জাতীয়তাবাদ ও আজকের ভারত : রবীন্দ্রনাথকে ফিরে পড়ার ব্যক্তিগত রাজনীতি – ভিষক গুপ্ত

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর একটি বিখ্যাত ও বহু-আলোচিত বক্তৃতায় [যা পরবর্তী সময় প্রবন্ধকারে মুদ্রিত/প্রকাশিত], বেশ কিছুটা আলোচনার পর একটি মন্তব্য করেছিলেন, একটি নতুন অনুচ্ছেদের গোড়ায়, পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদগুলির সংযোগে:

        এই কারণে তাঁর [রবীন্দ্রনাথ-এর] সমাজচিন্তা আজ আমাদের কাছে বহুলাংশে অবান্তর হয়ে গেছে [১]  

        আমার এই জায়গায় একটা খটকা লাগে। এই ‘আমাদের’ শব্দটা নিয়ে। আমাদের বলতে বক্তা/লেখক ঠিক কাকে বোঝাতে চাইছেন, তাঁর মাপের বা আশপাশের পণ্ডিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন, অথবা বিদ্যাচর্চাকারী কিছু ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠীই তাঁর উদ্দিষ্ট কিনা—নাকি আমার/আমাদের মতো অদীক্ষিত/অশিক্ষিত শ্রোতা/পাঠকও তাঁর ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে, সেটা ঠিক খোলসা করে বলা নেই।

        এই অনুচ্ছেদেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ-এর সমাজচিন্তার অপ্রাসঙ্গিকতা [অবান্তর-এর চেয়ে অপ্রাসঙ্গিক বোধহয় একটু নিরামিষ শব্দ] বোঝানোর উদ্দেশ্যে নিজস্ব যুক্তিগুলি উপস্থাপনা করেছেন। বলেছেন: আজ ন্যায়-অন্যায় মঙ্গল-অমঙ্গলের প্রশ্নে কোনোরকম সার্বজনীন [যদৃষ্ট] ধ্রুব সত্যের ঘোষণাকে আমরা সন্দেহের চোখে দেখি। সত্য আমাদের কাছে আর সাদা-কালোর নিশ্চিত পার্থক্য নিয়ে দেখা দেয় না। ন্যায়-অন্যায়ের জগৎ আমাদের চোখে ধূসর, ফিকে, গাঢ় নানা আস্তরে ধূসর। [২]

        এই বাক্যগুলির পরেই বক্তা/লেখক আমাদের [মানে, শ্রোতা/পাঠক—যার মধ্যে আমার মতো লোকও থাকতে পারে] জানিয়ে দেন: মঙ্গল-অমঙ্গল আমরা বিচার করি নিত্যধর্মের সূত্র মেনে নয়, সামাজিক ব্যয় আর লোকহিতের তুলনামূলক হিসেব কষে। [৩] ‘আমরা’/ ‘আমাদের’ শব্দগুলো নিশ্চিতভাবেই এক উচ্চবর্গীয় বুদ্ধিমান ব্যক্তিকুলকে নির্দেশ করছে, এবার এটা বুঝে নেওয়া যায়।

        গাণিতিক হিশেবে, বহুঘাতমূলক সমীকরণ (polynomial equations) অজ্ঞাতপূর্ব বা নির্ণেয় x-এর n সংখ্যক মান হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, n বা যে কোনো মানের রাশি দিয়ে সমীকরণটি সাজানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে x বা সত্য, সমীকরণ সাপেক্ষে n সংখ্যক বা অসংখ্য হতে পারে। এই গাণিতিক ছকের বাইরে গিয়েও কিন্তু সমাজ বা সমাজ-বাস্তবতার বিভিন্ন স্থান বা Space-কে দেখা যায়। সেখানে, ধূসরতার নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট ক্ষেত্র বাদ দিলেও, কিছু শাদা-কালোর বিভেদ Binary-র হিশেবে থেকে যায়। নিতান্ত ত্রিশঙ্কু অবস্থান না হলে, দারিদ্র-অসাম্য-বর্ণভেদ এসব দিয়ে মানুষকে যে সহজেই চিহ্নিত ও বিভাজিত করা হয়েছে, এটা বুঝতে কোনো ধোঁয়াশা থাকে না। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-র মাপের কবি ও প্রাবন্ধিক একদা ফ্যাসিবাদ ও সমাজবাদ/সাম্যবাদ-এর মধ্যে তফাৎ খেয়াল করতে পারেন নি। ব্যক্তিগত মানসিক গঠন, রাজনৈতিক ধারণা, পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব, সংশয়ের আচ্ছন্নতা—এমন বিভিন্ন কারণে ভাবনায় বিচার-বিশ্লেষণে নানান রকমের ব্যাখ্যান দেখা যায়। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে দিল্লির সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া ছাত্র যত সহজেই রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে শনাক্ত করতে পারেন—বিলেত-ফেরৎ উচ্চস্তরের রাজনৈতিক নেতার পক্ষে সেটা সম্ভব না-ও হতে পারে—রাষ্ট্রিকতাকে শুধুমাত্র ‘কর্তৃত্ববাদী’ বলেই তিনি থেমে যান। অ্যাকাডেমিক পাণ্ডিত্যের প্রথাবদ্ধতা সমাজচর্চায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে মান্যতা দেবে কিনা, কতখানি দেবে—এইসব বিষয়ে আমাদের ধারণা কী? আমাদের অভিজ্ঞতাই বা কী?

        যেখানে শাদা-কালোর বিভাজনটা আদর্শগত ভাবেই স্পষ্ট, সেখানে ধূসরতা আবিষ্কার করার শৈল্পিকতা আমাদের ক্লান্ত করে। জাতিবিদ্বেষ বা উগ্র-জাতীয়তাবাদী আগ্রাসন, পুঁজিবাদী শোষণ বা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ—এ ধরনের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে পক্ষ নির্ণয় কোনো কেতাবি ছলাকলায় এড়িয়ে যাওয়া, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো।

        রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আর দু’একটা কথা বলার আগে হালফিলের কিছু বিষয়কে একটু ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা যাক। কুণাল কামরা এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় Standup Comedy Show-এর উপস্থাপক [আমার মতে, এ ধরণের প্রযোজনার নায়ক]। দেশের বর্তমান সরকার তথা শাসক দল, যার পেছনে সক্রিয় রয়েছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, তাদের নিয়ে আপাত খিল্লির মোড়কে তীক্ষ্ণ সমালোচনা করার সাহস আছে এই ব্যক্তিটির। তিনি সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তুলতে পারেন: জাতীয়তা বলতে দেশের বর্তমান শাসকদল কী বোঝে বা বোঝাতে চায়? তাদের অসহিষ্ণুতা এমনই প্রকট যে তাদের কেউ সমালোচনা করলে তাকে দেশদ্রোহী বলা হয় অথবা পাকিস্তান-এ পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

        জাতীয়তা বা জাতীয়তাবাদের ধারণাকে দেশপ্রেমের সঙ্গে গুলিয়ে দেওয়ার কাজটা দেশের বর্তমান [2014-2019] শাসকদল সুকৌশলে চালিয়ে যাচ্ছে। এবং প্রত্যাশিতভাবেই, দেশের সচেতন মানুষ এই কুনাট্যের বিরোধিতা করার চেষ্টা করছেন। যদিও এটা ভবা অবান্তর যে প্রচুর লোকজন দলবদ্ধভাবে পথে নেমে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। Social Media-তেও জাতীয়তাবোধ নির্মাণের ছকের বিপক্ষে স্বর শোনা গেলেও, পক্ষাবলম্বীদের শোরগোলও কিছু কম নয়। তথাপি, JNU-তে কানহাইয়া কুমার (AISF নেতা/JNUSU-এর তৎকালীন সভাপতি) [ও উমর খালিদ-অনির্বাণ ভট্টাচার্য]-দের বিরুদ্ধে উগ্র-জাতীয়তাবাদী জিঘাংসার প্রেক্ষিতে—দাভোলকর-পানসারে-কলবুর্গি-গৌরী লঙ্কেশ প্রমুখের হত্যার পরে—কাঠুয়ায় আসিফা-র ধর্ষণ ও খুনের প্রতিক্রিয়ায় দেশের মানবিক মন বিচলিত হয়েছিল। কুণাল কামরা বা বরুণ গ্রোভার-এর Standup Comedy Show, ভারত দেশটির সেই সচেতন তর্কপ্রিয়তার অন্যতর বহি:প্রকাশ। এঁদের উপস্থাপনার তির্যক ভাষা কোথাও গিয়ে পরিপূরক হয়ে ওঠে কানহাইয়া কুমার-এর রাজনৈতিক বক্তব্যর সহজিয়া প্রকাশভঙ্গীর। [৪] এটাও আধুনিক ভারতের ভাষা। যেখানে রাজনীতি তার পরিচিত অবয়ব ও আয়ুধকে পালটে নিতে চেষ্টা করছে, সময়ের নিজস্ব চাহিদাকে স্বীকার করে।

        বরুণ গ্রোভার যখন বিক্রম চন্দ্র-র লেখা কাহিনী [Harper Collins প্রকাশিত 2006] থেকে Sacred Games [Web Series / Phantom Films প্রযোজিত / Netflix 2018]-এর চিত্রনাট্য নির্মাণ করেন, তখন কি সেই সচেতন প্রজ্ঞারই প্রতিফলন দেখা যায় না? যেখানে গণেশ গায়তোন্ডে (ছবির মুখ্য খলনায়ক; নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী অভিনীত চরিত্র) রাজনীতি (ব্যাবহারিক / সংসদীয় ক্ষমতা সর্বস্ব রাজনীতি > দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা) ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থার (যার মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বাণিজ্য বা বিনোদন সবই কুৎসিত ভাবে জুড়ে থাকে) সম্পর্ক নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করতে পারে, ছবিতে ভারত দেশটির শরীরে লেগে থাকা ক্ষতচিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাবরি মসজিদ ভাঙা ও করসেবকদের উল্লাসের ছবি, বোম্বাই (মুম্বই) দাঙ্গার ভয়াবহতা। ছবিটি শেষপর্যন্ত কোথায় পৌঁছেছে, সে আলোচনার জায়গা এটা নয়—কিন্তু, ধর্ম ও রাষ্ট্র ক্ষমতার গোপন ও প্রকাশ্য বোঝাপড়ার যে ছবিগুলো বিভিন্ন সময়ে চলচ্চিত্রে জায়গা করে নিয়েছে, হয়তো নিতান্ত মোক্ষণ বা Catharsis-এর অতিরিক্ত কোনো গুরুত্বও এদের থাকতে পারে না, সেখানেও একটা বিষয় অনিবার্যভাবেই উপেক্ষা করা যায় না—সেটা হলো, রাষ্ট্র নির্মাণের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করা নিয়ে অনতিউচ্চকিত সমালোচনা। ধর্মবিশ্বাসকে গ্রাস করতে চায় যে ধর্মমোহ, সেই বাস্তবতার চলচ্চিত্রায়িত রূপকে ভারত এড়িয়ে যেতে পারে না।

খেলার দুনিয়া বাদ দিলে (বিশেষত, অতীতে হকি বা ফুটবল, পরের দিকে ক্রিকেট০, আর যে বিষয়ের একটা দেশতগ গ্রহণযোগ্যতা ছিল (বা আছে) সেটা হিন্দি সিনেমা। কিন্তু গত বেশ কয়েকবছর ধরেই মূলধারার হিন্দি ছবিতে এক জাতীয়তাবাদের পাঠ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে জাতীয়তাবাদী (=দেশপ্রেমিক) (হিন্দু চরিত্র) hero-র সঙ্গে থাকতে পারে (সহকারী হিশেবেই) কোনো এক ভালো মুসলমান, যারা (খারাপ) মুসলমান-কে (দেশদ্রোহী=সন্ত্রাসবাদী) হারিয়ে দিচ্ছে বা মেরে ফেলছে। এমন ছবি বানানো হচ্ছে যেখানে বলতে চাওয়া হচ্ছে, পাশের দেশ (=পাকিস্তান)কে (যেন সেই দেশের সব মানুষই সন্ত্রাসবাদী), শায়েস্তা করাটাই দেশপ্রেম। আমাদের মনের গভীরে থেকে যাওয়া অজ্ঞতা, ভুল ধারণা, ইতিহাস-বোধের অভাব–সর্বব্যাপী রাজনীতিহীনতা–এর ফলে নির্মিত হচ্ছে এক উগ্র জাতীয়তার আধার।

        এখানে দাঁড়িয়ে আমরা আরেকবার ‘অবান্তর’ হয়ে যাওয়া রবীন্দ্রনাথ-এর সমাজচিন্তার একটা বিশেষ অধ্যায়কে পড়ে নিতে চাই।

        গোরা [৫] তার আত্মআবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যে ভারতবর্ষকে আবিষ্কার করেছিল, সেটা স্বদেশের সত্তাকে নিছক আবেগসর্বস্বতার বাইরে এনে বিচার করতে শেখায়। এই উপন্যাসিক পরিক্রমা যেমন একটি চরিত্রর, তেমনই কি সেই লেখকেরও বৌদ্ধিক অভিযাত্রা নয়? আত্মপরিচয় জানার আগে, পরাধীন দেশের একজন নাগরিক হিশেবে গোরা আত্মসম্মান অর্জনের উদ্দেশ্যেই “… স্বদেশের সমস্তকেই অত্যুজ্জ্বল ভাবের আবরণে ঢাকিয়া রাখিতে অহোরাত্র চেষ্টা করিয়াছে।… সবই ভালো, যাহাকে দোষ বলিতেছে তাহা কোনো-এক ভাবে গুণ, ইহা যে গোরা কেবল উকিলের মতো প্রমাণ করিত তাহা নহে, ইহাই সে সমস্ত মন দিয়া বিশ্বাস করিত।” কিন্তু আনন্দময়ীর কাছে নিজের জন্মের কাহিনী জেনে গোরা অন্য এক ভারতবর্ষকে চিনতে চাইল, যা কোনো সঙ্কীর্ণ জাতিপ্রেম দিয়ে খণ্ডিত নয়: “আজ আমি ভারতবর্ষীয় (আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খৃস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন। … এতদিন আমি আমার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অদৃশ্য ব্যবধান নিয়ে ঘুরেছি—কিছুতেই সেটাকে পেরোতে পাইনি। সেজন্যে আমার মনের ভিতরে খুব একটা শূন্যতা ছিল। এই শূন্যতাকে নানা উপায়ে, কেবলই অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছি—এই শূন্যতার উপরে নানাপ্রকার কারুকার্য দিয়ে তাকেই আরো বিশেষরূপ করে তুলতে চেষ্টা করেছি!”

        1916 সালের 7 সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ জাপান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রওনা হয়ে 8 সেপ্টেম্বর সিয়াটেল-এ পৌঁছন। যদিও পন্ড নিমাসিয়াম ব্যুরো কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ ওখানে গিয়েছিলেন বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বভারতীর [তখন ব্রহ্মচর্যাশ্রম / শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়] [৬] জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে, কিন্তু অধিকাংশ জায়গাতেই তিনি বক্তৃতা করলেন Personality ও Nationalism বই দুটোর প্রবন্ধগুলি পাঠ করে। এই সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদ বিরোধী প্রবন্ধগুলির অনেকগুলিই লেখা হয়েছিল জাপান-এর ওসাকা-য়। জাপানযাত্রী-তে রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন:

… চীনের নৌকার দল। সেই নৌকাগুলিতে স্বামী-স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে সকলে মিলে বাস করছে এবং কাজ করছে। কাজের এই ছবিই আমার কাছে সকলের চেয়ে সুন্দর লাগল। কাজের এই মূর্তিই চরম মূর্তি; একদিন এরই জয় হবে। না যদি হয়, বাণিজ্যদানব যদি মানুষের ঘরকরনা স্বাধীনতা সমস্তই গ্রাস করে চলতে থাকে, এবং বৃহৎ এক দাস-সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করে তোলে, তারই সাহায্যে অল্প কয়েকজনের আরাম এবং স্বার্থ-সাধন করতে থাকে, তা হলে পৃথিবী রসাতলে যাবে।

এর সঙ্গে যদি ওরা কাজ করে [৭]কবিতাটি মিলিয়ে পড়া যায়, তবে রবীন্দ্রনাথ-এর সমাজচিন্তা ও তার অনুপেক্ষণীয় বিচারবিশ্লেষণ বুঝতে খুব বেশি পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

        এবং রবীন্দ্রনাথ-ই আমাদের দেশে সম্ভবত প্রথম অমার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ যিনি জাতীয়তাবাদকে সমাজবাদের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্রে চিহ্নিত করতে চাইছেন, নিজের অভিজ্ঞতায়। এবং সেই অভিজ্ঞতালব্ধ দৃষ্টিভঙ্গি, মুসোলিনি-র কৌশলে একবার আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেও, পরবর্তী সময়ে সেই সাম্রাজ্যবাদী মোহজাল ছিন্ন করে রবীন্দ্রনাথ আর্ত মানবতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, স্পষ্ট করে দিয়েছেন নিজের অবস্থান।

        ন্যাশানালিজম (Nationalism) [৮] প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নেশন (Nation)-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক সংঘবদ্ধতার উদ্দেশ্য হিশেবে যান্ত্রিকতাকে চিহ্নিত করেছিলেন […organized for a mechanical purpose]। এর অনেক আগেই ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে ইংরেজ-শাসনের বিরুদ্ধে নিজস্ব এক সামাজিক ব্যবস্থাকে বিকল্প ধারণায় উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন। [৯] এবং ‘স্বদেশী সমাজ’ নামে এক সংগঠন তৈরি করতেও চেষ্টা করেছিলেন, যার ঘোষণা-পত্রে বয়কট বা অসহযোগ আন্দোলনের এক আদর্শগত প্রস্তাবনা লক্ষ্য করা যায়। ন্যাশানালিজম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা যে প্রকৃত প্রস্তাবে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতি কশাঘাত, সেটা বুঝেই মার্কিন কাগজ লিখেছিল: Such sickly saccharine mental poison with which that Tagore would corrupt the minds of youth of our great United States. 

১৯১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশানালিজম-কে আগ্রাসী ধনতন্ত্র বা সাম্রাজ্যবাদের উৎস হিশেবে চিহ্নিত করেছেন, সেটা আর্থনীতিকভাবে যথার্থ নয়। কিন্তু একজন সচেতন ক্রান্তদর্শী মানুষ হিশেবেই তিনি লেখেন: And the idea of the Nation is one of the most powerful anesthetics that man has invented. Under the influence of its fumes the whole people can carry out its systematic programme of the most virulent self-seeking without being in the least aware of its moral perversion…This European war of Nations is the war of retribution…The Nation has thriven long upon mutilated humanity.    

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে বিচলিত করেছিল। সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক অত্যাচারের সঙ্গে তার আগ্রাসী বীভৎসাকেও রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছেন, এবং সমালোচনা করেছেন। সেখানে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অন্তর্নিহিত পুঁজিবাদী তাড়নার সঙ্গে উদগ্র জাতিদম্ভকেও চিনতে ও চেনাতে চেয়েছেন বিভিন্ন লেখাতে।

“বহুযুগ হতে জমি বায়ুকোণে আজিকে ঘনায় — / ভীরুর ভীরুতাপুঞ্জ, প্রবলের উদ্ধত অন্যায়, / লোভীর নিষ্ঠুর লোভ, / বঞ্চিতের নিত্য চিত্তক্ষোভ, / জাতি-অভিমান, / মানবের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার বহু অসম্মান — / বিধাতার বক্ষ আজি বিদীরিয়া / ঝটিকার দীর্ঘশ্বাসে জলে স্থলে বেড়ায় ফিরিয়া। / … দুঃখেরে দেখেছি নিত্য, পাপেরে দেখেছি নানা ছলে; / অশান্তির ঘূর্ণি দেখি জীবনের স্রোতে পলে পলে; / মৃত্যু করে লুকাচুরি / সমস্ত পৃথিবী জুড়ি। / ভেসে যায় তারা সরে যায় / জীবনেরে করে যায় / ক্ষণিক বিদ্রূপ।” [১০]  

যেভাবে নির্দিষ্ট করে জাতিদম্ভ-জাতীয়তাবাদী উগ্রতা—সাম্রাজ্যবাদী লোভ-যুদ্ধোন্মাদনা-মানবতার অপমানকে কবিতায় সূত্রায়িত করেছেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সমাজসচেতনার প্রকাশ।

        এই কবিতার প্রায় চোদ্দ বছর আগে বিরোধমূলক আদর্শ [১১] –এ রবীন্দ্রনাথ ‘ব্যাপ্যমান মিলিটারিত্বের রক্তিমায় য়ুরোপের গণ্ডস্থান যে টকটকে হইয়া উঠিতেছে’, তাকে কুস্বাস্থ্য বা ‘ন্যাশনালত্বের ব্যাধি’ হিশেবেই চিহ্নিত করেছেন: “য়ুরোপের নেশনতন্ত্রে এই স্বার্থবিরোধ ও বিদ্বেষের প্রাচীর প্রতিদিনই কঠিন ও উন্নত হইয়া উঠিতেছে।” কবির চেতনায় যে মানবিক ধর্মবিশ্বাস, সেটা জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশানালিজম-এর আক্রমণে বিপর্যস্ত, এই বিষয়টা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। ‘শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ মাঝে / অস্ত গেল; হিংসার আজি বাজে / অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদরাগিনী / ভয়ংকারী। … / লোভে লোভে / ঘটেছে সংগ্রাম; প্রলয়মন্থনক্ষোভে / ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি / পঙ্কশয্যা হতে। লজ্জা শরম তেয়াগি / জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায় / ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়। [১২]

        সমাজবিজ্ঞানের পণ্ডিত অধ্যাপক তাঁর অ্যাকাডেমিক বিশ্লেষণে ক্ষমতাতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করেছেন: আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র ‘পাওয়ার’ বটে, কিন্তু তার ‘মেন্টার’ নেই। তাই রবীন্দ্রনাথও যে আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র নিয়ে লিখেছেন, একথা প্রমাণ করতে দেবেশবাবু যে ফিরিস্তি দিয়েছেন—এগুলো সব আধুনিক সমস্যা ঠিকই, একটাও ক্ষমতাতন্ত্রের অঙ্গ নয়। বরং এ-সবই আঠারো-উনিশ শতকে উদ্ভূত নেশন-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার অঙ্গ, যখন ইউরোপ-আমেরিকার কোনো দেশে সার্বজনীন [যদৃষ্ট] ভোটাধিকার চালু হয়নি [যদৃষ্ট]। বিংশ শতাব্দী জুড়ে এই সার্বভৌমত্বের জায়গা ক্রমশ দখল করে নিয়েছে সার্বজনীন [যদৃষ্ট] প্রশাসনিকতা, যে-প্রক্রিয়ায় শুধু পুঁজিবাদী গণতন্ত্র নয়, ইউরোপের ফ্যাসিবাদ আর সোভিয়েত সমাজবাদও অংশীদার। [১৩] পাণ্ডিত্যের ভার ও সূক্ষ্ম কৌশলে যেটা এড়িয়ে যাওয়া হলো বলে আমার মতো অশিক্ষিত পাঠকের মনে হয়, সেটা নেশন ও ন্যাশানালিজম-এর সঙ্গে আধুনিক পুঁজির সম্পর্ক, যা ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদকে অনিবার্যভাবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে রূপান্তরিত করছিল, যার অন্তর্নিহিত সংকটের অনিবার্যতা ডেকে এনেছিল বিশ্বযুদ্ধকে। ক্ষমতার বিস্তারের ছক পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের কাঠামোতে যেমন, ফ্যাসিবাদী শক্তি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পরেও কি সেই রকম? সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বনির্মাণে যারা পারদর্শী, এবং সোভিয়েত তথা সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ইউরোপ-এর পতনের পরে বিশ্ব জুড়ে ঘটে চলা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে যাঁদের লড়াই করার নূন্যতম মুরোদ নেই, তাঁরা অবশ্য ফ্যাসিবাদ ও সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার ভেতরে মিল আবিষ্কার করে তৃপ্তি বোধ করেন। এই জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথ আজকের ভারত-এ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। তিনি পেশাদার রাজনীতিক বা সমাজচিন্তক নন। বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিয়া-র কাছে তাঁর যত না দায়, মানবিকতা ও বিবেকের কাছে তাঁর দায়বোধ অনেক বেশি। সে দায়বোধের গভীরে তাঁর ধর্মচেতনার ভিত্তি যেমন সক্রিয় ছিল, আক্রান্ত বিশ্বমানবতা সম্পর্কে রাজনৈতিক উদ্বেগ কিছু কম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্ম সমাজ-এর সম্পাদক থাকাকালীন হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজের গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতাকে সমালোচনা করতে ছাড়েন নি। গোরা যখন চরঘোষপুরের গরীব চাষী ও নাপিতকে, নীলকুঠির সাহেবদের উৎপাতের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিচার করে ও তাদের পাশে দাঁড়ায়—সে তখন ভীষণভাবেই রাজনৈতিক, যে রাজনীতি মানবিকতাকে ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের ওপরে স্থান দেয়। আজকের ভারত-ও সেই মানবিক আদর্শকে উদ্ধার করতে চায়, রাজনৈতিক শাসন ও রাষ্ট্রক্ষমতার ভিত্তিতে, মতাদর্শগত তাত্ত্বিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চায়। সহিষ্ণুতা ও গ্রহিষ্ণুতার আবেদন নিয়ে রাষ্ট্রকে তার জাতীয়তাবাদী মতান্ধ পুনর্নির্মাণের বিরোধিতা করতে চায়।

        এখানে ভারত-এর রাজনীতিতে শ্রেণীর প্রাসঙ্গিকতাকে খর্ব করার প্রক্রিয়া সমূহকে একটু বুঝে দেখার প্রয়োজন আছে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র হয়েছে। কিন্তু জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে, বিষয়টিকে, এক নিতান্ত রাজনীতি কর্মীর দিক থেকে একটু পড়তে চাই। ভারতবর্ষ বা ভারত দেশটির নৃতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক-আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য বিচার করলে, এর জাতিগত বা বর্গগত সংঘাত ও সহাবস্থানের বিষয় নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গত শতকের ষাট ও সত্তর দশকের সময় থেকে দেশে রাজনীতিতে জাতি-নির্ভর (> জাতিসর্বস্ব) (আত্ম)পরিচয়ের রাজনীতি ক্রমশ প্রাধান্য পেতে থাকে। একধরণের অ্যাকাডেমিক সহায়তা একে শ্রেণীভিত্তিক রাজনীতির বিকল্প ভাষ্য হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক বিভাজন সাংগঠনিক পরস্পরবিরোধিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক বদ্ধদশা এই শ্রেণীবিযুক্ত রাজনীতির বিস্তারলাভের পক্ষে অনুঘটকের কাজ করে। এমনকি, ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে, জরুরি অবস্থার বিরোধিতার সুযোগে দলহীন রাজনীতি সুচতুর কৌশলে চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়া—যার আস্তিনে তখনও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা লুকিয়ে ছিল—বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সংগঠনের সঙ্গেও গণতন্ত্র রক্ষার agendum নিয়ে পা মেলায়। তার পরে গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, রাজনৈতিক সমীকরণ বারে বারেই বিভিন্ন বাঁক নিয়েছে, কিন্তু চরম বর্ণবাদী হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা সংসদীয় শাসনক্ষমতা দখল করেছে; নিজস্ব পরিসর দখল ও বিস্তৃত করেছে আঞ্চলিক পরিচয়-নির্ভর রাজনীতি। জাতিগত সমীকরণ নির্বাচনের অঙ্ককে প্রভাবিত করেছে; ক্রমশ প্রান্তিক করে দেওয়া হয়েছে শ্রেণীগত রাজনৈতিক সংগ্রামকে। বৃহৎ জাতীয়তাবাদ বনাম আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ—এদের কৌশলী সংঘাত ও সহাবস্থান ভারত-এর রাজনৈতিক পরিসরে আর্থসামাজিক বৈষম্য ও শ্রেণীসংগ্রামকে অবান্তর করে দিতে চায়। কর্পোরেট পুঁজি, মিডিয়া-র গরিষ্ঠ অংশ, অ্যাকাডেমিয়া-র বেশ কিছু অংশ—তারাও এটাই চায়।

        আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় লেখা থাকত: একটি জাতীয়তাবাদী বাংলা দৈনিক। বেশ কিছুকাল হলো, সেটা মুছে দেওয়া হয়েছে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর যে মৌলিক রাজনৈতিক অবস্থান, সেটা বামপন্থার বিরোধী (নিরপেক্ষতার অর্থ তাদের কাছে এমনটাই)। তারা যখন জাতীয়তাবাদের পক্ষে, তখন সেটা কোন্‌ জাতীয়তাবাদ—আর যখন জাতীয়তাবাদ উহ্য থাকে, তখনই বা প্রথম শ্রেণীর বাংলা দৈনিকের উদ্দেশ্য কী? তাদের পরিচালকবর্গ ঢের লেখাপড়াজানা, রাবীন্দ্রিক ন্যাশানালিজম সম্পর্কে তাঁদের বিস্তর জ্ঞান। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখরা যে চরমপন্থী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলতেন, সেই লাইনের থেকে বহুদূরে তাঁদের ব্যবসায়িক অবস্থান। সুতরাং জাতীয়তাবাদকে তাঁরা কি দেশপ্রেমের সমার্থসূচক হিশেবে ধরতে (ও পাঠককে মানাতে) চেয়েছেন? নাকি বামপন্থী / কমিউনিস্ট / সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিকবাদের (সর্বহারার আন্তর্জাতিকবাদের) বিরুদ্ধ ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল তার পেছনে?

        জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে যারা রাজনীতি করে, ব্যবসা চালায়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ঠিকেদারি করতে চায়—আজ না হলেও, আগামী কালের ভারত তাদের উদ্দেশ্যেও প্রশ্ন করবে। পাশ্চাত্যের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবিস্তার ও উগ্র জাতিদম্ভ রবীন্দ্রনাথকে যতটা বিচলিত করেছিল, এবং যেহেতু রবীন্দ্রনাথ সেই জাতীয়তাবাদের বিপ্রতীপ ভাবনায় তাঁর ভারতীয় বা এশিয়া অঞ্চলের ঐতিহাসিক পরম্পরাকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন, পরাধীন দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মানুষের জাতীয়তাবাদী উন্মেষ তাঁর কাছে ন্যাশানালিজম হিশেবে মান্যতা পায় নি। জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের লক্ষ্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটে—সেই বিষয়ে আজকের পৃথিবীতে নানান বিতর্ক, আমাদের দেশেও সে নিয়ে তর্কের শেষ নেই। ইওরোপ-এও সমাজতন্ত্রী সরকারের পতনের পর থেকেই নয়া মোড়কে নানান উগ্র জাতিদ্বেষ-উদ্ভূত জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে, neo-fascist বা neo-racist গোষ্ঠীর দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়া ও রক্ষণশীলদের মদত পাচ্ছে। ভারতেও বামপন্থী দলগুলির (কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য) ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় হিশেবেই প্রকট হয়েছে পরধর্ম বা পরজাতি-বিদ্বেষের রাজনীতি।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ জাতীয়তা/জাতীয়তাবাদ না থাকলেও হাল আমলের অভিধান শব্দটিকে এড়াতে পারে না—ঢাকা-র বাংলা একাডেমী (অক্টোবর 1999) সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান-এ nationality বা nationalism শব্দের অনুষঙ্গেই অর্থ নির্ণয় করেছে জাতীয়তা (ও জাতীয়তাবাদ)-র। Oxford অভিধান বরং স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে : [Nationalism] Identification with one’s own nation and support for its interests, especially to the exclusion or detriment of the interests of other nations [বাঁকা হরফ আমার]; দ্বিতীয় অর্থ হিশেবে উল্লিখিত আছে : Advocacy of or Support for political independence of a particular nation or people। রবীন্দ্রনাথ এই প্রথম অর্থটাই গ্রহণ করেছিলেন। আজকের ভারত-এও সেই অর্থটাই সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।

সূত্র নির্দেশ:

১। রাবীন্দ্রিক নেশন কী? / প্রজা ও তন্ত্র / অনুষ্টুপ

২। ঐ

৩। ঐ

৪। YouTube-এ এদের অনেক Video আছে।

৫। গোরা / প্রথম প্রকাশ প্রবাসী পত্রিকায় [ভাদ্র ১৩১৪ – ফাল্গুন ১৩১৬]; গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৩১৬।

৬। বিশ্বভারতী নামকরণ ৮ই পৌষ ১৩২৮ (১৯২১); ব্রহ্মাচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা ৭ই পৌষ ১৩০৮ (১৯০১)।

৭। ওরা কাজ করে / আরোগ্য ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪১।

৮। Nationalism-এ অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধ : Nationalism in the West, Nationalism in Japan ও Nationalism in India.

৯। চৈতন্য লাইব্রেরি-র বিশেষ অধিবেশনে (৭ শ্রাবণ ১৩১১; ২২ জুলাই ১৯০৪) মিনার্ভা থিয়েটার হল-এ পঠিত। 

১০। ঝড়ের খেয়া / কলকাতা ২৩ কার্তিক ১৩২২ / বলাকা।   

১১। প্রকাশকাল আশ্বিন ১৩০৮।   

১২। শতাব্দীর সূর্য আজি / নৈবেদ্য ৬৪ সংখ্যক কবিতা [‘নৈবেদ্য’-র কবিতাগুলির রচনাকাল ১৩০৭; পুস্তিকাকারে প্রকাশ ১৩০৮]

এই কবিতার পটভূমিতে আছে বোয়ার (Boer) প্রজাতন্ত্রে সোনারখনি আবিষ্কার ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন। ইম্পিরিয়লিজম প্রবন্ধে (বৈশাখ ১৩২২ ভারতী) রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: সেসিল রোডস্‌ একজন ইম্পিরিয়ল বায়ুগ্রস্ত লোক ছিলেন; সেইজন্য দক্ষিণ আফ্রিকা হইতে বোয়ারদের স্বাতন্ত্র্য লোপ করিবার জন্য তাহাদের দলের লোকের কিরূপ আগ্রহ ছিল তাহা সকলেই জানেনে। 

১৩। রাবীন্দ্রিক নেশান প্রসঙ্গে আরো দু-চার কথা / প্রজা ও তন্ত্র / অনুষ্টুপ

[বারোমাস শারদীয় ২০০৩-এ প্রকাশিত রাবীন্দ্রিক নেশান কী? প্রবন্ধর পরিপ্রেক্ষিতে দেবেশ রায় বাংলা বই-তে (মার্চ ২০০৪) যে আলোচনা করেছিলেন (পার্থ চট্টোপাধ্যায়-এর রাবীন্দ্রিক নেশান), এবং অন্য একটি আলোচনার জবাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বারোমাস শারদীয় ২০০৪-এ এই প্রবন্ধটি লেখেন।] অভিধানে সর্বজনীন ও সার্বজনীন—দুটো শব্দই আছে। এক্ষেত্রে কোন অর্থে সার্বজনীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সকলের যোগ্য, সর্বজনের জন্য অনুষ্ঠিত, সর্ববিদিত—সেটা পরিষ্কার নয়।]

Facebook Comments

Leave a Reply