আসছে ‘ডামিলা’ বা ‘তামিল’ থেকে। বাংলা ভাষার উৎস চর্চা করেছেন যাঁরা তাদের লেখা থেকে এই তথ্য স্পষ্ট যে আর্যদের আগে থেকেই এখানে এক অনার্য বসবাস ছিল এবং সেই অনার্যরা অনুন্নত ছিল না যতই পরবর্তী আর্য বিজেতারা তা প্রমাণ করতে চাক না কেন। সুনীতিকুমার লিখেছেন যে খৃষ্টপূর্ব প্রথম হাজার বছরে তাদের সম্পর্কে কটু মন্তব্যের ভূরি ভুরি উদাহরণ থাকলেও তারা উন্নত জাত এবং কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্রতে তাদের রেশম বয়নে দক্ষতা, হাতি পালনের খ্যাতির কথা রয়েছে যা লুকনো যায়নি।

মৌর্যদের সময় আর্যীকরণ শুরু হয়, মগধের অধীনে আসে বাংলার একটা অংশ। এই সময় থেকেই ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি প্রভাব বাংলায় বাড়তে থাকে। সময়টা বেদ বিরোধিতার এটা মনে রাখতে হবে, কারণ রাজ-অনুগ্রহ বৌদ্ধ ধর্মের উপর ছিল। বাংলায় প্রাথমিক যে ধর্মের প্রভাব পড়ে তা বৌদ্ধদের। কাজেই আর্য জাতি ও তাদের অর্ধ-মাগধী ও প্রাকৃত ভাষার প্রচলন হল, কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে তা সত্ত্বেও বৈদিক সংস্কৃতি এখানে গেঁড়ে বসতে বসতে পারেনি। ভাষার মিশ্রণ হলেও সংস্কৃত ভাষা সম্পূর্ণ খেয়ে ফেলতে পারেনি তার কারণ বুদ্ধের ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্ম কোনো এক-ভাষী ধর্ম নয় এবং তার কোনো সেক্রেড ল্যাঙ্গুয়েজ নেই যথা বৈদিক বা খৃষ্টান ধর্মের মতো। বুদ্ধ সম্পর্কে মিথ তিনি যে মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন সেই মানুষটির ভাষাতেই বলতেন – এর থেকে বৌদ্ধ ধর্মের বহুসাংস্কৃতিক মুক্ত আদর্শের পরিচয় মেলে। তাই সে ধর্মের প্রসার সারা এশিয়া জুড়ে এত ব্যাপক হতে পেরেছিল এত কম সময়ে। কিন্তু এর মধ্যেই তার ভারতে পতনের বীজ কি ছিল? বৌদ্ধ শাস্ত্র সংস্কৃত ভাষাকে গ্রহণ করে এবং বাংলায় তাদের হাত ধরেই সংস্কৃত এসেছে তা সত্যি। তবু তারা কখনোই একমুখী ভাষা সংস্কৃতির ধারক ছিল না। যে বৌদ্ধ মঠবাসীরা সংস্কৃত চর্চা করেছে তারাই এই বাংলায় লিখেছে চর্যাপদ। এটা শুধু ভাষাগত প্রতিরোধ হিসেবে দেখলে চলবে না, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধও ঘটছে। মহাযানী বৌদ্ধ-মত এই ভূখণ্ডের আদি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে পরিচয় তার সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে তৈরি করেছে সহজযান। এবং সেই সহজযানী যে চর্যাপদ তাতে দেখি ব্রাহ্মণ ও বৈদিক ব্যবস্থার প্রতি তীব্র শ্লেষ।

আমরা আবার ফিরে যাই প্রাক বৌদ্ধ বাংলায় – সে বাংলা বৈদিক নয় কাজেই তার একটা নিজস্ব ধর্ম দর্শন ও সমাজব্যবস্থাও ছিল। এর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ না থাকলেও এটা বোঝা যায় যে সাংখ্য ও তন্ত্র এই দুয়ের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বাংলার আদি লৌকিক ধর্ম-বিশ্বাস। আমরা বৌদ্ধ তন্ত্র ও শাক্ত তন্ত্রের কথা বলি কিন্তু তন্ত্র এদের আগে স্বতন্ত্র এক অস্তিত্ব, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে এ প্রাচীন ফাটিলিটি কাল্ট ও মাতৃতান্ত্রিক বিশ্বাস যা হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতায়ও ছিল। এ বৈদিক আর্যদের হতে পারে না কারণ তারা পিতৃতান্ত্রিক (আধুনিক লিবেরাল ব্রাহ্মণ্যবাদীরা দুএকটি লাইন তুলে তার রচয়িতা মহিলা বলে দেখানোর চেষ্টা করলেও সে ধর্মের আচার সম্পূর্ণ পিতৃতান্ত্রিক)। এই লোকায়ত ধর্ম তা তন্ত্র না সাংখ্য এবং এর উৎপত্তি আলোচনার জায়গা নয় শুধু এ কথা উল্লেখ করা যেতে পারে কপিলের যে সাংখ্য তার প্রতি বৈদিকরা সদয় নয় এবং মনে করা হয় যে কপিলের দর্শনের উৎস এই বাংলা। মৌর্যযুগের পর গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ আগমন শুরু হলেও এবং তা প্রায় উপনিবেশ বসানোর মতো করে যেমনটা বঙ্কিম বলেছেন। অপর দিকে বৌদ্ধ-তন্ত্র মিলে যে প্রতিরোধ তা ছিল এই বাংলার নিজস্ব জনগোষ্ঠী প্রতিরোধ। রাজশক্তির আনুকূল্য ব্রাহ্মণ্যবাদ তখনো পায়নি, গুপ্তযুগের পর হর্ষবর্ধনের সময়ও তিনি একই সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষক হলেও ধর্মে বৌদ্ধ। কিন্তু দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদ আবার মাথা চাড়া দিচ্ছিল, যদিও বাংলায় পাল রাজাদের সময় পর্যন্ত বৌদ্ধরাই সংখ্যাগুরু। সেন রাজবংশ প্রথম বহিরাগত যারা বাংলায় জাতপাতের বাঁধন শক্ত করতে উদ্যোগী হয়। অর্থাৎ দ্বাদশ শতকে ব্রাহ্মণ্যবাদ বাংলায় প্রথম জাঁকিয়ে বসে, এবং তার চেহারাটা ইংরেজ আগমনের আগে পর্যন্ত একই রকম প্রায়।

ব্রাহ্মণদের এই সুযোগের আরেক কারণ মুসলিম আক্রমণ যা পূর্ব ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মকে মুছে ফেলে। হাজার হাজার মঠ ধ্বংস হয় ও ধর্মান্তরিত হয় যে বাঙালী তার সিংহভাগ ছিল বৌদ্ধ। এই সুযোগে ব্রাহ্মণ্যবাদ তার কঠোর জাতপাতের এবং বর্ণসংকর-বিরোধী নিয়মের ফলে নিজেকে টিকিয়ে রাখে। এবং ক্রমশ অধর্মান্তরিতরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের ছাতার তলায় আসে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন বাংলার যে কায়স্ত সম্প্রদায় তারা আগে বৌদ্ধ ছিল। এবং সে কারণে তাদের সংস্কৃত চর্চায় কোনো নিষেধ ছিল না। তাদের অর্থ বল ও সংখ্যার কারণে ব্রাহ্মণ্যবাদ তাকে নিজেদের অংশ করে নেয়। একথা জানার পর মনে হয় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাগুলো অমোঘ, ‘ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় বাঙলায় বহু জালজুয়াচুরি চলিয়াছিল, ঘটকঠাকুরেরা অনেক সত্যের গোপন করিয়াছেন, স্মার্ত নাটোর ও নদীয়ার ব্রাহ্মণ রাজাদের প্রভাবে…” ।

এই প্রভাব ক্রমশ বাঙলায় জাত কাঠামোকে শক্ত করে যা দাঁড়িয়ে রয়েছে আর্যদের শ্রেণী কাঠামোর উপর। সংস্কৃত ভাষা ও জাত এই দুই তার ভিত্তি। বাংলায় স্মৃতি ও নবন্যায়ের চর্চা যারা করত তারাই আবার সামাজিক বিধান দিত এবং প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি দিয়ে মারাত্মক শোষণ ও শাসন চালাত। প্রতিরোধ তবু মরেনি। আমরা দেখি যে বাংলায় ভক্তি ও সুফি একই সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ও ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। চৈতন্যর আন্দোলনকে দেখতে হবে কঠোর ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে। চৈতন্যের ধর্মে কীর্তন তার গুরুবাদ – এ বৌদ্ধ সহজিয়ার প্রভাব যা আজো বাংলার বাউলদের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। ব্রাহ্মণ্যবাদ একে নানা সময়ে নানা রকম হেনস্থা করেছে – এবং তাকে প্রান্তিক বলে প্রচার করেছে। খুব আশ্চর্যের ব্যাপার যে লৌকিক ধর্ম এ ভূখণ্ডের সিংহভাগ মানুষের তা প্রান্তিক আর বাকি মুষ্টিমেয়দেরটা কেন্দ্রীয়! এই কথাটা ঔপনিবেশিক বাঙালীও প্রচার করে গেছে এবং তা সত্যি বলে চালাতে সক্ষম হয়েছে। অথচ সে সময়ও তারা যদি সারা বাংলার মানুষের আচার দেখত শুধুমাত্র ক্ষমতাশালীর নয় তাহলে দেখত প্রান্তিক নয় বরং এগুলিই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অক্ষয়কুমার দত্তর ‘ভারবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ পড়ুন তাতে শুধু বাংলার সম্প্রদায়ের দিকে চোখ রাখলেই একথা স্পষ্ট হবে। ব্রাহ্মণ্যবাদের আত্যাচারের থেকে বাঁচতে নিম্নবর্ণের মানুষ ও মেয়েদের সেই সব সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্রয় নিতে হত। ব্রাহ্মণ্যবাদের কুলীন প্রথা থেকে শুরু করে হরেক মৌলবাদের বিরুদ্ধে যাদেরই আমরা দেখতে পাই তারা প্রত্যেকেই সংযুক্ত একটাই সূত্রে – তা হল লৌকিক ধর্ম। একে তাই বাঙালী জাতির নিজস্ব প্রতিরোধ বলে মনে হয়, এবং এর মধ্যে দিয়েই বাঙালীর জাতীয় পরিচয় আমরা পাই। এই লৌকিক ধর্মের প্রতিরোধ যে সবসময় সফল হয়েছে তা নয়, অনেক সময়ই তা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের খপ্পরে পড়েছে। চৈতন্যর ভক্তিধর্মই দেখা যাক। রূপ, সনাতন, শ্রীজীব গোস্বামীদের হাত ধরে তার আন্দোলন চলে যায় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে। সেই গৌড়ীয় দর্শনের ভাষা ও ভিত্তি সংস্কৃত এবং রাজধানী বৃন্দাবন। বলা বাহুল্য সব বাঙালী এ নেয়নি। কথিত আছে চৈতন্য চরিতামৃত বাংলায় লেখা হলে শ্রীজীব গোস্বামী রুষ্ট হন কারণ এতে তাঁদের সংস্কৃতে বৈষ্ণব ধর্ম চর্চার ক্ষতি হবে বলে মনে করেন। দেখা যাবে এই রূপ, সনাতন, শ্রীজীব আসছে ব্রাহ্মণ পশ্চাৎপট থেকে এবং তারা রাজকর্মচারী – তাদের ঝোঁক কোন দিকে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু বাংলার ভক্তি সাহিত্য তার তোয়াক্কা করেনি। সে বাংলা ভাষাতেই তার ধর্ম, দর্শন ও সমাজ জীবন নিয়ে কথা বলেছে, সেই দর্শন ঢুকে গেছে, মিশে গেছে বাউল ফকিরদের চর্চায় তাই বৈষ্ণব পদকর্তাদের ভিটে তাদের কাছে একেকটা তীর্থ।

দেশর মানুষ যখন এইভাবে প্রতিরোধ করে চলেছিল – জমিদার ও ভূস্বামীরা তত ব্রাহ্মণদের মৌলবাদী নিয়মকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে কারণ এই শ্রেণী তাদের শোষণের পক্ষে এবং তার অংশীদারও বটে। তাদের প্রশ্রয়ে ব্রাহ্মণ তার সনাতন বৈদিক বিশ্বাসকে ছেড়েছে – ঘরে নব ন্যায় পড়লেও পুজো করতে হয়েছে লৌকিক দেবদেবীকে যা অনার্যের। এবং এই আত্তীকরণ বা আত্মসাৎ করার একমাত্র কারণ – ক্ষমতা বিস্তার। একের পর এক পুরাণ লিখে মিলিয়ে মিলিয়ে আর্যীকরণ করতে হয়েছে দেবদেবীর – এ অর্থনৈতিক দায় – কারণ পুজোর অধিকার মানে সামাজিক অধিকার সেই অধিকার সবার হাতে থাকলে জাতের কাঠামো প্রতিষ্ঠা হয় না, আর তা নাহলে শোষণ চালানো যায় না। এর জন্য বিস্তর দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়েছে এ অহিংস পথে হয়নি। এর বিরুদ্ধে মানুষ অনেক সময় এককাট্টা হয়ে লড়েছেন তার উদাহরণ দিয়েছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ধর্ম ঠাকুরের ছড়ায়, যেখানে বলা হয়েছে ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ধর্ম ঠাকুরকে ডাকে ও তিনি মুসলমানের বেশে এসে তাদের শায়েস্তা করেন। এর থেকে স্পষ্ট যে ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এদের মুসলমা,ন যারা কিনা দেশের মসনদে, তাদের সাহায্য পর্যন্ত নিতে হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদ ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছে সব সময়। কারণ তার চেহারাই অসাম্যের এবং অগণতন্ত্রের। তবুও বাংলায় যে প্রতিরোধ তাকে শেষ করতে তারা পারেনি উনিশ শতক পর্যন্ত। উনিশ শতকের বিদেশি ঔপনিবেশিক পুঁজির দালাল হিসেবে এই শ্রেণী সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত জায়গায় একচেটিয়া দখল কায়েম করে। আর গ্রাম বাংলা, স্বাধীন বাংলাও ভাঙতে থাকে নগরায়ণের ফলে। এই দুইয়ের সুবিধে নিয়ে সে প্রথমত নিজেদের দখল সম্পূর্ণ করল দ্বিতীয়ত লিখল ইতিহাস যা বিজয়ীর। তাই যখনই বাংলা সাহিত্য বা সমাজের ইতিহাস পড়ি সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বা সুকুমার সেনের দেখি লৌকিক বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তাদের বিশেষণ কেমন চোখা আক্রমণের। ‘অশ্লীল’, ‘গ্রাম্য’, ‘অপরিশীলিত’ ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দ থেকে এদের ঝোঁকটা বোঝা যায়। তাই বঙ্কিমচন্দ্র সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ থেকে ফকিরদের বাদ দেন স্বচ্ছন্দে ঐতিহাসিক উপন্যাস থেকে। এটা ঠাণ্ডা মাথায় চলা একটা প্রোগ্রম।

এটা ব্রাহ্মণ্যবাদের পুরনো কায়দা, বৌদ্ধ ও তন্ত্রর সম্পর্কেও ঠিক একই ভাবে রটনা ও গুজবের মাধ্যমে মানুষের কাছে তার একটা খারাপ ছবি তুলে ধরেছে, ঠিক যে কায়দায় তারা বৈষ্ণব বা শাক্ত মরমিয়াদের সম্পর্কে রটাত – অন্তত যতদিন না তাকে নিজেদের ছাতার তলায় আনতে পারছে। এবং অবশ্যই ক্ষমতা কোনদিকে সেটা বুঝে নিজেদের বদলে নেওয়া।

বৌদ্ধরা রাজ অনুগ্রহ পেলেও এটা মাথায় রাখতে হবে তারা রাজাকে দেবতা মনে করত না, তাদের যে সৃষ্টি তত্ত্ব যা মহাবস্তুতে পাওয়া যায় তার থেকে সে নির্বাচিত প্রতিনিধিমাত্র এবং ‘তুমি তো দেশের লোকের দাস। ফসলের ছয়ভাগের এক ভাগ মাহিনাই তোমার জীবিকা। তুমি আবার গুমর কর কী?’ এই যাদের আদর্শ তাদের গণতান্ত্রিক বলতেই হবে। এবং এই কারণেই আমরা দেখি এই বাংলায় রাজা নির্বাচিত হতে পেরেছে মধ্যযুগেও। পাল বংশ যা কি না বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী তার প্রথম রাজা দেশের মানুষের নির্বাচিত এর থেকে একটা গণতান্ত্রিক ঝোঁক বোঝা যায়, আধুনিক গণতন্ত্রের সঙ্গে তার মিল আছে বলছি না কিন্তু কেন্দ্রিকতার ঝোঁক কম।

অথচ এই কেন্দ্রিকতা, কৌলীন্য প্রথার হাত ধরে বাংলা ভূখণ্ডে জাঁকিয়ে বসে এবং ঔপনিবেশিক কালের বাবু সম্প্রদায় তা সম্পূর্ণ করে। ডিরোজিয়ানদের বাদ দিয়ে ও ঈশ্বরচন্দ্রর মতো কিছু মানুষের কাজকে চেপে দিয়ে – যে জিনিস রেনেসাঁ বলে চালানো হল – তা একেবারেই ওই ব্রাহ্মণ্য কাঠামোর সমর্থক। সেই জন্যই দেখা যায় এই বাংলায় বসেও হিন্দি ভাষার সমর্থনে সুনীতিকুমারের মতো একজনকে পাওয়া যায় – একদেশ, একভাষা তারা নিজেদের জাতিসত্ত্বার সর্বনাশ করেও করতে চান কারণ আদপে তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী। শুধু হিন্দি কেন, একটা মান্য বাংলা বলে যে ভাষা তৈরি হল তা এতদিনের যে গোটা বাংলার ভাষাগত বৈচিত্র তাকে সরিয়ে দিতে। শিক্ষিত যে ভাষা তৈরি হল ইংরেজ শিক্ষার কলে তা প্রথম থেকেই বিভাজনমূলক। সে শ্রেণীতে শ্রেণীতে হোক বা জাতের মধ্যে বা ধর্ম বা আঞ্চলিকতার। এ ভাষা একেবারেই উচ্চবর্ণের স্বার্থরক্ষায় তৈরি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই কথাটাই লিখেছিলেন, ব্রাহ্মণরা যে টিঁকে গেল এত বছর ধরে বৌদ্ধ, মুসলিম, ইংরেজদের পদানত থাকা সত্ত্বেও তার কারণ তারা নিজের জাতি-স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই দেখে না। বাঙালী জাতিসত্ত্বার সর্বনাশ যে তাই তারা করতে চাইবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই – কারণ দেখাই যাচ্ছে সে সত্ত্বা ব্রাহ্মণ্যবিরোধী, প্রাক আর্য।

স্বাধীনতার পর এই আক্রমণ আরো প্রকট হয় কারণ দেশের ক্ষমতা এখন ব্রাহ্মণ্য শ্রেণীর হাতে। দেশে গণতন্ত্র এলেও উচ্চবর্ণের ক্ষমতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বাংলায়ও একই জিনিস ঘটছে। এ বিপদের, কারণ এখনকার ব্রাহ্মণ্যবাদীরা দেশ ভাগের জুজু দেখিয়ে বাংলার মানুষ যাদের কিছু শতাংশ বাদ দিলে উচ্চ বর্ণ নয় তাদেরকেও লড়িয়ে দিচ্ছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এ লড়িয়ে দেওয়ায় এই মনুবাদী ও পুঁজিবাদীর লাভ।

আমাদের সৌভাগ্য যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা তাদের জাতিসত্তার জন্য লড়েছিলেন। এটার কারণ বোধহয় যখন দেশভাগ হয় তখন ওই উচ্চবর্ণের বাঙালী, যারা ক্ষমতার পা চাটে, তখনই তারা এ পারে সরে পরেছিল। ফলে সত্যিকারের নিম্ন বর্ণ বা নিম্ন শ্রেণীর মানুষের জোট হতে পেরেছিল। একেও ওই আর্য মুসলমানি বিদেশীর বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। ওই পাঠান, বা পাঞ্জাবী জাতির বহিরাগতরা আমাদের দেশের সংস্কৃতির উপর থাবা গেড়ে বসে তাকে ধ্বংস করবে এটা মেনে নেননি তাঁরা। এবং মানেনি পুঁজির সঙ্গে তার আঁতাত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সে দেশের বামপন্থীদের অবদানের কথা না বলে ওই মুসলিম লিগ ফেরত মুজিবর রহমানকে নায়ক বানানো হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা এশিয়ার মুক্তি সূর্য বাংলাদেশ স্বাধীন করেননি করেছেন সাধারণ বাঙালী তাঁদের রক্ত দিয়ে। এখনো সেদেশে লড়াই চলছে। তবুও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ না হলে এ বাংলার অস্তিত্বই আর থাকত কি না সন্দেহ আছে। দ্রাবিড়দের লড়াই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এই সব জাতিসত্ত্বার আন্দোলন না থাকলে, নকশাল আন্দোলনের জোতদার-পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াই না থাকলে একমাত্রিক হিন্দুস্থান আমাদের উপর চেপে বসত।

হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদেরই আরেক চেহারা, কাজেই তার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে বহুজাতিক ভারতের আদর্শর জন্য লড়তে হবে এবং তা প্রত্যেক জাতির সমান অধিকারের মধ্যে দিয়েই হতে পারে। তার জন্য বাঙালীকে নিজের জাতি সত্ত্বা সম্পর্কে ওয়াকিফ-হাল হতে হবে। এ লড়াইয়ে বাঙালীর শত্রু মুষ্টিমেয় বাঙালী, তারাই বিদেশি পুঁজি আর হিন্দু-জাতীয়তাবাদের দালালী করে, যেমন সেই সিরাজদৌলার আমল থেকে সিপাই বিদ্রোহ সবসময়েই এরা তাই করেছে। আমি নিজে দেখেছি আমার এক আত্মীয় যে মারোয়াড়ির চাকরি করে রিটায়ার করে হিন্দুত্ববাদীদের দালালি করছে, ঘৃণা ছড়াচ্ছে বাঙালী, মুসলমান ও নিম্নবর্গের বিরুদ্ধে। কাজেই লড়াই বাইরের শত্রু এবং ঘরের শত্রুদের সঙ্গে। এর জন্য বাঙলায় স্বীকার করতে হবে ব্রাহ্মণদের ওত্যাচার রয়েছে, জাত রয়েছে এবং তা বাঙালী সত্ত্বার পরিচয়ের বিরোধী। যদি মুসলমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায় তাহলে বলতে হবে তা বাঙালী পরিচয়ের বিরোধী। এবং তা বলতে হবে জোর গলায় ও একদম ঘণিষ্ঠ মহলেও যেখানে এগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং অনেকসময়ই বর্ণবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়।

সামনের দিনগুলো বাঙালীর জন্য ভয়ঙ্কর এই দেশে। বাঙালীর নিজস্ব পরিচিতি যদি একে প্রতিরোধ না করতে পারে তো বাঙালী বিলুপ্ত হয়ে যাবে আগামী দিনে। এই ভয়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিরোধ কী করব না আমরা?




[লেখক – সাংবাদিক, কবি, গদ্যকার – এমন নানা পরিচয়ের মধ্যে ঘুরতে ফিরতে থাকা একজন। গত দশ বছরে পেশাদার সাংবাদিকতা ছেড়ে নানা কাজের ফন্দি ফিকিরে মধ্যেও লিখে যাচ্ছেন। প্রকাশিত হয়েছে দুটি  কবিতার বই – ‘জাদুকরি বইঘর’ (২০১৪), ‘আদার ব্যাপারী যাবে আর্মেনী ঘাটে’ (২০১৬); ছোট গল্পের বই – ‘জেরি ইঁদুরের গর্ত থেকে’ (২০১৮)। অ্যান্থোলজিতে লেখা – ‘শূন্য দশকের গল্প সংগ্রহ’ (২০১৪), ‘কবিতা: পথ ও প্রান্তর’ (২০১৭)]     

Facebook Comments

Leave a Reply