দ্বেষপ্রেম – জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি

অবিশ্বাস থেকে ক্রমে বিশ্বাসে যেতে চাইছি আমি। অসুন্দর থেকে সুন্দরে। যেতে চাইছি, খাদ থেকে উঠে বাঁকে বাঁকে গড়িয়ে। খাদের ধারে আমার বাড়ি নয়, এইটুকুই বিশ্বাস রাখার চেষ্টা করেছি আমি। বিশ্বাস করছি, প্রকাণ্ড হা-মুখ নিয়ে বসে আছে যে টিকটিকি, দীর্ঘ জিভ, নখে নখে দেওয়াল। মুছে যাবে। মুছে যাবে শীঘ্রই। ওখানে একটা জানলা হবে। আসব, যাব। ক্রমে ক্রমে জানলাটা বিরাট…

ভাবনাটা এখানে এসেই থেমে যাচ্ছে বারবার। যতই চেষ্টা করছি, আসলে কিছু নয়, কিছুই নেই। কোনও টিকটিকি নেই, কোনও দেওয়াল নেই, কোনও হা-মুখ নেই, নেই কোনও দীর্ঘ জিভ…ততবারই স্ক্রিনে ভেসে উঠছে কিছু শব্দ…আমি উঠে দাঁড়াচ্ছি। জাতীয় সংগীত শেষ হলে, এলিয়ে দিচ্ছি শরীর। আমি ক্লান্ত নই, তবু ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ক্লান্ত লাগছে। যেন আমাকে ক্লাস টিচার কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেছেন। কতো কতো যুগ আমি কান ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আর ভাবছি, কোন পড়াটা পারিনি আমি? কোন পড়াটা?

সিনেমা স্টার্ট হল, হলের ফিসফিসানি আসতে আসতে নিবে গেল। যে কটি হালকা আলো আমাকে এতক্ষণ দেওয়াল থেকে নিবিয়ে রেখেছিল, নিবে গেলে সে কটি’ও, আমার আর দেওয়ালের মাঝে শুধু টিকটিক। পোকার মতো, অপেক্ষা করছো, মৃত্যু। উড়ে যেতে পারি, কিন্তু উড়ছি না। কিছু একটা করতে পারি, কিন্তু করছি না। নিশ্চিত হয়ে যে, এ আগুন আমার ঘরে নয়। তারপর যখন পুড়তে লাগল আমার সদর, ধরমর করে খিড়কি খুঁজতেই, অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক দেরি। প্রকাণ্ড হা-মুখে তলিয়ে যেতে যেতে

দাঁড়িয়ে আছি একটা রাস্তার উপর। ঠিক মাঝখানে। একবার ডানদিকে ঘুরে দেখি, রাস্তাটা চলে গেছে কোথাও একটা। বামদিকে ঘুরে দেখি অন্য কোথাও। একটাই রাস্তা, অথচ আমাকে নিয়ে যেতে চায় ওরা অন্য-অন্যখানে। ডানদিকের রাস্তাকে জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা আমি কি দেশপ্রেমিক? আমি কি আমার দেশকে ভালোবাসি? সিনেমাহলে জাতীয় সংগীত চললে আমার উঠে দাঁড়াতে এতো অনীহা কেন? কেন মনে হয়, আমাকে কেউ জোর করে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে?…সে কোনও উত্তর দেয় না, কটমট করে তাকিয়ে আমার দিকে। ভয় পেয়ে বাঁয়ে ঘুরলাম। জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা তুমিই বলো, আমার অন্যায়টা কী? এই যে আমি ঠিকঠাক ট্যাক্স দিই। ট্রাফিক আইন মেনে বাইক চালাই, চুরি করি না, কাউকে ঠকায়নি, কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করি না, সরকারি নির্দেশ ও কাজ আমি আমার সামর্থ্য মতো পালন করি…এতসব করেও কি আমি দেশপ্রেমিক নই? আমার সিনেমাহলে জাতীয় সংগীত গাইতে ভালো লাগে না তো, আমি কী করব? আমি চাই না, কোনও যুদ্ধ হোক। আমি চাই না, কাশ্মীর সৈনিকের বুটের নীচে থাকুক। আমি চাই না, মুসলিমরা এবং যেকোনো মানুষ তার পছন্দের খাবারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হোক। আমি চাই না রামমন্দির হোক। আমি চাই না, কোনও মন্দির বা মসজিদ হোক। আমি চাই না, সরকার মাথা গলাক মানুষের ধর্ম, বর্ণ নিয়ে। আমি চাই না, আমি চাই না… আমি চাই না এমন অনেক কিছুই, যা আমার দেশ চায়, আমার দেশের সরকার চায়, তাহলে কি আমি দেশদ্রোহী? সে মুচকি হেসে বলল, কোথায় যাবে? কোথায় যাব? কোথায়? আমি জানি না তো। আমি তো একটা প্রকাণ্ড হা-মুখে তলিয়ে যেতে যেতে…কোথায় যাচ্ছি আমি?

গুহার আঁধারে ঢুকলেই কেন জানি না, আমার খুব প্রভাত-পাখির গান শুনতে ইচ্ছা করে। ফিরে ফিরে আসে আমার ছুটুবেলা। প্রতিটা মানুষেরই একটা ছেলেবেলা থাকে। আমিও ব্যতিক্রম নই। প্রতিটা ছেলেবেলাই আলো-আলো-আলো-রোদ, আমারটাও আলাদা কিছু নয়। কাল ১৫ ই আগস্ট। স্বাধীনতা দিবস। উত্তেজনায় ছটফট করছি। কখন আসবে কাল, পাখি উঠবে, আমি উঠব, রোদ উঠবে…পতাকা উড়বে পতপত।

ঘুম আসছে না কিছুতেই। ভাবছি, সকাল হয়ে যাবে না তো। আমাকে না নিয়েই পতাকা উড়ে যাবে না তো আকাশে। মায়ের ধমক, ঘুমা। কাল ঠিক উঠিয়ে দেব। কখন, কখন ওঠাবে? অনেক ভোরে কিন্তু। বেশ, তাই হবে। এখন ঘুমা। কিন্তু যদি মা না ওঠায়, যদি মা ঘুমিয়ে যায়। আমাকে যে উঠতেই হবে অনেক অনেক আগে।

ওঠ, ওঠ..সকাল হয়ে গেছে। সকাল!? ধক্ করে এসে লাগল বুকে। এত দেরি? আমাকে আগে ওঠাওনি কেন? পতাকা কি উঠে গেছে? না, কিচ্ছু দেরি হয়নি। ওঠ। ধরমর করে উঠে, ছুট ছুট। অনেক দায়িত্ব আজ। অনেক কাজ। প্রথমে বাড়িতে পতাকা উত্তোলন, স্যালুট। তারপর স্কুলে পতাকা উত্তোলন, স্যালুট।

পতপত করে উড়ছে পতাকা। আর কপালে হাত ঠেকিয়ে, কী বিরাট, কী বিরাট হয়ে যাচ্ছি আমি। অনেক অনেক বড়ো, হতে হতে, পতাকার দূরত্বে..

জাতীয় সংগীত শুরু হল। শিরশিরিয়ে উঠল গা। গলা বুজে আসছে, তবু গাইছি…জলধি তরঙ্গ… অন্যদিন তো এমন হয় না। প্রায় দিন’ই তো আমি প্রেয়ারে, শুধু ঠোঁট নাড়ি, হাসি, মজা করি, বন্ধুদের খুঁচি, বন্ধুরা আমাকে খোঁচায়, কতক্ষণে শেষ হবে আর দুরদুর করে ছুটে যাব ক্লাসে। এখন স‍্যারেরা চকলেট দিচ্ছেন আর মেরি বিস্কুট।

দেশ বলতে, সকালে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া মা মা গন্ধই বুঝি। এমনই ছোট থেকে শিখে এসেছি আমরা, শেখানো হয়েছে। আমারও আপত্তি নেই। কেমন নির্ভার লাগে। হোস্টেলে হোস্টেলেই কেটে গেছে আমার কিশোর টু যুবক বেলা। দেশ বলতে আমি বুঝেছি আমার গ্রাম। ঠিক গাছ মাটি পুকুরওয়ালা গ্রাম গ্রাম দেশ নয়। আমার বাড়ি, আমার বাড়ির সবাই, আমরা বন্ধুরা…বাড়ি ফিরতে খুব মন করত। কষ্ট হত, কেমন নির্বাসন। কিন্তু কষ্টে ছিলাম এমন নয়। বরঞ্চ বেশ মজার, হোস্টেল লাইফ। তবু বাড়ির দিকে ফেরানো থাকত একটা পা, কবে যাব কবে যাব, ফিরে ফিরে ফিরে আমার গ্রামবেলা।

জাতি বলতে বুঝেছি, আমার আশেপাশে রয়েছে যারা। দেশ বলতেও তাই। কিন্তু কীভাবে জানি না, হঠাৎ করে বদলে গেল দেশ, দেশপ্রেম। ছোটবেলায় তো এমন ছিল না। এইতো কিছুদিন আগেও না। দেশপ্রেমিক আলাদা করে খুঁজতে হয় নাকি, বা দেশভক্ত? এ তো বাবা-মা-পরিবারকে ভালোবাসার মতো স্বাভাবিক। এত স্বাভাবিক সুন্দর জিনিসটা চিৎকার করে বলতে হয় নাকি? এর জন্য কোনো সার্টিফিকেট লাগে নাকি বা আয়না? যখন ছাত্রাবস্থায়, প্রথম শুনলাম টেররিস্ট। কী ভয়ংকর! হাড় কেঁপে যেত। টেররিস্ট বলতে দেশদ্রোহীই বুঝতাম। ভয়ংকর কিছু একটা, যা স্বাভাবিক নয়। কালেভদ্রে খুঁজে পাওয়া যায়। এখন তো টেররিস্ট ছড়াছড়ি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশদ্রোহী।

এবং ভারতে এখন দেশপ্রেমিকের রমরমা। ষোল হাত বাঁশে, চৌষট্টি হাত পতাকা তুললে দেশপ্রেমিক। একশো আট বার জয় হিন্দ জপলেই দেশপ্রেমিক। কাশ্মীরী হোক বা মুসলিম, পাকিস্তানি বলে কেলালেই দেশপ্রেমিক। খুঁজে খুঁজে হেঁসেল থেকে ‘গরু’ খুঁজে বার করলেও দেশপ্রেমিক। মাত্তায় তিন ফেট্টি বেঁধে, গলা চিড়ে জয় সিয়ারাম বললেও দেশপ্রেমিক। এমনকি, সেনার পোশাক বা টুপি পড়ে টপাটপ সেল্ফি তুললেও দেশপ্রেমিক। দেশদ্রোহীদের’ও আকাল নেই। কারণ, তুমি দেছদোহী প্রমাণ করতে পারলেই যে আমি দেছপেমিক। এই সহজ ইকুয়েশনটা ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছে আমার দেশ।

ভয়টা ঠিক এইখানেই। দেশপ্রেমের সামাজিকীকরণ হয়েছে, হচ্ছে এবং খুব দ্রুত। না, ঠিক দেশপ্রেমের নয়। দেখা যাওয়া দেশপ্রেমের। দেখানো যাওয়া দেশপ্রেমের। শোনা যাওয়া দেশপ্রেমের। শোনানো যাওয়া দেশপ্রেমের। দেশপ্রেমের মতো স্বাভাবিক নিরীহ অন্তর্মুখী শব্দটার এই সশব্দে ফেটে পড়াতেই সুষুম্না বেয়ে হিলহিলে সাপ হেঁটে যায়। ভয় হয়, ভীষণ ভয়। দেশের সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে দেওয়া এখন নতুন ট্রেন্ড এবং সুচারুভাবে। মেক ইন্ডিয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারত, হিন্দুস্তানের হতে হেঁটে চলে গেল যেদিন, যাচ্ছে দেখে বুঝতে পারি, এটা মোটেই এমনি এমনি নয়। এই আড়ম্বরটাই ভাবতে বাধ্য করে, এটা কোনও শাক দিয়ে মাছ ঢাকা নয় তো?

দেখুন, খুব স্পষ্ট করেই বলি। বিগত বছরগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যর্থ, এমন নয়। বরঞ্চ ভয়ংকর ভাবে সফল। ২০০% সফল। যা করতে চেয়েছে, যা লক্ষ্য নিয়ে নেমেছিল, তাই করেছে। বরঞ্চ ফেসবুকের কল্যাণে, সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে এবং কর্পোরেট হাউস নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার প্রচারে তারা সাফল্যের হার দ্বিগুণ বাড়িয়ে নিতে পেরেছে।  দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ জাস্ট আই-ওয়াশ। চোখে ধুলো দেওয়া বা দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখার কৌশল। এই আফিংটা ছাড়া যে আর কোনভাবেই, নিশ্চিন্তে লুট করা যেত না ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদ। যুদ্ধ যুদ্ধ নেশায় ব্যস্ত না রাখলে যে, মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া যেত না খিদে। বেকারত্ব থেকে কৃষি, হাজারো সমস্যা থেকে দূরে রাখা যেত না। সবচেয়ে বড়ো কথা দেশের টাকা নিশ্চিন্তে ব্যক্তি, দল, সংগঠন এবং কর্পোরেট হাউসের পকেটে ভরতে গেলে, এমনই একটা শিওর শট তারিকা লাগে। লাগে একটা দীর্ঘ পরিকল্পনা। প্রয়োজন একটা অব্যর্থ ছেলে ভোলানো ছড়ার। চাণক্য পড়বেন, কৌটিল্য পড়বেন, জেনে যাবেন বা বেদ। এই মুহূর্তে জাতীয়তাবাদের থেকে বড়ো তামাশা আর কিছু আছে নাকি বা ভারত ভোলানো ছড়া?

মানুষ যদি বোকা হয়, তাদের কী দোষ? তারা ঠিক করেছে, বেশ করেছে। আমি হলেও তাই করতাম। ‘এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই’। যুগে যুগে রাজারা তাই করেছে। আগে দোসর ছিল পুরোহিত এখন কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া। যারা নতুন করে ভারতের ইতিহাস লিখছে, বেদ-উপনিষদের নতুন ভাষ্য-টীকা দিচ্ছে, তাদেরকে কী এতটাই বোকা ভেবেছেন? আপনারা ভাবছেন, কী বোকা কী বোকা। কিছুই জানে না। আর হেসে মরছেন। তারাও বিপরীতে ঠিক একই, হাসছে। পার্থক্যটা শুধু খাদ্য আর খাদকের।

সেদিন দেখলাম কিছু ছেলে, তীব্র বেগে বাইক নিয়ে র‍্যালিতে। জাতীয় পতাকা উড়ছে পতপত, হ‍্যান্ডেলে। সিটি মারছে আর জয় হিন্দ। হাত ছেড়ে, গা নাচিয়ে, দেশপ্রেমের চিয়ার্স। বয়স কতো হবে, চোদ্দ থেকে ষোল। কিছুদিন আগেই ওদের হাফপ্যান্ট পড়ে ঘুরতে দেখেছি, তার’ও আগে কিছুই নেই। সে যাইহোক, ওরা এখন এয়ার স্ট্রাইকের সাফল্য সেলিব্রেশন করছে, বাইকটাকেই মিরাজ ভেবে।

হয়তো ওই বয়সটা পেরিয়ে এসেছি বলেই বুঝতে পারছি, দোষ ওদের নয়। ওদের কিছু একটা চায়, দামাল হতে। যা হোক কিছু একটা, বসে থাকার বেলা যে নয় ওটা। আর ভাবছিলাম

ভাগ্যিস, তখন দেশ বলতে মিরাজ ছিল না বা বালাকোট। জাতীয়তাবাদ, তাই আজও আমার কাছে মিষ্টি লজেন্স। দেশপ্রেম, মুচমুচে মেরি বিস্কুট।

Facebook Comments

Leave a Reply