আবার চম্বল: একটি আলোচনা – সাগরিকা বিশ্বাস

১৯৭৫ সাল। বলিউডের সাবালক হবার বয়স। বিষয় ডাকাত, আর সামগ্রিকভাবে ছবির জগতে এতটাই আলোড়ন ফেলেছিল রমেশ সিপ্পি পরিচালিত Dacoit-Western ধাঁচের “শোলে”, যে পরবর্তী কয়েক দশকেও তার জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র ফিকে হয়নি। এই ধারাবাহিক খ্যাতির মুলে টানটান ইউনিক স্টোরিলাইনের পাশাপাশি রয়েছে সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের, বিরল একটি পাথুরে, রুক্ষ প্রেক্ষাপট।
প্রতিটি মানুষেরই সাবালক হয়ে ওঠার একটি নিজস্ব, দীর্ঘ গল্প থাকে। ছোটবেলায় আমাদের মা-ঠাকুমাদের মনোরঞ্জনের অনেকটা জুড়ে থাকত দুর্ধর্ষ সব ডাকাতদের হাড় হিম করা গল্প। আমাদের মনের গভীর গোপন অ্যাডভেঞ্চার সেইসব গল্পের হাত ধরেই বড় হতে থাকে। আমরা সাবালক হয়ে গেলেও আমাদের বোধশক্তির বেড়ে ওঠার মধ্যে সেসব দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডাকাত চরিত্রগুলো ডাকাতি করে যায় দাপটে ।
২০১৭ সালের পয়লা এপ্রিল “ভিন্নচর্চা” নামে একটি সুচারু পত্রিকা হাতে আসে। বাজারচলতি আর পাঁচটা চটকদার ম্যাগাজিনের সাথে পাল্লা দেওয়ার মত যথেষ্ট উপাদান এতে থাকলেও বিশেষতঃ নজর কেড়েছিল প্রচ্ছদটি। পোট্রেট ফটোগ্রাফিতে প্রচ্ছদ জুড়ে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে সোজা তাকিয়ে আছেন একজন মানুষ। মুখভরা গালপাট্টা, কুচকুচে কালো ও মোটা পাকানো গোঁফ। প্রচ্ছদকাহিনী শুভেন্দু দেবনাথের “অচেনা চম্বল”। সবটুকু রোমাঞ্চ জড়ো করে রুদ্ধশ্বাসে আর্টিকেলটি পড়ার পর জানলাম, প্রচ্ছদের সর্বসত্ত্ব অধিকার করে থাকা মুখটি যার, তিনি চম্বলের দুর্ধর্ষ ডাকাত মালখান সিং।
২০১৯ এ হাওয়াকল থেকে প্রকাশিত হয়েছে শুভেন্দুর নন-ফিকশনধর্মী উপন্যাস “আবার চম্বল”। খুব সহজভাবে বললে এটি ভিন্নচর্চায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেরই একটি বিস্তারিত রূপ, ভাষ্য ও তথ্য উভয়দিকেই। লেখকের টানা এক পক্ষকাল চম্বলের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোর রোমহর্ষক ধারাবিবরণী। যেসব পাঠক আগের প্রতিবেদনটি সম্পর্কে অবহিত নন, তাদের জন্য প্রথমেই বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকবে বই-এর নামকরণে। এই “আবার” শব্দ একটা বিস্ময়কে প্রথমেই প্রতিস্থাপন করে দেবে মগজে। তারপর পরিচিত “চম্বল” নিয়ে আসবে রোমাঞ্চ। অর্থাৎ বিস্ময়পুষ্ট রোমাঞ্চিত আপনি পাতা উলটে বইটি পড়ে দেখতে অসহায়ভাবে বাধ্য থাকবেন।
১
কুড়িটি ছবিসহ ২৭৯ পাতার এই বইতে লেখক তার অভিজ্ঞতাকে ভাগ করেছেন মোট ১২টি অধ্যায়ে । অভিশপ্ত চম্বল, বেহড়ের বিড়ম্বনা, চম্বলের রাজা, চম্বল পেরিয়ে , জাদুকর ডাকাত মাধো সিং, মোহর সিং, শোলের গব্বরও বাচ্চা আসল গব্বরের কাছে, দাদ্দা মালখান সিং, দস্যু সুন্দরী পুতলীবাই, দস্যুসুন্দরীদের সন্ধানে এবং শেষ অধ্যায়: ফেরা । বলতে নেই, এই নামকরণে লেখক বিশেষ কুশলতার ছাপ রাখতে পারেননি যদিও তাতে আকর্ষণ ম্লান হয়নি এতটুকু।
অধ্যায়-অনুযায়ী বিচার করলে, প্রথম অধ্যায় চম্বল এর ভৌগোলিক অবস্থান তথা এর নামকরণ এর ইতিহাস প্রসঙ্গে খুব স্বচ্ছ ও তত্ত্ববহুল একটি অংশ। জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং এ-সম্পর্কিত নানান পৌরাণিক কাহিনী উল্লিখিত হয়েছে। মহাভারতের বিভিন্ন আখ্যানে চম্বল বিষয়ক প্রায় সবক’টি শ্লোক এবং তৎসহ তার অর্থ তুলে ধরেছেন লেখক। এইখানে অবশ্য পাঠকভেদে সমস্যা হতে পারে। প্রথম অধ্যায়ের ব্যতিক্রমী ও স্বচ্ছন্দ চলনের গদ্যের ফলে পাতার পর পাতায় রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে থাকা পাঠককে এক লহমায় থামিয়ে দেয় এই গুরুগম্ভীর শ্লোকগুলি। রোজনামচার ব্যাবহার করা কথাগুলোর গায়ে জোর করে একগুচ্ছ অলঙ্কার পরিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে। খানিক বাধ্যতা, খানিক জোরজুলুম। মোদ্দা কথা শুভেন্দু সবকটা শ্লোককে বিস্তারিত আলোচনা না করায় পাঠকের মাথায় অচিরে অসহ কিছু ভার অনুভূত হতে পারে। বা এও ভাবা বিচিত্র নয়, শুধুমাত্র প্রপার গার্নিশিং আর পাত্রের অভাবে শ্লোকের পরিবেশনাটুকু বিস্বাদ লাগল।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন; তা হল চম্বলের কৃষির অনুপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সেখানকার মানুষের অর্থনৈতিক দৌর্বল্য। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা কিভাবে ধীরে ধীরে সামগ্রিক জনজীবনে প্রভাব ফেলেছিল এবং বেহড়ের কিছু মানুষকে বাধ্য করেছিল বাগী হতে বা অপরাধের সাথে যুক্ত হতে তা সাবলীল ভঙ্গীতে ধরা হয়েছে। এখানে প্রায় গবেষকের কুশলতায় শুভেন্দু প্রকৃতির সঙ্গে তার অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ করেছেন। মনোজ্ঞ কাজ ও সার্থক তার খাটুনি, সন্দেহ নেই।
চম্বলের রাজা।এ অধ্যায়ের শুরু থেকে বর্ণিত গল্পটি একটি নিখাদ সিনেম্যাটিক ছন্দে এগিয়েছে। বাগী-সম্রাট ডাকাত মান সিং এর নাতি মহাবীর সিং এর সঙ্গে লেখকের একাধিক আলাপচারিতায় উঠে এসেছে বহু তথ্য। ৪ঠা মার্চ তিন ছেলেকে বুকে নিয়ে বেহড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মান সিং। পুলিশের গুলিতে বড় ছেলে যশবন্তের মৃত্যু, অজস্র খুনের দায়ে দীর্ঘদিন মান সিং-এর কারাবাস, এবং বাড়ি ফেরার পর ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা মান সিং এর বাগী হয়ে যাওয়ার কাহিনী – এসব-ই বিস্তৃত হয়েছে এই খণ্ডাংশে।
চম্বল পেরিয়ে। এই অধ্যায়ের সবচেয়ে নজরকাড়া বিষয়টি হল অটের দুর্গ বা দেবগিরী দুর্গ। রহস্যময় এই কেল্লার দরজা দিয়ে এখনও নাকি রক্ত ঝরে পড়ে। এই অদ্ভুত ঘটনার নেপথ্যে যে গল্পটি প্রচলিত, তার প্রায় পুরোটাই উল্লেখ করেছে লেখক।
জাদুকর ডাকাত মাধো সিং অধ্যায়ে এক বহু গুণান্বিত মানুষের কথা আমরা জানতে পারছি । সে একাধারে মেল নার্স, ডাকাত, জাদুকর এবং অভিনেতাও। এবং ডাকাত হয়ে উঠবার পেছনে যে দীর্ঘ ইতিহাস, তার যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্যসহ অবশেষে মাধো সিং-এর আত্মসমর্পণ – এই বই-এর আর পাঁচটা অচেনা লোককথার মত এটিও পাঠকের মনোযোগের দাবী করে, সঙ্গে সঙ্গে পরিস্ফুট হয় গদ্যের চলনে সাংবাদিককে ছাপিয়ে কথাকারের সিগনেচার ভেসে উঠতে না পারার মোটা দাগের গদ্যদোষ।
পরবর্তী অধ্যায় শুরু হচ্ছে “মোহর সিং” শিরোনাম দিয়ে। লেখককে দেওয়া আস্ত একটা ইন্টারভিউএ র সুবাদে, তার নিজস্ব বয়ান পড়ে চমকে উঠছি। নির্বিবাদী শান্ত স্বভাবের এক মানুষ পরিস্থিতির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে কিভাবে অপরাধ জগতে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়তে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই মোহর সিং। সন্দেহ নেই, “পত্রকার”-এর কৃতকৌশল এখানে ধন্যবাদার্হ, আর অন্তর্গত ন্যারেশনের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেওয়া অপরাধের হিসাব ( এ বই-এ উল্লিখিত সংখ্যাগুলির সিংহভাগ, বলা বাহুল্য, কোন না কোন অপরাধের সংখ্যা বা সময়কালকে নির্দেশ করে – সেই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করি !) এবং শেষে নিখাদ বাংলায় ছোট্ট একটা খাঁটি ইন্টারভিউ-র উল্লেখ বেশ প্রশংসনীয়, তথা বিরল। সে বিষয়ে পরে আসব। আপাততঃ দেখছি শুভেন্দু প্রায় প্রতিটি অধ্যায় শেষ করেছে পরবর্তীর প্রতি একটি ঈষৎ প্রকট ইঙ্গিত রেখে। ক্লাসিক বাংলা ধারাবাহিক উপন্যাসের এ টেকনিক জহুরী চোখ মাত্রেই ধরা পড়বে। অবিশ্যি তারপরেও, এ টেকনিক আশ্চর্যজনকভাবে, উৎরে গিয়েছে তো বটেই, সফল-ও হয়েছে। যেমন মোহর সিং-এর অধ্যায়ই শেষ হচ্ছে বর্তমান প্রবন্ধের একেবারে শুরুতে উল্লিখিত বহু বিখ্যাত সিনেমাটির আরও কুখ্যাত অ্যান্টিগনিস্টের উল্লেখ সহকারে।
গব্বর সিং। এর রত্নাকর গাথাটিও খুব পরিচিত। দারিদ্র্য, জমি নিয়ে পারিবারিক কোন্দল, সমাজবিরোধী গণগণে এক ক্রোধের জন্ম এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণতি খুন। তার হাত ধরে বেহড় উপহার পাচ্ছে আরও এক ডাকাত। গব্বর তার ডাকাত জন্ম ধন্য করেছিল অত্যাচারের পদ্ধতি দিয়ে। তার আবিষ্কৃত নিত্যনতুন কৌশলের নারকীয়তা পুলিশ এর গদি নাড়িয়ে দিয়েছিল সমূলে । সব মিলিয়ে একশো ষাট জনের নাক কেটে নিয়েছিল গব্বর সিং গুর্জর, সঙ্গে শয়ে শয়ে খুন ও লুঠের কাহিনী আজও বেহড়ের গ্রামে গ্রামে শোলে সিনেমায় কথিত মিথের মতই রাতে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ায়, থানায় থানায় থরে থরে ফাইল নীরব নিশ্চুপ সাক্ষ্য দেয় তার অত্যাচারের। “আবার চম্বল” গ্রন্থের এই অধ্যায়টিই চম্বল নামক কিংবদন্তীর অন্তর্গত লোককথাগুলির মধ্যে পপুলার কালচারকে সর্বাধিক আলোড়নকারী এক চরিত্রের সঙ্গে সাধারণ সিনেমাপ্রেমী ভারতীয়ের মধ্যে সেতু বেঁধেছে সবচেয়ে বেশী ও গভীর। অধ্যায় শেষ হচ্ছে কুখ্যাত মালখান সিং-এর উল্লেখ দিয়ে।
বাগীসম্রাট মালখান সিং-এর বাড়িতে যাবার কথা বলতে বলতে তার গল্প শুরু করেছেন লেখক। পুলিশকে রীতিমতো পুতুলনাচের মত নাচিয়েছেন এই ডাকাতটি। অথচ শেষ জীবনে ডাকাতি ছাড়ার পর আর পাঁচটা ডাকাতের মত তাকেও যুঝতে হয়েছে চরম দারিদ্র্যের সাথে। বলতে নেই, এতগুলি অধ্যায়ে অজস্র ডাকাতের ব্যক্তিগত জীবন ও সংগ্রামের কাহিনী, তাদের অত্যাচার ও অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পড়তে পাঠক যদি হাঁপিয়ে ওঠে, তবে তাদের মনে কিঞ্চিৎ সুবাতাস আনতে পারে প্রাক্তন এই ডাকাতের নিজস্ব বৈঠকখানায় বসে লেখককে দেওয়া দীর্ঘ ইন্টারভিউটি। এখানে ঈষৎ অন্য মাত্রা যোগ করেছে তার বর্তমান রাজনৈতিক যোগাযোগের কথা। বলাই বাহুল্য, মালখান সিং-এর প্রচ্ছদজোড়া মুখ থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের মত পাঠকদের, ২০১৭-র এপ্রিলে, প্রায় আড়াই বছর বাদে এসে মালখানের এই সাক্ষাৎকার আমাদের এক নতুন বাঁকে নিয়ে এসে দাঁড় করায়। একটি যাত্রা যেন শেষ হয়।
শেষের অধ্যায়গুলিতে মহা দাপট নিয়ে বসে আছেন মহিলা ডাকাতদল – পুতলী বাই, সীমা পরিহার, রেণু যাদব, নীলম, সরলা প্রমুখ। প্রতিটি মেয়ের ডাকাত হওয়ার নিজস্ব গল্পগুলো পড়ে যথারীতি আমরা রোমাঞ্চিত। নিছক নারী বিদ্বেষ ও নারীর উপর অত্যাচারের চেনা ভারতীয় গল্পের উপরে সংযোজন নয়, এই নারীরা অত্যাচারী পুরুষ জাতকে শিক্ষা দিতে প্রত্যেকেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। চম্বলের মাটির বোধকরি এটাই গুণ। একজন নারী হিসেবে তাদের সংগ্রামের প্রতি ছত্র পড়ে আমার ভিতরে জেগে ওঠে অকুণ্ঠ সমর্থন ও উচ্ছ্বাস। ফুলন দেবী বা পুতলী বাইকে নিয়ে ছবি হয়েছে বটে, তবে তাদের এই স্ট্রাগল সর্বভারতীয় মিডিয়া বা বিনোদনের জগতে তেমন জায়গা করে নিতে পারেনি। যাই হোক, শুভেন্দুকে ধন্যবাদ, আরেকবার নীলমের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য। যারা ভিন্নচর্চা-র আলোচ্য সংখ্যাটি পড়েননি তারা এর সঙ্গে মিস করেছেন নীলমের কাউবয়ের পোশাকে অস্ত্র হাতে অসাধারণ ছবিটি। বেহড়ের মাটির রুক্ষতা তার মুখের কঠিন রেখাগুলিতে স্পষ্ট উদ্ভাসিত, বইটি পড়তে পড়তে আরেকবার মনে পড়ে।
শেষ অধ্যায়: ফেরা। এখানে হতাশ করেছে শুভেন্দু। আক্ষরিক অর্থেই। গোটা বই-এর অধ্যায়ে অধ্যায়ে যে অপরাধধর্মী রূপকথা অবচেতনে প্রায় সিনেম্যাটিক ভঙ্গীতে গড়ে উঠছিল, তার ফলে কেন জানি না আশা করতে শুরু করেছিলাম ও যখন চম্বল ছাড়ছে, তখন নিশ্চয়ই এইসব কিংবদন্তী ডাকাতদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে, ওকে বিদায় দেওয়ার জন্য। কিন্তু না, কেউ ছিল না। চম্বল বোধকরি এরকম-ই নির্মোহ। যাকে কাছে টেনে নেয়, তাকে ফিরিয়ে দিতেও একফোঁটা চোখের জল ফেলে না।
২
সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে শুভেন্দুর বইটি মুলতঃ ত্রিধারা রসে জারিত। এ বইটি একাধারে আমাদের শৈশবের হাড় হিম করা ডাকাতের গল্প, এবং নিঃসন্দেহে একটি ট্রাভেল গাইডও হতে পারে। মধ্যপ্রদেশের আনাচে কানাচে লেখক এতটাই ছানবিন করেছেন যে বইটি অতি তথ্যসমৃদ্ধ একটি ভ্রমণের গাইডলাইন বলে দেয়। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষরা ভৌগোলিকভাবে বেশ কিছুটা ধারনা পেয়ে যাবে চম্বল ও তার আশপাশের জায়গাগুলো সম্পর্কে। তৃতীয়তঃ, বইটি বেহড়, বাগী বা চম্বলের ডাকাতদের ওপর করা গবেষকদের জন্য কার্যকরী এক গাইডবুক। আর সেখানেই এ বই-এর দুর্বলতাগুলি স্পষ্ট। যে বিষয়গুলো অধরা ও হাজার কয়েক প্রশ্ন রেখে যায় সেগুলি হল, এ বই থেকে পাঠকের প্রাপ্তি কি? শুধুমাত্র বিস্ফারিত চোখে কয়েক ঘণ্টা ঝাড়া ডাকাতদের অতীত জীবনের রিল ঘোরানো?
ধরা যাক, এ বইকে কোন পাঠক নিছক ট্রাভেল গাইড হিসেবেই ব্যবহার করছেন। ধরা যাক কেউ বেহড়ে শুধু উত্তেজনাবশেই যদি ঘুরে বেড়াতে যায়, তার ঠিকঠাক দিকনির্দেশ কি আমরা আদৌ পেয়েছি? ছড়িয়ে থাকা কিছু মানচিত্রের মত ধরা গেছে পুরো জায়গাটা। এ বই-এ পড়া তথ্যের ভিত্তিতে কেউ চম্বল দর্শনে গেলে তার দিকভ্রষ্ট হওয়া আটকাবেনা। কারণ লেখক চম্বলের মানচিত্র যতটা নিপুণভাবে বর্ণনা করেছে, ততটা শ্রম দেননি প্রতিটি স্থানে পৌঁছনোর পথনির্দেশ ও সেসব জায়গায় বসবাসের মোটামুটি একটা ধারণা গড়ে দেবার পেছনে। অর্থাৎ নিখুঁত ট্র্যাভেল গাইড হয়ে ওঠা হয়না এই বই-এর।
গদ্যের ভাষাটিও, উল্লিখিত যে, উত্তর কলকাতার মৌখিক বাংলা সুলভ সাদামাঠা, জায়গায় জায়গায় কিয়ৎ ঝাঁকুনিসহ। কিছুক্ষেত্রে লেখককে একাত্ম মনে হয়, আবার কোথাও কোথাও সে অধরা, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। আবার কোথাও ঘটনা থেকে লেখক হঠাৎ বেরিয়ে গিয়ে স্মৃতিচারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিঞ্চিৎ বিরক্তি আসে সন্দেহ নেই। এমন টানটান বিষয়ে গদ্যের ভাষাটিও আরও মনোযোগ দাবী করত বলে মনে হয়। ডাকাতদের সাথে লেখকের কথোপকথনগুলোও দস্যুর মতই আচমকা এসে পড়ে। লেখক সাংবাদিক, এ তার অভ্যেস। কিন্ত তিনি কোথাও কোথাও বিস্মৃত হয়েছেন যে এটা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বা সাক্ষাৎকার মাত্র নয়, রীতিমত একটি গ্রন্থ, যা তার নিজের মতানুযায়ী-ই, “অভিশপ্ত চম্বল” বা “বেহড় বাগী বন্দুক”-এর মত মহাগ্রন্থের সঙ্গে পাল্লা টানতে নেমেছে।
বই-এর শেষে মুদ্রিত চিত্রগুলির কিছু লেখকের নিজের তোলা এবং কিছু ইন্টারনেটের দৌলতে প্রাপ্ত। ব্যক্তিগত মতে প্রাসঙ্গিক অধ্যায়ের মধ্যে ঠাঁই করে নিলে ছবিগুলি আরও বেশী পূর্ণতা পেত আর পাঠকের পক্ষে রিলেট করার কাজটা হত অনেকটাই সহজ। কারণ গুগলের দৌলতে আ বিষয় দিয়ে সার্চ করে তা সম্পর্কিত ছবি সংগ্রহ করা এমন কিছু দুঃসাধ্য নয় । সেখানে রঙিন ছবিও খুব একটা দুর্লভ নয়। সুতরাং ছবি সাজানোর কাজে লেখক বিশেষ কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। এছাড়া আরও কিছু অপ্রাপ্তি যা এই অকিঞ্চিৎকর আলোচনায় উল্লেখ না করলেই নয় সেগুলি উল্লেখ করা যাক।
* বেশীরভাগ কথোপকথন গুর্জর ভাষায় কণ্টকিত। কোথাও কোথাও সাধারণ পাঠকের প্রায় অবোধ্য, যা লেখাকে একটি ভালো সাহিত্য থেকে ভালো প্রতিবেদন হিসেবে সপ্রমাণ করেছে বেশী।
* যে কোন গল্প লতায় পাতায় ছড়িয়ে গিয়েছে এত দীর্ঘে, যে পাঠক তথ্যে সমৃদ্ধ হলেও সাহিত্য হারিয়েছে তার সাযুজ্য ও সংযম। এক্ষেত্রে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কিত রিপোর্টাজ-এর বই হয়ে ওঠার জার্নিটি উল্লেখনীয়। সমস্ত ঘটনার টাটকা গরম বিবরণ দেওয়ার পরেও “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস” কিন্তু এক মহাগ্রন্থ-ই, দৈনিক বসুমতীর কলাম নয়। সে পথে শুভেন্দু হেঁটেছে বৈকি, কিন্তু হোঁচট খেয়েছে প্রচুর, বার কয়েক পথ হারিয়েছে-ও।
* লেখার দৃষ্টিকোণ আগাগোড়া একের পর এক রোমাঞ্চকর গপ্প শুনিয়ে যাওয়ার। চম্বলের যে দীর্ঘ ইতিহাস আলোচিত হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে তার আর্থ-সামাজিক অবস্থা, উঁচু জাত দ্বারা নিচু জাতের প্রতি শোষণ-অত্যাচারের চিরাচরিত বিবরণ এবং তার কারণ হিসেবে অবধারিত আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের ভারতীয় রূপটির কোন আলোচনা এই বইতে পাই না। রোমহর্ষক ডাকাতের গপ্পের আড়ালে যে যুগ-যুগ ধরে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শাসক-শোষিতের সাবেকী শ্রেণী বৈষম্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং অত্যাচারের কাহিনীগুলিকে রীতিমত পপুলার কালচারের খোরাক বানিয়ে বাজারোপযোগী করবার পেছনে যে ধনতান্ত্রিক প্রবণতা কাজ করে আসছে তাকে তুলে ধরবার গুরুত্বপূর্ণ তথা বিশ্লেষণাত্মক দায়িত্বটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছেন লেখক।
সবশেষে, যাবতীয় ছিদ্রান্বেষণ ও সমালোচনার কেজো দৃষ্টিভঙ্গিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েও একটি কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। এমন ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই বাংলায় খুব বেশী রচিত হয়নি। শুভেন্দু এক ধুঁয়াধার সাংবাদিক এবং এখন গ্রন্থকার হিসেবে তার দায়িত্ব আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে স্বচ্ছ সংবাদ পরিবেশনার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের মূলধারার প্রতিও। আশা করব, ভবিষ্যতে সে বাংলা সাহিত্যের এই ধারাটিকে আরও সমৃদ্ধ করবে এবং আমাদের এমন সব বই আরও অনেক উপহার দেবে। ওর প্রতি শুভেচ্ছা রইল।
আবার চম্বল
শুভেন্দু দেবনাথ
হাওয়াকল
মূল্য: ভারতীয় মুদ্রায় ৩৫০ টাকা।
Posted in: April 2019, Criticism