অনুবাদ কবিতা : হিন্দোল গঙ্গোপাধ্যায়
গ্রীক কবিতা – অর্থনৈতিক অবনমন ও ব্যয়সংকোচের আলোকে
দ্বিতীয় কিস্তি

Jazra Khaleed (জন্ম: চেচনিয়া ১৯৭৯)
গ্রিসের ফ্যাসিস্ট বিরোধী অন্যতম রাজনৈতিক কবি | তাঁর কাজ সমসাময়িক গ্রীস, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান বর্ণবাদজনিত অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আন্তর্জাতিক মাধ্যমে তাঁর কাজ বর্ণনা করা হয়েছে যে ‘এথেন্সের রাস্তায় দাঙ্গা বিস্তারকারী শক্তির রূপ’ হিসাবে। প্যারিস ফেস্টিভালে এবং বিভিন্ন পরীক্ষামূলক সিনেমা এবং বালকান বিওন্ড বর্ডারস শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে তাঁর ছবি ‘The AEGEAN or the Anus of Death ‘ পুরস্কার জিতেছে| ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের প্রকাশনাগুলির জন্য তাঁর কবিতাগুলি ব্যাপকভাবে অনুবাদ করা হয়েছে। Teflon এর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সম্পাদক হিসাবে এবং বিশেষ করে সেখানে প্রকাশিত তার নিজের অনুবাদগুলির মাধ্যমে, তিনি অমিরি বারাকা, কেস্টন সেথেরল্যান্ড এবং অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক ও পরীক্ষামূলক কবি গ্রীক পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন।
১.
তবুও জীবন
উষ্ণ দুপুর আমায় পঙ্গু করে দেয়
দুদিন আগে আমি শেষ খেয়েছিলাম,
গর্ভে প্রচন্ড ঝড় ফুঁসে উঠছে
শিশুরা আর আমার পাড়ায় খেলতে আসে না
প্রেমিকেরা পরে নেয় ঘোড়দৌড়ের টুপি
তাদের চুম্বনের মতোই তারা বৈচিত্রহীন,
কনুই ঝুলিয়ে রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে চলে যায়
আমার আশপাশের দেওয়ালে ক্রমশ জমে ওঠে খবর
আর উল্লাসের শব্দ পচে যায় গুলিবিদ্ধ পুলিশের মত
আমি প্রতিদিনের কসাইখানায় মাংসকাটা ছুরি বিক্রি করি
বাড়ি থেকে মেট্রোর দিকে যাওয়ার সময় রোজ লিখি একটি করে কবিতা
স্পর্শিত হবো বলে, আমি অপেক্ষা করছি
২.
পদ্মভোজী
জীবন গুণতে হয় প্রশ্বাস ও অভিঘাতে
বিদ্যুৎসম ব্যথার প্রাবল্যে
সংঘবদ্ধ প্রণয়ে
বেঁচে থাকার বছরগুলো দিয়ে নয়
কাকে সুরাপাত্র হাতে দেওয়ার পরেও মদ্যপ হয়ে যায়নি?
সূর্যালোক প্রতিজ্ঞার পর কাকে পরিয়ে দেওয়া হল কালো চশমা?
উপহার হিসেবে কাকে একটা গাছ দেওয়ার পরেও সে তার ছায়ায় ঘুমোলো না?
যারা পড়ে রয়েছে তাদের প্রতি শোক রেখো না
দুঃখিত হও যারা চলে গেছে তাদের ভেবে
তোমার সমবেদনা তুলে রাখো ওডিসাসের জন্য
যারা অলস সুখে কাল কাটিয়েছে, শক্ত করে তোলো তাদের হাত
৩.
শব্দেরা
আমার কোনো পিতৃভূমি নেই
আমি শব্দের মধ্যে বেঁচে থাকি
তারা কালো দিয়ে আবৃত
এবং বন্দী
মুস্তাফা খয়াতি, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?
ক্ষমতার গদি সাহিত্যের অন্তরালে উঁকি মারে
যেখানে পুলিশ রোঁদে বেরোয়
সেখানে আর কোনো কবিতা জমে না,
কোনো কবি হন না পুরষ্কৃত|
আমার পাড়ায় তরুণ কবিরা বলিদান দিয়েছে
ধুলোটে চোখ আর বেঢপ প্যান্ট পরিহিত র্যাপ গায়কেরা,
শিশুদের সানুনাসিকতায় ছড়া ভরে দেয়|
পতন ও পুনর্বার উঠে আসা, এই তো কবির প্রকৃতি..
জিন গেনেট, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?
আমার শব্দরা গৃহহীন,
ক্ল্যাফটমনোস স্কোয়ারের বেঞ্চে তারা ঘুমিয়ে থাকে
IKEA এর মালবাহী বাক্সে ঢেকে যায় তাদের দেহ
আমার শব্দরা কথা বলে না খবরে
বরং হৈ হৈ করে পথে নামে প্রতি রাত্রিবেলা
আমার শব্দরা আমার মতোই সর্বহারা, ভৃত্যশ্রেণী
দিবারাত্র হাড়ভাঙা খেটে তারা ঘাম ঝরায়
আমি আর কোনো গাথা চাইনা
চাইনা আর কোনো ক্রিয়াপদ থাকুক অযোদ্ধাদের জন্য
এক নতুন ভাষা আমি চাই যাতে দালালি থাকবে না
আমাকে আবিষ্কার করবে, এমন এক বিপ্লবের অপেক্ষা করে আছি
আমি ক্ষুধার্ত এক রাজকীয় যুদ্ধের জন্য
যার ভাষা স্বাদ পেয়েছে বিদ্রোহের
আমিই তা তৈরী করবো
আঃ , কি ঔদ্ধত্য!
এবার যেতে হবে
কিন্তু তাকিয়ে দেখো, আমার মুখে একটা নতুন কবিতার ভোর জেগে উঠছে
কোনো কবিতাই আর পেছনে পড়ে থাকবে না, আটক থাকবে না জরিমানাস্বরূপ
আমি খুঁজে চলেছি তার জন্য এক নতুন উত্তরণ|
৪.
বিরত
আমার নাম J-A-Z-R-A
আমার জন্ম হয়েছিল আঁধারঘেরা পশ্চিমে –
অবৈধভাবে, বামেদের সবরকম কড়া প্রচেষ্টা সত্ত্বেও|
আমার সেরা সময় ছিল রাত্রিবেলা,
যখন আমি ফ্যাসিবাদীদের মাথা চূর্ণ করে বেড়াতাম
৫.
আজ রাতে মৃত্যু
আজ মৃত্যু বিপত্নীক হবে
রৌদ্রে এখনো লিপ্সাতুর হয়ে আছে মেশিনগানেরা
সৈন্যরা ফিরে যায় নিজেদের দেশে
নপুংসক হয়ে
বিকলাঙ্গ হয়ে
গুলিবর্ষণ ও ধর্ষণে অপটু হয়ে
মৃত্যু তাদের আঙুলে রজনের আঠার মত লেগে আছে
তাদেরই নিজস্ব মৃত্যু
দিন এসে দাঁড়ায় পরীক্ষাকেন্দ্রে
মুসলিম মায়েদের মত এই দিন
যাদের কাগজপত্র নেই, যারা দ্বীপান্তরিত হয়েছে
আজ মৃত্যু বিপত্নীক হবে
আমি দেখছি, পপকর্ন চিবোতে চিবোতে মঞ্চপ্রবেশের ঠিক আগে
শান্তি তার ভ্রূ উপড়ে নিচ্ছে
রাজপথে উন্মত্ত জনসাধারণ
নির্দোষদের ওপর বোমাবর্ষণে ,
অভিবাসীদের নির্বিচার খুনে ,
সভ্যতার বিজয়ে,
গণতন্ত্রের জয়ে ,
সোল্লাসে হাততালি দেয়
প্রথম বিশ্বের এ এক নগ্নতার উৎসব|
আজ মৃত্যু বিপত্নীক হবে
লাঞ্চিতা মহিলাদের আর্ত চিৎকার আমার শ্রবণ বধির করে দেয়
থরে থরে সাজানো বোমা ছিদ্র করে দেয় আমার পাকস্থলীতে,
আমি চাঁদকে নিয়ন্ত্রণ করি-
নিয়োগ করি জোয়ার ও ভাটাকে,
আর মাধ্যাকর্ষণকে কয়েদ করার চেষ্টা করে পুলিশেরা|
আবারো একটা অঘোষিত যুদ্ধ
গুণ্ডাদলের সন্ধানী আলোয়
শিশুদের চোখ কালো রঙে ঝলসে উঠতে দেখি
যা পোড়া ছাইতে ঘেরা,
ঘেরা তীব্র ঘৃণায়
এবং অনুতাপহীন
বিস্মৃতি আরো একটি গণহত্যার মহড়া বিক্রি করছে আন্তর্জালে
আগামীকাল শব্দটির ইতিমধ্যেই কোনো ভবিষ্যৎ নেই আর
আজ রাত্রেই আমাদের মৃত্যু সমাগত
Stathis Baroutsos (জন্ম: জার্মানি, ১৯৮০)
অনুবাদক পিটার কনস্টান্টাইনের সাথে একটি সাক্ষাত্কারে ব্লগ কবি স্ট্যাথিস অনলাইন পত্রিকা ‘ওয়ার্ডস বিয়ন্ড বর্ডার’ এ আত্মপ্রকাশ করেন এবং ইংরেজি মানচিত্রে স্থান পান| ইংরেজি, স্প্যানিশ, কাপাম্পাঙ্গান, তাগালগ এবং জাপানিজ ভাষায় ব্যাপকভাবে অনূদিত হওয়া সত্ত্বেও, তিনি গ্রীসে প্রকাশিত হননি, যেখানে তিনি বড় হয়েছিলেন।
৬.
আমার সন্তানেরা
আমার সন্তানেরা নোংরা তক্তার নিচে খুপরিতে থাকে
তারা দেখতে পায় না ওদের উষ্ণ করে তোলা আলো,
ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারেনা,
বড় সবুজ পাতায় গুন্ঠিত পোকাদের মত বাঁচে আমার সন্তানেরা
যাদের বেরিয়ে আসা নিরাপদ নয়
কাঠের খাঁচার নিচে পরম প্রিয়তায় সূর্যঘেরা বড় সবুজ বাহুগুলি ঘিরে রাখে ওদের
শুধু কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার জন্যই ছোট্ট বাসায় ওরা উত্তর ফিসফিস করে
সূর্যের আক্রমণ যখন ছুরির মত তীক্ষ্ণ রশ্মিময়, সেনাছাউনির মাটিতে তাদের অক্ষত রাখে সবুজ আলিঙ্গন
যেখানে তারা শুধু কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার জন্য উত্তর ফিসফিস করে
আর এভাবেই, সুধার আড়ালে মেপে চলে সময়, যতক্ষণ না পর্যন্ত আবার একটা মধুসন্ধানী নাচ শুরু হচ্ছে
৭.
টেক্সট মেসেজ
– আজকের রাত খুব বড়
– হ্যাঁ, সকালের মধ্যেই সব দুঃস্বপ্নেরা আত্মহত্যা করে ফেলবে
– যতক্ষণ না পর্যন্ত ওরা আমাকেও ওদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে
– কাল তুমি একটি নতুন পাতায় পরিণত হচ্ছ
– আমি আমার নতুন পাতা পুড়িয়ে দিয়েছি, সারা পৃথিবীর গ্রীষ্ম আমার সাথে ছিল আর আমি সেগুলোকে ছবিতে রূপান্তরিত করে দিয়েছি
– নক্ষত্রদের একটা চামচে দ্রব করে ফেলো
– আমি শুয়ে শুয়ে আমায় জীবন কাটাতে চাইনা, আমি নিজের হাতে খেতে চাই| নাহলে আর আমার হাতের কি ব্যবহার হলো!
– আমি তোমার চোখের তারাগুলোকে সামলে রাখছি যাতে ওরা ফেটে না পড়ে, তোমার গ্রীষ্মকে জীবিত অবস্থায় কিভাবে তোমাকে ফেরত দেব আমি?
– আমি খুব ক্লান্ত| আমি ঘুমোতে যাচ্ছি …
৮.
কলতান
গোলাপি জামা পরিহিত লোকটা ভাঁটিখানায় আমার ঠিক পাশে এসেই বসল| গোলাপি জামা আর একটা গোলাপি গেঞ্জি সে পরে আছে| সে সাবধানে তার পানীয়তে চুমুক দিচ্ছিল, যাতে একফোঁটাও নিচে না পড়ে, আর প্রতিটি সিগারেট ধীরে ও অকম্পিত স্থিরতায় ধরাচ্ছিল| ধূমপানের শেষে, ছাইদানিতে সেটার অবশেষে সে সাতবার গুঁজল, নিশ্চিত হওয়ার জন্য| একটা হাত গ্লাসে রেখে, অন্য হাতে সে টিপে যাচ্ছিল প্রিয় বন্ধুর নম্বর|
সত্যি বলতে কি, আমি কোনোদিনই আগ্রহ নিয়ে শুনিনি কিভাবে ৯ বা ১ এর শব্দ হয় কিপ্যাডে| সে আমাকে মন দিয়ে লক্ষ্য করছিল এবং মনোযোগ দিয়ে আমার সবকথা শুনছিল| গোলাপি জামা আর গোলাপি গেঞ্জি পরা লোকটি তার পানীয় শেষ করল, উঠে দাঁড়াল, আর সুভদ্রভাবে জানালো বিদায়| সে জানালো কালকে সে শহরতলিতে বেড়াতে যাচ্ছে, যাতে সে পাখিদের ডাক শুনতে পারে| সে নিজে একটা গান গাইবে, আর তারপর তার রেডিওটার পাশে গুটিসুটি ঘুমিয়ে পড়বে সন্ধ্যাবেলা|
Posted in: April 2019, Translation