গল্প : সোমনাথ ঘোষাল

দুই শালিক



গ্লাসের কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেল। চিমনি দিয়ে আর কোনওদিন ধোঁয়া বেড়োবে না। একটা ভ্যানে বসে সুবীর ভাবছে । এই কারখানারই শ্রমিক ছিল সুবীর। টাকাও ছিল। বউ সংসার নিয়ে টেনেটুনে সংসারটাও চলে যেত। মাসে দুটো সিনেমা। সপ্তাহে মাংস। একটু এদিক ওদিক ঘুরেও চলে যেত। সুবীর বাঁহাতে খুব কষ্ট করে বিড়িটা টানতে থাকে। পার্কসার্কাসের ব্যবস্থা ফেলে এই এলাকা। রাস্তা ঘর যেন সবই এক। গলি ঘুপচি দিয়ে এগিয়ে গেলে, বাসনের শব্দ। ভাতের গন্ধ। কাঁচা মাংস। পায়খানা। বমি। মদ। নেশা। জামা কাপড়। সুবীরের আর ভালো লাগেনা। চোখে জল আসে। বিড়িটা ফেলে আবার বিড়ি ধরায়। পাশের দোকানের দড়ির আগুন থেকে। বাঁ হাতটাও যেন শরীর থেকে বনধ্ ঘোষণা করেছে।
একটা জটলা। অনেক চেনা অচেনা মুখ। কীভাবে যেন বলছে। শ্লোগান। একটা বিকট শব্দ। আসলে সুবীর এখনও ইছামতীর আলপথ ধরেই খেজুর গাছের তলায় ছোট্ট সুবীরকেই দেখতে পায়। মাটির বাড়ি। বাবা মা ভাই বোন। সুবীর সাইকেল করে পিঠে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে আসে। আজ শনিবার হাফ বেলা স্কুল। মাছের ঝোল ভাত আর তরকারি রেখেছে মা। দাওয়াতে বসে কোনও রকমে গব গব করে খেয়ে সোজা ইছামতীর আলে। মাছ ধরা চলছে। বুড়ো থেকে বাচ্চা। যেখানে ইছামতীর জল মাটি ছুঁয়ে গেছে। ঘাসের মাথা দেখা যায়। তার ওপর রোদ পড়লেই দেখা মেলে ছোট বড় মাছ। যেন ইছামতী থেকে একটু জল নিয়ে কোমরজলের পুকুর করে নিয়েছে। বিভিন্ন রঙের ফড়িং বসতে থাকে ফাতনায়। ছোট ছিপে পুঁটি, ছোট তেলাপিয়া আর বাটা ছাড়া আর কিছুই ওঠে না। বর্ষায় সব ভরে যায়। যখন আকাশ শরতের জামা পরে তখন থেকে গ্রীষ্ম অবধি এই ইছামতীর জল নিয়ে সুবীরের কোমরজলের পুকুর।
সুবীরের বাবা রেশনের দোকানে কাজ করে। মা তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে সংসার সামলায়। টালির চালে কুমড়ো, ধুধুল বড় হতে থাকে। তুলসীতলায় মায়ের শাঁখের আওয়াজে সুবীর আলপথ ধরে সোজা বাড়ি। পড়তে বসতে হবে। হ্যারিকেন জ্বেলে। বোন খুব ছোট। তারপর ভাই। সুবীর ক্লাস নাইন।
হঠাৎই তাস খেলা নিয়ে খিস্তিখেউড় শুরু হয়। সুবীর বাস্তবে ফেরে। কোনরকমে। ক্লাব থেকে পাওয়া হুইলচেয়ারে বসে। ডান পা-টা নেই। বাঁ হাতে বিশেষ কাজ করতে পারে না। অতএব বাঁ পা আর ডান হাতের ওপর সুবীরের কালো মাঝারি শরীরটা চলে যাচ্ছে।
একদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে কারখানার নেতাদের ডাকে সুবীর হাজির হয়। এদিকে তখন তিন মাস মাইনে নেই। সংসার চলছে না। কাকলী অর্থাৎ সুবীরের বউ তিন বাড়ির কাজ ধরেছে। একটাই ছেলে ক্লাসফোরে পড়ে। সুবীর ভেবেছিল সেইদিন কিছু টাকা পাবে। অনেক জটলা। কিন্তু ওই চেনা সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতোই। অনেকগুলো বিকট শব্দ। কয়েকজন মারা গেল। সুবীর রক্তমাখা অবস্থায় মাটিতে কাতরাতে থাকে। কিছুদিন পর জানতে পারে, একটা পা নেই। বাঁ হাতটাও অকেজো।
প্রায় এক বছর পর কারখানা আবার খোলে। সুবীর কিছু টাকাও পায়। কিন্তু কাজটা আর থাকে না। এলাকার কিছু দাদাদের কথায় চা বিড়ি সিগারেটের গুমটি খোলে। কিছুদিন যা দু পয়সা আসতো। আর কাকলীর টাকায় সংসার। এখন এই গ্লাসের কারখানা বন্ধ হওয়ার পর থেকে গুমটিও আর চলে না। কিন্তু সুবীর রোজ এই অস্থায়ী গুমটিতে বসে। অল্প চা বানায়। বিড়ি খায় । আর বন্ধ কারখানা থেকে বাড়তে থাকা গাছেদের হিসেব রাখে। অনেক পাখি এখন এই নিশ্চুপ কারখানায়। নতুন কোন পাখি এলে সুবীর আনন্দ পায়। গাছেদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সুবীর কখন যেন ইছামতীর গল্পে ফিরে আসে। সুবীরের বাবা মারা যাওয়ার পরই সংসারের চাপে সুবীরের আর পড়াশোনা হয় না। বোনের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। আর ভাই মামার বাড়ির দোকানে কাজে লেগে পরে। মায়ের দেহটা একদিন পুকুর ঘাটে ভেসে ওঠে। গ্রামের লোকেরা অনেক গল্প বানিয়েছিল। কিন্তু সুবীর কোনদিন উওর পায়নি।
গ্রামের এক মাস্টারের যোগাযোগে কলকাতায় চাকরি তারপর বিয়ে, বাচ্চা। কিন্তু সুবীর এখনও ইছামতীতেই আছে। সেই জলধরা পুকুরের ফড়িংগুলোর সঙ্গে। এখনও মাঝে মাঝে পকেটে হাত দিয়ে ফেলে, কাঁচের গুলিগুলো আছে কী না !
সন্ধ্যে হয়। সুবীর বাড়ি ফেরে। কাকলী রান্না করছে। ছেলেটা বই পড়ছে। ঘরে একটাই আলো। পাশের বাড়ি থেকে টিভির শব্দ আসছে।
কাকলী : সারাদিন কারখানার দিকে হাঁ করে থাকলে তো আর পেট ভরবে না। আমি আর কতদিন এইভাবে টানবো? কিছু তো করতে পারো! না হলে ভিক্ষে করলেও তো কিছু টাকা আসে !
সুবীর : চুপ করে বসে থাকে ছেলেটার পাশে। বলে, একটু কিছু খাবার দেবে? খুব খিদে পেয়েছে।
কাকলী : লজ্জা করে না খেতে চাইছো !
সুবীর : উওর দেয় না ।

রাতের খাওয়া শেষ হয়। কাকলী ভোরে বেড়িয়ে যাবে। অনেকদিন হল ছেলেটারও আর স্কুল যাওয়া হয় না। কাকলী সঙ্গে করে নিয়ে যায় কাজের বাড়িতে।

দিনদুয়েক হল সুবীরের জ্বর। বাড়িতেই শুয়ে আছে। কাকলী ফিরলে খাবার পায়। না হলে, পাশের বাড়ি থেকে কখনও কখনও খাবার দিয়ে যায়। রাতে কাকলী ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। দত্তবাড়ি থেকে মাংস দিয়েছে। তিনজনের হয়ে যাবে। ছেলেটাকে খাইয়ে শুয়ে দেয়। কাকলী বলে, দত্তবাড়িতে রাতদিনের কাজ পেয়েছে। সাত হাজার টাকা মাইনে। শুধু রবিবার করেই বাড়িতে আসতে পারবে। ছেলেটাও ঐ বাড়িতেই থাকবে। দাদা বলেছে, আবার স্কুলে ভর্তি করে দেবে। সুবীর কোন উওর দেয় না। খালি বলে, খুব ভালো ! সুবীর ছেলের পাশে খাটে শুয়ে পড়ে। কাকলী মাটিতে। সুবীর কাকলীর গায়ে হাত বোলাতে থাকে। কাকলী ঘুমোচ্ছে। সুবীর বাঁ পায়ে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে মাটিতে নেমে আসে। কাকলীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে চায়। কাকলীর শরীরের ওপর শুয়ে কাঁপতে থাকে সুবীর। কিছুই করতে পারে না। এই অর্দ্ধেক শরীর নিয়ে কীভাবে আগের মতো আদর করবে কাকলীকে! ঘুমের ঘোরে উওর দেয় কাকলী। বলে, এই সব কোরো না। রাতদুপুরে দিনের পর দিন এইসব ন্যাকামো ভালো লাগে না। সুবীর কোনরকমে খাটে উঠে শুয়ে পড়ে।

কাকলী সকালে ছেলেকে নিয়ে চলে যায়। বলে, সামনের সপ্তাহে আসবে। আর সময়মতো খাবার পাঠিয়ে দেবে। কাকলীকে সুন্দর দেখতে। ছেলেটাও ঠিক মায়ের মতন। আর এইভাবে কী বেঁচে থাকা যায় আমার সঙ্গে! আমি তো আধখানা একটা মানুষ। বাতিল টাকা। যেটা দিয়ে কিছুই কেনা যায় না। আর ছেলেটাকেও তো বড় করতে হবে। মায়ের হিসেবে একদমই ভালো কাজ করেছে কাকলী। সুবীর চা বানিয়ে, বিড়িটা স্টোভ থেকে ধরিয়ে নেয়। সুবীর কোনরকমে ভাতেভাত করতে পারে। শুধু পাশের বাড়ি থেকে আলু পটলটা কেটে দেয়। আর যেদিন কেউ আর কেটে দেয় না, সেদিন খোসা সমেত ভাতে দিয়ে দেয়। কখনও কখনও ভাতে আবার ডিমও থাকে। এক সপ্তাহ হয়ে গেল কাকলী আসেনি। খবর পাঠিয়েছে, বাড়িতে অনেক লোকজন। তাই খুব কাজের চাপ। সুবীর নিজের মতন খেয়ে দেয়ে সময়কাটিয়ে নেয়। পাশের বাড়ি থেকে কখনও কখনও খবরের কাগজ পায়। না হলে পুরোনো কাগজ পড়তে থাকে।
বিকেল হতে না হতেই কারখানার সামনে চলে যায় হুইলচেয়ার নিয়ে। এখন আর গুমটিটা খোলে না। বাড়তে থাকা গাছগাছালির দিকে তাকিয়ে আর পাখিদের ডাক শুনে ঘড়ির কাঁটা সরতে থাকে।

এখন দুদিন হল বাড়িতে দুটো নতুন অতিথি এসেছে। তাদেরকেও সঙ্গে আনে। কিছুদিন আগে অনেকগুলো কাক মিলে দুটো শালিক পাখির বাচ্চাকে, কারখানার গেটের সামনে প্রায় ঠুকরে ঠুকরে মেরেই ফেলছিল। সেই দুজনকে বাঁচিয়ে সুবীর এখন নিজের কাছেই রেখেছে। কাকলী আর ছেলে না থাকাটা সুবীরের এখন আর খারাপ লাগে না। ভালোই আছে সুবীর। কাকলী অনেকদিন ছেলেটাকে নিয়ে আসেনি। তাই এই নতুন বন্ধুদের খবর জানে না। সুবীর শালিক দুটোকে ছাতু খাওয়ায়। জল মুড়ি খাওয়ায়। নিজের ঘরে ছেড়েই রাখে। সুবীরের কাছ থেকে ওরা উড়েও যায় না, সঙ্গে সঙ্গে থাকে। শালিক দুটোর সঙ্গে গল্প করেই দিন কাটতে থাকে, যেন ইছামতীতে শৈশব ফিরে এসেছে।

কাকলী এখন ড্রাইভারের হাত দিয়ে খাবার পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। কতদিন আর পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে চেয়ে খাওয়া যায়। যেটুকু টাকা ছিল, সেটাও তলানিতে। একদিন সকালে সুবীর দেখে শালিক দুটো গায়ে চুপ করে বসে আছে। এখন তিনটে পেট। কীভাবে চলবে বুঝতে পারেনা সুবীর। ঠিক করে শালিক দুটোকে পিঠে বসিয়ে হুইল চেয়ারে বেড়িয়ে পড়বে কলকাতার রাস্তায়। যদি কেউ কিছু দেয়। এই ব্যস্ত কলকাতা সুবীরের কাছে খুব অচেনা। অনেকদিন এই শহরের রাস্তাঘাট দেখেনি। তবুও সুবীর ভয় পায়না। শালিক দুটোকে গায়ে বসিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। কোথাও গিয়ে একটু দাঁড়ায়। আবার কোথাও এগিয়ে যায়। এই দৃশ্য দেখে কৌতূহলী মানুষগুলো ছবি তোলে। কথা বলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে। সেলফিও তোলে। সুবীর ঠিক করে এভাবেও বেঁচে থাকা যাবে বাকি জীবনটা। তাই রোজ বিকেলে নন্দনের বাইরের ফুটপাতে প্লাসটিক আর চাদর পেতে শুয়ে থাকে সুবীর। আর শালিক দুটো গায়ে চুপ করে বসে থাকে। কখনও কখনও পালক ঝেড়ে নেয় আবার কখনও পথচলতি মানুষ দেখে ডেকে ওঠে। মানুষগুলো তখন ছবি, সেলফি, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে ব্যস্ত। সুবীর তখনও উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। টাকা পয়সা পড়তে থাকে। এতে ভাত, ডাল, ডিম, মুড়ি হয়ে যাবে সঙ্গে বন্ধুত্ব।

Facebook Comments

Posted in: April 2019, Story

Tagged as: ,

2 thoughts on “গল্প : সোমনাথ ঘোষাল Leave a comment

Leave a Reply