ধারাবাহিক উপন্যাস : নীলাব্জ চক্রবর্তী
যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে
প্রথম পর্ব
১
তোমাকে দেখতে গিয়ে দেখে এলাম নদীর মতো রেলপথ বরাবর চাঁদ চলে গেছে। লোকাস। ছায়ার ভেতর ছায়া আর জলের ভেতর জল চলে গেছে। অথচ অপেক্ষা তোমার জন্য হেজে যাওয়া টুকরো টুকরো ছায়া হয়েই দাঁড়িয়ে আছে এখনও।
বেলঘরিয়া… রথতলা… ডানলপ… শ্যামবাজার… কলেজ স্ট্রীট… মানিকতলা… বেলেঘাটা… সল্টলেক… উল্টোডাঙা… দীনেন্দ্র স্ট্রীট…
অপেক্ষা, তোমার জন্য,দাঁড়িয়েই আছে শক্ত হয়ে।
কখনও না কখনও ঠিক দেখা হয়ে যাবে তোমার সাথে। একদিন ঠিক বলব তোমায়, ‘জানো তো আশা ভোঁসলে একবার দেবানন্দ সম্বন্ধে কী বলেছিলেন…?’ তুমি অল্প কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইবে, ‘কী বলেছিলেন আশা ভোঁসলে?’ বলব, ‘উনি বলেছিলেন, উনি তো কখনও দেবসাহেবের মতো সুন্দর দেখতে হতে পারবেন না, উনি চান ওঁর গান যেন দেবসাহেবের মতো সুন্দর হয়।’ এবার হাসবে তুমি। বলবে, ‘তো? হঠাৎ এই কথা?’ বলব, ‘আমিও এরকম ভাবি জানো? আমি তো কখনও তোমার মতো সুন্দর হতে পারব না… আমার কবিতা যেন তোমার মতো সুন্দর হয়…’ এইটুকু বলে লজ্জা লাগবে আমার। এমনকি তোমারও। তারপর একদিন ‘মাদাম দেবানন্দ’ নামে একটা কবিতা লিখব হয়তো… লিখব…
সকাল বানাতে বানাতে
মাদাম যে দেবানন্দ
ট্যাটু আর তাবিজে
কেক মাখছেন দুহাতে জুলাই মাখছেন
আশা আশা
ট্যাগ খুলে রেখে
জলের বাইরে
এইসব কাপ কাপ ভাষায়
যেটুকু লোকেশন পড়ে আছে
কেন্দ্র হয়
১০-১২ মিনিটের ব্যাসার্ধে
লোকাস বরাবর যত রঙ
যত রুট শান্ত হচ্ছে
অথচ
এটা একটা প্রেমের কবিতা হবে কি হবে না
তার ঠিক নেই এখনও…
আর তারও অনেক অনেকদিন পরে তুমি হয়তো কখনও বলবে, ‘এ কী! এভাবে একটা উপন্যাস শুরু হয় না কি কখনও?’…
২
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
ডাবল ফিল্টার শ্যামা মার্কা সরিষার তৈল
আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তৈরী
ঝাঁঝ ও গন্ধ দেখিয়া নিবেন
আমাদের কোনও শাখা নাই
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
— হ্যাঁ দাদা, হয়ে যাবে। হ্যাঁ, বলছি তো! আপনার ডিপি নাম্বার ফাইভ নাইন ওয়ান এইট আর আপনার ল্যাণ্ডিং নাম্বার হোলো ফাইভ ফাইভ ওয়ান সিক্স। হ্যাঁ, বলছি তো হয়ে যাবে! কোনও ঘাপলা নেই এর মধ্যে… আরে… আবার এক কথা… বলছি তো আপনাকে… এখন ছাড়ুন তো দাদা ফোনটা… পেচ্ছাপ পেয়েছে…
— …
— দেখুন, একটু সময় দিন আমায়। সেই সেবার, মনে আছে তো… আট হাজার থেকে কথামতো ঠিক ছ হাজারেই করে দিয়েছিলাম… যেদিন বলেছি সে দিনেই… একটু হয়তো বসে থাকতে হয়েছিল কয়েক ঘণ্টা… কিন্তু সেদিনই করে দিয়েছিলাম কি না… অ্যাঁ…পেরেছিল অন্য কেউ ? তিন মাস ধরে অনেক চেষ্টাই তো করেছিল… জানিনা ভেবেছেন ? দেখুন… আমার সাথে ছেঁড়খানি করে লাভ নেই… করাতে হলে পুরো আমার হাতে ছেড়ে দিন, তারপর না হয় দেখুন… কিন্তু ছেঁড়খানি করলে কেস পুরো অন্যরকম হয়ে যাবে বলে দিলাম… আমি কিছু জানি না…
— …
— হ্যালো, কে, বাবু তো ? হ্যাঁ শোন বাবা। তুই রেডি তো? গোছগাছ কমপ্লিট? জামাকাপড় পরা হয়ে গেছে? বাহ বাহ… হ্যাঁ হ্যাঁ… কোনও চিন্তা নেই… আমি জানিয়ে দেব… না এখনও পৌঁছায়নি বড়দি… আমি একটু আগেই ফোন করলাম… আরও আধঘণ্টা মতো লাগবে মনে হয়… বাবু বাবু… তুই এরকম বলিসনা বাবা… তুই এরকম বললে আমি খুব দুর্বল হয়ে পড়ি বাবু… তুই… তুই… এরকম করিস না রে বাবু… শোন না… খেলা দেখছিস? কোহালি ব্যাট করছে? ক্কীঈঈ? আউট হয়ে গ্যাছে? কত করেছে? যা… পুরো টিম? অল আউট? আমি খেলা দেখতে পারছি না বলে খোঁজ নিচ্ছি… তুই খেলা দেখে আমার কোহালির টিমকে হারিয়ে দিলি বাবু…
— …
— আরে তোমকো কবসে বোলতা হুঁ রে বাবা… বিটিরোড নেহী… নীলগঞ্জ রোড সে আও… একঠো হনুমান মন্দির হ্যায় না… উসকে বগলমে হামারা গ্রিল কা দুকান… রথতলা কে পাস… আরে নেহী রে বাবা… রথতলা মে নেহী… আরে বোলা না… হনুমান মন্দির সে আগে যাও… এক গ্রিল কা দুকান নেহী হ্যায়?… আরে কিউ নেহী হ্যায় রে বাবা?… ঠিকসে দেখো… আরে তুম বিটিরোড মে তো নেহী হো?… হাঁ হাঁ… নীলগঞ্জ রোড মে রহো… রথতলা সে ঘুসা হ্যায় তো?… হনুমান কা মন্দির মিলা? ফির একঠো পানি কা কল মিলা?… উসকে আগে মে এক শাটারওয়ালা গ্রিল কা দুকান নেহী হ্যায়? … এক আদমি বইঠা হ্যায় না?… কালা কালাসা আদমি?…
# * # * #
রস্বর নদীন রর হুহুহু দিনদি
আলোয়া রর ঘনঘ মনাম
মমমরেকরে
বখুব হয়হ নীলনী
আরয়া
ধ্বনিধ্ব জানেজা
নলিপ্যালিন বানাবা বানাবা করেক
ইয়েই লভুল খেলাখে ছেড়েছে
কেনকে
জোড়েজো জোড়েজো রাতারা ড়েউড়ে যায়যা…
মুখোমুখি বসা লাল ইংলিশ বণ্ডের ওপর এঁকে রাখা এইসবপায়ের ছাপ। স্মৃতি। দৃশ্য এক ঘাত। তারিখ। ঋতু তাকে সম্পর্ক করেছে। নিপাতনে সিদ্ধ এইসব। ফ্ল্যাশব্যাক ফ্ল্যাশব্যাক। এইভাবে প্রতিরক্ষা খাতে আরও নিপুণ আরও অবাধ হয়ে ওঠে মাদাম দেবানন্দ থেকে ভ্যালেনটিনা পর্যন্ত আমাদের অস্থায়ী যাতায়াত। অথচ পরের পর ব্যর্থ কম্যুনিকেশনগুলো জমে উঠতে থাকে। বাক্যের পর বাক্য। পর্যাপ্ত রাতের ভেতর একটু একটু করে নেমে আসতে থাকে পাতিলেবু, আদা, পুদিনাপাতা আর শসা ভেজানো জল। ক্রমশ ক্রিয়া হয় তারা। স্বাস্থ্য হয়। ধাতু হয়। চোখে স্নান পড়তে থাকে। সাদা থকথকে ঘুমের ভেতর বসে ভাবতে থাকে বরকত আলির ট্রায়াল রুমের কথা। ভাবতে থাকে এখন তোমায় একটা ফোন করা ঠিক হবে কি না…
৩
ধরুন এখন সন্ধ্যা সাড়ে আটটা। ধরুন আপনি উল্টোডাঙা থেকে ডানলপ যাবেন। তখন, যা হয় আর কী, আপনার সামনে দিয়ে পরপর তেঘড়িয়া টু হাওড়া ময়দান রুটের ফাঁকা ফাঁকা মিনিবাস যেতে থাকবে। আরও যেটা হবে তা হোলো পরপর চারটে নো রিফিউসাল লেখা হলুদ ট্যাক্সি আপনাকে বলে যাবে ডানলপের দিকে খুব জ্যাম, যাওয়াই যাবে না। তখন সবার আগে আপনার মনে পড়বে সেই অফিসকলিগের কথা, যে আপনাকে পইপই করে বলা সত্ত্বেও আপনি কিছুতেই ওলা বা উবের অ্যাপ নিজের মোবাইলে কখনও ডাউনলোড অবধি করেননি। অল্প হাসবেন আপনি। বিড়বিড় করবেন অনেকদিন আগে নিজের লেখা একটা ব্যর্থ কবিতার লাইন… ‘ট্যাক্সিতে ট্যাক্সিতে আমি রোদের বেলুন ফেলে গেছি’… আপনার ধৈর্য ভাল। আপনি হয়তো আপনার বাবার কথা ভাববেন তখন। তাঁর মুখে শোনা ১৯৬৭ সালের ভোটের কথা ভাববেন। জোট হয়েছিল সিপিআই, বাংলা কংগ্রেস, বলশেভিক পার্টি আর ফরওয়ার্ড ব্লকের। আপনার মনে পড়বে, প্রথমবার যখন আপনি বলশেভিক পার্টির কথা শুনেছিলেন কেমন অবাকটাই না হয়েছিলেন। সত্যি সত্যি বলশেভিক নামের পার্টি!
সেবার আপনাদের এলাকায় লোকসভায় সিপিআই-এর প্রার্থী রেণু চক্রবর্তী আর বিধানসভায় বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী দেবী ঘোষাল। তখন লোকসভা আর বিধানসভার ভোট একসাথে হতো পশ্চিমবাংলায়। আপনার তরুণ পিতা সারারাত ধরে গোটা শহরতলির দেওয়ালে দেওয়ালে গাছে গাছে পোস্টার মেরে চলেছেন রেণু চক্রবর্তী আর দেবী ঘোষালকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আর সিপিয়েমের ছেলেরা সারারাত ধরে সেই পোস্টার ছিঁড়তে ছিঁড়তে যাচ্ছে…
# * # * #
গাছে গাছে মেধাবী আঙুল এখন। গড়িয়ে, কবিতায় আসছে। অথচ মগজ এক পোলিটিক্যাল কাঁচ। হরফগুলো গলে যাওয়া অবধি অপেক্ষা। তখন মাংসের কাছে বাঁকা জল। লাল নাভি। তখন আয়নার কাছে ভারী ছায়া। বিকেলের মাপে ছিঁড়ে আনা অস্থিরতা। রহশহর নামের একটা অস্পষ্ট প্যালিনড্রোম স্মৃতির উল্টোদিকে হেঁটে গ্যালো। ক্ষুধা ও ঘ্রাণ ভাবতে ভাবতে প্লেনের জানলায় এসে লিচুক্ষেত কফিক্ষেত। রূপোনিষদ। কামো ভ্যুজ আপেলে ভ্যু মাদমোয়াজেল?
Posted in: April 2019, Novel