জাতীয়তাবাদ ও শাস্ত্রীয় নৃত্য – সোমা দত্ত

নাট্যশাস্ত্র প্রসঙ্গ :

 ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য বিষয়ে কথা বলতে গেলে নাট্যশাস্ত্রের আলোচনায় আসতেই হবে কারণ শাস্ত্রীয় নৃত্য হয়ে ওঠার প্রধানতম যোগ্যতা হল সেই নৃত্যশৈলী নাট্যশাস্ত্র অনুসারী হওয়া। নাট্যশাস্ত্র, এক দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে ধারাবাহিকভাবে বহমান নাট্যধারার সংকলিত পাঠ। ভরত মুনি শিষ্যগণকে  নাট্যশাস্ত্র বা নাট্যবেদের উৎপত্তি সম্বন্ধে বলছেন। বলছেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা কেন নাট্যবেদ সৃষ্টি করছেন। ইন্দ্র সহ দেবগণ ব্রহ্মার কাছে দরবার করছেন এমন একটি বেদ সৃষ্টি করার জন্য যা দৃশ্য ও শ্রাব্য এবং সকল বর্ণের উপযোগী, যেহেতু বেদচর্চার অধিকার শূদ্রদের নেই। অতঃপর ব্রহ্মা ঋক্‌বেদ থেকে পাঠ্য বস্তু, সামবেদ থেকে গান, যজুর্বেদ থেকে অভিনয় ও অথর্ব বেদ থেকে রসসমূহ নিয়ে এবং উপবেদ (আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ব বেদ ও স্থাপত্য) থেকে উপাদান নিয়ে সৃষ্টি করলেন নাট্যবেদ। যা ধর্ম অর্থ ও যশোলাভের উপায় ও পরম্পরাগত নীতির সংগ্রহ, ভবিষ্যতের মানুষের সকল কর্মের পথপ্রদর্শক। এই হল নাট্যশাস্ত্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে এর প্রথম অধ্যায়ের ভাষ্য। বেদ অনুসারে সৃষ্টিকর্তা যেহেতু ব্রহ্মা তাই নাট্যেরও সৃষ্টি তিনিই করলেন সুতরাং এটি শাস্ত্র, এর বিধিনিষেধ নিয়ম অনুযায়ী নাট্যের প্রয়োগ হবে এবং মনুষ্যগণের একে মান্য করা অবশ্যকর্তব্য।

নিয়মনীতি বিধিনিষেধ প্রয়োগ করতে হবে কেন? কি সুবিধে তার? এর আগেই অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র প্রভৃতির প্রয়োগ হয়েছে শাসনের সুবিধার্থে। তাহলে কি শুধু এসব দিয়ে চলছিল না আর? সুচারুভাবে মননে, মস্তিষ্কে নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল? দেবতা দানব গন্ধর্ব যক্ষ রাক্ষস উরগ সমস্ত গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈদিক অনুশাসন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নমনীয় কিন্তু শক্তিশালী মাধ্যম নাট্য ছাড়া আর কি হতে পারে? বিশাল বড় কোনো ক্ষেত্রকে একই শাসনের আওতায় আনতে হলে তার নিত্য নতুন পদ্ধতিও আবিষ্কার করা প্রয়োজন।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য:   

ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্য এখনো পর্যন্ত আটটি—ভারতনাট্যম (তামিলনাড়ু), কথাকলি (কেরালা), কথক (উত্তর প্রদেশ-জয়পুর), কুচিপুড়ি (অন্ধ্রপ্রদেশ), মনিপুরী (মণিপুর), ওড়িশি (ওড়িশা), সত্রীয় (আসাম), মোহিনীয়াট্যম (কেরালা)। এ সংখ্যা বাড়তে পারে ভবিষ্যতে কারণ আরো নানান রাজ্য থেকে আবেদন জমা আছে ভারত সরকার পরিচালিত সংস্থা ‘সংগীত নাটক একাডেমী’-এর দপ্তরে। হ্যাঁ, এই দপ্তর থেকেই শাস্ত্রীয় নৃত্য হওয়ার স্বীকৃতিপত্র পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৫২ সালে ৩১শে মে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় সরকার অধীনস্থ এই সংস্থাটি। এখনো পর্যন্ত সর্বাপেক্ষা নবীন তালিকাভুক্ত নৃত্য—সত্রীয় (২০০০ সাল) এবং মোহিনীয়াট্যম (২০১৩ সাল)। ছৌ নৃত্য নিয়ে ধন্দ রয়েছে, ভারতীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক সুপারিশ করলেও এখনো ‘সংগীত নাটক একাডেমী’-এর ছাড়পত্র পায়নি ছৌ (সেরাইকেলা, ময়ূরভঞ্জ, পুরুলিয়া)। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে যোগ রয়েছে (গুরু শিষ্য পরম্পরা ও এর অন্তর্গত), নাট্যশাস্ত্র অনুসারী এমন নৃত্যধারাকে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের সুপারিশে শাস্ত্রীয় নৃত্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। 

প্রতিটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের আঙ্গিক এক একটির থেকে দৃশ্যত আলাদা। কথাকলি ও ওড়িশি, অথবা ধরুন ভারতনাট্যম ও মনিপুরী, একটি দক্ষিণ ভারতের একটি পূর্বের। দু’টির আঙ্গিক প্রকরণে পার্থক্য আছে কারণ দু’টি পৃথক অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য বহন করছে। আবার মনিপুরী ও ওড়িশি পূর্ব অঞ্চলের হলেও কত তফাৎ, কারণ দুটি পৃথক গোষ্ঠীর মানুষের বৈশিষ্ট্য বহন করছে। তাদের ভাষা আলাদা ধর্ম আলাদা, রীতি নীতি আচার ব্যবহার সমস্ত আলাদা। এও একপ্রকার আগ্রাসন, সমস্ত গোষ্ঠীর উপর প্রভাবশালী ধর্মীয় গোষ্ঠীর অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। শাসনের সুবিধার্থে। তাই নৃত্যের কাঠামো তৈরি হয়েছে, সেই অঞ্চলগুলির আদিবাসী ও লোকনৃত্য ধারার প্রকরণ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে। কিন্তু প্রত্যেকটি নাচের বিষয় এক। দশাবতার, রাধাকৃষ্ণ লীলা, পৌরাণিক কাহিনী। প্রতিটি নৃত্য আদিতে জুড়ে আছে নাট্যশাস্ত্রের সাথে, অর্থাৎ সেই বৈদিক সংস্কৃতির সাথে, এটা প্রমাণ করতেই এই ব্যবস্থা। 

ঔপনিবেশিক ভারতে নৃত্যচর্চা:     

ব্রিটিশ ভারতে উপনিবেশ গড়ার আগে মোঘল সাম্রাজ্যে এক বিশাল অঞ্চল তাদের শাসনের আওতায় এসেছিল। তাছাড়াও ছিল ছোট ছোট অঞ্চলের ছোট রাজা ও ভূস্বামীরা। এই সময় নৃত্য ক্ষেত্রে সবচেয়ে মূল্যবান যোগদান হল কথক নৃত্য। কথকের গল্প বলাকে আরো আকর্ষণীয় করতে চলন, ভাব আঙ্গিক প্রকরণ যোগ করতে করতে যে যাত্রা শুরু তা নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায়, ইরানী নৃত্যশিল্পীদের দ্বারা যুক্ত হওয়া আঙ্গিক প্রকরণের দ্বারা নতুন রূপ পেল। পরবর্তীকালে ওয়াজেদ আলী শাহের দরবারে পরিপূর্ণ শিল্প হয়ে উঠল। শিল্পবোধ খুব দুর্লভ এক বিষয়। সবার তা থাকেনা, ফলে শিল্পের আবেদন ইন্দ্রিয়ভোগ ও বিলাসিতায় পর্যবসিত হয়—এমনি অবস্থা এসে দাঁড়ায় গোটা উত্তর পশ্চিম পূর্ব মধ্য ভারত জুড়ে। বাঈজী আর নাচনী, এদের মধ্যেই একপ্রকার আটকে পরল নৃত্যশিল্প। দক্ষিণ অংশে চলছিল রাজার দরবারে নৃত্যের পাশাপাশি অন্য এক ধারা। দেবদাসী প্রথা। পূর্বে ওড়িশাতেও এই প্রথার প্রচলন ছিল। দেবতার দাসী এবং ব্রাহ্মণেরও। মন্দির তো ব্রাহ্মণের, আর মন্দিরের পৃষ্ঠপোষক রাজা বা ধনী ব্যক্তিবর্গ।

এই অবস্থারও পরিবর্তন হল। ব্রিটিশ এই প্রথাকে ভালভাবে গ্রহণ করেনি এবং তৎকালীন শিক্ষিত সমাজের মানুষও এই প্রথার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। ফলত ব্রিটিশ সরকারও এই প্রথা রদ করার জন্য আইনি পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, যা ১৯৩০ সালে মুত্থুলক্সমি রেড্ডির তৎপরতায় মাদ্রাজ আইন সভায় পুত্তু বা পোত্তু (নির্দিষ্ট দেবতার উদ্দেশ্যে কোনো বালিকাকে উৎসর্গ করা) প্রথা রদ করা হয়। কুপ্রথা থেকে শিল্পকে ছেঁকে নিয়ে এবার তার যাত্রা শুরু হল। এ যাত্রাতেও কিন্তু শুধুমাত্র শিল্পী বা শিল্পমনস্ক মানুষ জুড়ে রইলেন এমনটা নয়। জুড়লেন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও।

স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদ :

সারাদেশ তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল,মূলত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে চলছে জাতীয়তাবাদের মহড়া। ১৯২৭ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে সারা ভারত সংগীত সম্মেলন হয় মাদ্রাজে, যেখান থেকেই মাদ্রাজ মিউজিক একাডেমী স্থাপনের ঘোষণা করা হয়। ১৮ই আগস্ট ১৯২৮ সালে ই কৃষ্ণ আইয়ারের (সক্রিয় কংগ্রেস নেতা ও গান্ধীবাদী) নেতৃত্বে গঠিত হয় মাদ্রাজ মিউজিক একাডেমী। দেবদাসী নৃত্য থেকে ভারতনাট্যম নৃত্যের পুনর্গঠন ও প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হবে এই একাডেমী থেকেই। ১৯৩০ সালে আর এক গান্ধীবাদী কবি ভাল্লাথোল নারায়ণন মেনন এবং তাঁর সহযোগী মুকুন্দরাজা স্থাপন করলেন ‘কেরালা কলামন্ডলম’। কথাকলি ও পরবর্তীকালে মোহিনীয়াট্যম নৃত্যের পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে কলামন্ডলমে। মোহিনীয়াট্যমকে কলামন্ডলমের শিক্ষাপ্রণালীতে যুক্ত করতে অনেক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের। কোনো ছাত্রী না জোটায় মুকুন্দরাজা তাঁর অনুগত আশ্রিত এক পরিবারের মেয়েকে নিয়ে আসেন নাচ শেখাবার জন্য—থাঙ্কমণি, কলামন্ডলমের প্রথম ছাত্রী, পরে গুরু গোপীনাথ যাকে বিয়ে করেছিলেন। মোহিনীয়াট্যম নৃত্যের কোনো সামাজিক সম্মান যখন আর অবশিষ্ট ছিল না তখনি তাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরা। মূল উদ্দেশ্য এক, ভারতের নিজস্ব শিল্প সংস্কৃতির ধারাগুলিকে উজ্জীবিত করে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের কাঠামো নির্মাণ। বিদেশের দরবারে যা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয় দেবে এবং এর থেকেই শিল্পীদের সম্মানজনক আয়ের ব্যবস্থা করা যাবে।

স্বাধীনতার আগের এই জাতীয়তাবাদী ভাবনাই জন্ম দিয়েছে আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের যা বাস্তবিকভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। কি সেই পরিচয়? মন্দির, মূর্তিপূজা, ভক্তি, সমর্পণের সংস্কৃতির পরিচয়। প্রতিটি নৃত্যধারাকে নাট্যশাস্ত্র আর পৌরাণিক কাহিনীর সাথে জুড়ে দেওয়ার ফলে গড়ে উঠেছে যে পরিচয়। প্রাচীন এক শাস্ত্রকে চাপিয়ে দেওয়া হল, নৃত্যশৈলীগুলিকে বেঁধে ফেলা হল সেই একই ছকে। পৌরাণিক কাহিনীগুলির মাধ্যমে বর্ণভেদ, জাতিভেদ, লিঙ্গ বৈষম্য সমস্ত সংস্কার ছড়িয়ে দেওয়া হল প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সেই সনাতন ধর্মের শিক্ষা। এ কোন জাতীয়তাবাদ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

নৃত্যের মুক্তি শিল্পের স্বাধীনতা :

১৯২১ সালে এই বাংলায় ঘটেছিল সমস্ত ছকের বাইরে সামাজিকভাবে নৃত্যকলাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস। বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন নৃত্যশিক্ষা। এ জন্য তাঁকে অনেক নিন্দে মন্দ অপমান সহ্য করতে হয়েছে কিন্তু তিনি অবিচল ছিলেন তাঁর কাজে। তিনি সার্বিক শিক্ষার বিকাশে সংগীত ও নৃত্যকলার ভূমিকার কথা বলেছেন। দেহ মনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় নৃত্যসাধনা যেখানে “নৃত্যের উল্লাস আছে নিয়ম নেই”। সেই নৃত্যের জন্য বিষয় তিনি নিজে রচনা করে নিয়েছেন, তাঁর সময়ের নিরিখে।

বিংশ শতাব্দীতে নৃত্যশৈলীগুলির পুনর্গঠনের এই যে যাত্রা তাতে শিল্পীদের সৃজনশীলতা ও নিরলস পরিশ্রমে অসম্ভব শক্তিশালী একটা মাধ্যম তৈরি হয়েছে সে কথা অনস্বীকার্য। এখন এই শতাব্দীতে তার চলন কি হবে? যেভাবে শাস্ত্রীয় নৃত্যানুষ্ঠানের দর্শক কমছে, শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনের সুযোগ কমছে তাতে এ কথা নিশ্চিত যে শহুরে শিক্ষিত মানুষও আর এই শিল্পের সাথে বড় একটা যুক্ত থাকছেন না। মন্দির থেকে দরবার থেকে মঞ্চে উত্তরণ ঘটেছে যে শিল্পের তাকে এগিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোতে সমৃদ্ধ হয়ে।

” মানুষ এক যুগে যাকে আশ্রয় করেছে আর এক যুগে উন্মাদের মতো তার দেওয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে পথে।” মানুষ চির পথিক। কোনো এক জায়গায় সে থেমে থাকেনি, থাকবে না। মানুষের জানার ইচ্ছা, জ্ঞান পিপাসা, ছেলেমানুষি উত্তরে ভরা পৌরাণিক কাহিনীর গণ্ডির মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়াবে না চিরকাল। একমাত্র মানুষই খাটে বুদ্ধির বেগার খাটনি, পশুর সে দায় নেই। তাই ভরসা মানুষ। তার বোধ বুদ্ধি আর চেতনায়।

Facebook Comments

Leave a Reply