ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, না, হিন্দু জাতীয়তাবাদ? – বরুণ দাসগুপ্ত
আজ যখন জাতীয়তাবাদ, মানে হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা দেশে সরবে উঠতে আরম্ভ করেছে তখন প্রশ্ন জাগে, ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-টা কি জিনিস? হিন্দু একটা ‘জাতি’ এটা মেনে নেওয়া মানে মোহাম্মদ আলী জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের বৈধতাকেই স্বীকার করে নেওয়া, যে-তত্ত্ব বলে যে ধর্ম হচ্ছে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। এই তত্ত্ব পাকিস্তান সৃষ্টির ২৪ বছরের মধ্যেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে, যখন পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা তাঁদের ভাষা, বাংলা ভাষার, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঙালি রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টি করলেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ হয়ে গেল ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান সিকি শতাব্দী অতিক্রম করার আগেই।
হিন্দুত্ববাদীরা বলতে পারেন, তাঁরা তো জাতীয়তাবাদের কথাই বলেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ তো বলেন না। কিন্তু তাঁরা যে জাতীয়তাবাদের কথা বলেন তার ধারণা বা কনসেপ্ট-এর মধ্যে কী হিন্দু ছাড়া অন্যদের স্থান আছে? না, নেই? তাদের বক্তব্যই হল যে যেহেতু দেশ ভাগ হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে, সেহেতু যা অহিন্দু, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রীস্টান, তাঁদের এদেশে থাকার কোন অধিকারই নেই। এই কথা তারা প্রকাশ্যেই বলছেন, বার বার করে বলছেন।
এঁরা ভুলে যান যে গত পাঁচ হাজার বছর ধরে এ দেশে যে সভ্যতা উদ্ভূত হয়েছে এবং বিকশিত হয়েছে সেটি হিন্দু সভ্যতা নয় ভারতীয় সভ্যতা। এই সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হল এর আত্মীকরণের স্বভাবজ ক্ষমতা। কেউ বাইরে নয়। কেউ বাইরে থেকে এসে থেকে গেল সে আর বাইরের লোক থাকে না, ঘরের লোক, নিজের লোক হয়ে যায় এই আত্মীকরণের প্রক্রিয়াটি রবীন্দ্রনাথ অনবদ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার একটি কবিতায়, যার নাম ‘ভারততীর্থ’।
“কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা থেকে সমুদ্রে হল হারা
হেথায় আর্য হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন
শক হূণ দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।”
এই একই ভাবধারা প্রতিফলিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের একটি গানে
“ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।”
এইখানে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ জাতীয়তার সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে উত্তরণ লাভ করেছে আন্তর্জাতিকতাবাদে। আজ যারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলছেন, তাঁদের তথাকথিত জাতীয়তাবাদ দেশের একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ, যাঁরা অ-হিন্দু, তাঁদের ভারতীয়ত্বকেই অস্বীকার করে। সেই জন্যই তাঁরা শুধু মুসলমান নয়, যে বিরাট সংখ্যক হিন্দু তাঁদের হিন্দুত্ববাদী মতবাদের সঙ্গে একমত নন, তাঁদেরকেও এ দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে বলেন। এইখানেই তারা ধরা পড়ে যান। তাঁদের হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই, সেটা হচ্ছে নির্ভেজাল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের একচ্ছত্র শাসনাধিকার দাবি করার মিথ্যা যুক্তি মাত্র। যে হিন্দু তাঁদের সঙ্গে হিন্দুত্বের সংজ্ঞা নিয়ে একমত হবেন না, তাঁরা এঁদেরও শত্রু গণ্য করবেন। ঠিক যেমন আই. এস. বা ইসলামিক স্টেট-এর প্রবক্তাদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। যে সব মুসলমান তাঁদের সঙ্গে একমত হবেন না, বা বিরোধিতা করবেন, এঁরা সেই সব মুসলমানকেও কোতল করবেন, করেছেনও।
জাতীয়তাবাদ আর উগ্র-জাতীয়তাবাদের মধ্যে তফাৎ কোথায়? আমি যে-দেশে জন্মেছি সেই দেশকে, সে দেশের মাটি-মানুষ-প্রকৃতিকে ভালবাসব এটা তো স্বাভাবিক। সেটাই জাতীয়তাবাদ। আর উগ্র-জাতীয়তাবাদ হল সেই মানসিকতা যা অন্য সবাইকে ঘৃণা করতে শেখায়, নিজের ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম-খাদ্যাভ্যাস সবকিছুকে অন্যের উপরে গায়ের জোরে চাপিয়ে দিতে চায়। অন্যেরা তা মানতে না চাইলে তাদের হত্যা পর্যন্ত করতে কুণ্ঠিত হয় না। ইসলাম ধর্মে শূকর অপবিত্র। সাধারণভাবে হিন্দুরা যেমন গো-মাংস খান না, খাবার কথা ভাবতেও পারেন না, তেমনি মুসলমানরা শূকর মাংস খান না, খাবার কথা ভাবতেও পারেন না। এবং ঠিক সেই কারণেই মাঝেমাঝেই খবর বেরোয় যে কোন মুসলমানকে জবরদস্তি করে শূকর মাংস খাওয়ানো হয়েছে। এটা হচ্ছে বিধর্মীর প্রতি এক জান্তব জিঘাংসা চরিতার্থ করার মনোবৃত্তি। এর দ্বারা নিজের ধর্মের গৌরব একটুও বাড়ে না, বরং নিজ-ধর্ম কলঙ্কিত হয়।
জীবন সায়াহ্নে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘সভ্যতার সংকট’। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। মানুষের লোভ এবং হিংস্রতা তাকে এক ভয়াবহ আত্মঘাতী, আত্মধ্বংসী সর্বনাশের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন (সভ্যতার সংকট-এ) “…ভারতবর্ষের সকলে চেয়ে যে দুর্গতি আজ মাথা তুলে উঠেছে সে কেবল অন্ন বস্ত্র শিক্ষা এবং আরোগ্যের শোকাবহ অভাব মাত্র নয়, সে হচ্ছে ভারতবাসীর মধ্যে অতি নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ, যার কোনো তুলনা দেখতে পাইনি ভারতবর্ষের বাইরে মুসলমান স্বায়ত্ব-শাসনচালিত দেশে। আমাদের বিপদ এই যে, এই দুর্গতির জন্যে আমাদেরই সমাজকে একমাত্র দায়ী করা হবে। কিন্তু এই দুর্গতির রূপ যে প্রত্যহই ক্রমশ উৎকট হয়ে উঠেছে, সে যদি ভারতশাসনতন্ত্রের ঊর্ধ্বস্তরে কোন-এক গোপন কেন্দ্রে প্রশ্রয়ের দ্বারা পোষিত না হত তাহলে কখনোই ভারত-ইতিহাসের এত বড়ো অপমানকর অসভ্য পরিণাম ঘটতে পারত না।”
রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধ লেখার পর পঁচাত্তর বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও এই কথা কী আজও সমান সত্য নয় যে বর্তমান দেশ যে “নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ”-এর প্রক্রিয়াটি প্রত্যক্ষ করেছে তা সম্ভব হতো না যদি না তা “ভারতশাসনতন্ত্রের উত্তরে কোন-এক গোপন কেন্দ্রে প্রশ্রয়ের দ্বারা পোষিত না হত”? এই ভয়াবহ আত্মবিচ্ছেদ যাঁরা ঘটাচ্ছেন, শাসনযন্ত্রটি তাঁদের হাতে আছে বলে যে-কোন ব্যক্তিকে যখন-তখন নিজেদের খুশি এবং রাজনৈতিক সুবিধা মত দেশদ্রোহী বলে দিচ্ছেন, তাঁরা বুঝছেন না রাষ্ট্রক্ষমতা আপাতত তাঁদের হাতে থাকলেও চিরকাল থাকবে না। যেদিন তাঁরা ক্ষমতাচ্যুত হবেন সেদিন তাঁদের আজকের হঠকারিতা ও অবিমৃষ্যকারিতার জন্য কঠিন মূল্য দিতে হবে।
সেই রকম আজ যারা ‘হিন্দু সংস্কৃতি’-র জয়গান করছেন উচ্চকণ্ঠে তাঁরাও এটা বুঝছেন না যে ধর্ম আর সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। হিন্দু সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। যেটা আছে সেটা ভারতীয় সংস্কৃতি। আজ থেকে ১০০ বছর আগে, ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৯, তদানীন্তন মাদ্রাজে রবীন্দ্রনাথ “The Centre of Indian Culture” নামে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া প্রথম ইংরিজি ভাষণ বলে ধরা হয়। সেই ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন:
“Before I conclude my paper, a delicate question remains to be answered what must be the religious teaching that is to be given in our centre of Indian culture, which I may name Visva–Bharati? The question has been generally shiriked in the case of the schools which we call national. A National University, in our minds, has been only another name for a Hindu University. So, whenever we give any thought to the question, with think of the Hindu religion alone. Unable as we are to rise to the conception of the Great India, we try to divide it, in the case of our culture, just as we have done by our religious rites and social customs. In other words, the idea of such unity as we are capable of achieving for ourselves not only fails to rouse enthusiasm in our hearts, but gives rise to some amount of antipathy.”
ওই ভাষণে আরও বলেছিলেন:
“There will always be many, who, by tradition and temperament, find special solace in belonging to a particular sect; and there will be others who think that the finding of search solace can only be allowed as legitimate within the pale of their own. Between such, their needs must be quarrels. Making ample provision for such inevitable and interminable squabbles, can there be no wide meeting place, where all sects may together and forget their differences? Has India, in her religious ideals, no search space for the common light of day and open air for all humanity? The vigour with which the sectarian fanatic will shake his head, makes one doubt it; the bloodshed which so frequently occurs for such trivial causes, makes one doubt it; the cruel and insulting distinctions between man and man which are kept alive under the sanction of religion, makes one doubt it. Still, in spite of all these, when I turn to look back to India’s own pure culture—in those ages when it flourished in its truth—I am emboldened to assert that it is there.”
আজ, একশো বছর বাদেও, বর্তমান রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা এক চুলও হারায় নি, বরং বেড়েছে।
আজকে যাঁরা ধর্মের নামে, ছোট-জাত (দলিত) ও বড়ো-জাতের (বর্ণ হিন্দু) নামে, দেশপ্রেমী ও দেশদ্রোহীদের নামে দেশকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে চাইছেন, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, তাঁরাই আজ অন্যদের বিরুদ্ধে দেশকে ‘টুকরো-টুকরো’ করার অভিযোগ আনছেন। রবীন্দ্রনাথ যাঁদের ‘সেক্টারিয়ান ফ্যানাটিক’ বলেছিলেন, সেই ফ্যানাটিক বা ধর্মোন্মাদরাই আজ দেশ শাসনের দায়িত্বে, তাঁরাই আজ সার্টিফিকেট বিলি করার এজেন্সি খুলে বসেছেন, কে দেশপ্রেমিক আর কে দেশপ্রেমী নয়।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁদের তিলমাত্র অবদান নেই, বরং সাভারকর প্রমুখ যাদের পূর্বসূরিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করে গিয়েছেন বরাবর এবং ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরাই আজ নিজেদের জাতীয়তাবাদী ও অন্যদের দেশদ্রোহী বলে দেগে দিচ্ছেন। এঁদের যদি ক্ষমতাচ্যুত করা না যায় তাহলে যে ভারতবর্ষকে আমরা হাজার হাজার বছর ধরে জেনে এসেছি সেই ভারতবর্ষ আর থাকবে না। সেই চিরাচরিত ভারতবর্ষের ঐতিহ্য ছিল “দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই”। আর এই নব্য এবং স্ব-ঘোষিত দেশপ্রেমীরা পরকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন, ভাইকে করেছেন শত্রু।
আর একটি কথা উল্লেখ করে এই নিবন্ধ শেষ করবো। এই স্ব-ঘোষিত দেশপ্রেমীরা কথায় কথায় স্বামী বিবেকানন্দের উল্লেখ করেন, তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেন। আর একই নিঃশ্বাসে ওঁরা যাঁদের অপছন্দ করেন তাদের দেশ থেকে তাড়ানো হুমকি দেন। বার বারই উল্লেখ করেন স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার কথা। ১৮৯৩ সালে বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার শুরুটি উদ্ধৃত করি। বিবেকানন্দ বলেছিলেন:
“আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকে আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি। যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভাষায় ‘এক্সক্লুশন’ শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি। যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে আসছে, আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেকে গর্বিত মনে করি।”
সাম্প্রদায়িক ধর্মোন্মাদদের আর যাই হোক বিবেকানন্দের নাম নেবার কোন অধিকার নেই।
[লেখক – এক বিরল প্রজ্ঞাবান সাংবাদিক, ‘দি হিন্দু’, ‘পেট্রিয়ট’, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’, মেইন্সট্রিম’, ‘আজকাল’ প্রভৃতি সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। কোনদিন প্রথাগত বিদ্যালয়ে যান নি। কৈশোরে গান্ধীজির স্নেহধন্য, সীমান্ত গান্ধী, মৌলানা আজাদ, নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বসু ইত্যাদিদের খুব কাছে পেয়েছেন।]
Posted in: April 2019, Cover Story