রোয়াল্ড হফম্যান-এর কবিতা অনুবাদ – অনিন্দ্য রায়

[রোয়াল্ড হফম্যান : জন্ম – ১৯৩৭-এর ১৮ই জুলাই, পোল্যান্ডে এক ইহুদি পরিবারে। বাবা হিল্লেল সাফ্রান, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আর মা ক্লারা রসেন ছিলেন শিক্ষিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি আগ্রাসনে বাবা-মার সঙ্গে তাঁকেও যেতে হয় লেবার ক্যাম্পে। মা তাঁকে নিয়ে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হলেও নাৎসি বাহিনীর হাতে খুন হন বাবা; তাঁরা আশ্রয় নেন একটি স্কুলের চিলেকোঠায় আর ভাঁড়ার ঘরে। লুকিয়ে থাকার সময় চিলেকোঠায় রাখা বইপত্তর পড়িয়েই মা ভুলিয়ে রাখতেন পিতৃহারা বাচ্চাটিকে। এ সবই রোয়াল্ডের ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যের ঘটনা । মা আবার বিয়ে করেন, পল হফম্যানকে। এই সৎবাবার পদবীতেই পরিচিতি রোয়াল্ডের। পোল্যান্ড থেকে চেকোস্লোভাকিয়া, সেখান থেকে অষ্ট্রিয়া, তারপর জার্মানি। অবশেষে ১৯৪৯-এ আমেরিকায় এসে পৌঁছল হফম্যান পরিবার। মেধাবী রোয়াল্ড পড়াশোনায় নজর কাড়েন স্কুল থেকেই। ১৯৫৫-য় তিনি পাশ করেন স্ট্যুভেস্যান্ট হাইস্কুল থেকে, পান ওয়েস্টিংহাউস সায়েন্স স্কলারশিপ। পরবর্তীতে কলম্বিয়া ও হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাভার্ড থেকেই পিএইচডি। পড়ানোর  জন্য যোগ দেন করনেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, এখনও সেখানেই। মাঝে কিছুদিন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮১ সালে জাপানি রসায়নবিদ কেনিচি ফুকুই-এর সঙ্গে কেমিস্ট্রিতে নোবেল পুরস্কার পান রোয়াল্ড হফম্যান। রাসায়নিক বিক্রিয়া কীভাবে হয় এই নিয়েই তাঁদের গবেষণা। স্থিতিশীল ও অস্থিতিশীল অণুদের ইলেকট্রনের গঠন আর তাদের পরিবর্তনশীল অবস্থা নিয়েই হফম্যানের কাজ। তিনি রবার্ট বার্নস উডমার্ক-এর সঙ্গে বিক্রিয়া পদ্ধতির নিয়ম বের করেন। ইলেকট্রন-কক্ষপথের সূক্ষ্ম সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য থেকেই যে রাসায়নিক পরিবর্তন অনুমান করা যায় সে কথা তাঁরা বলেন। কোনো বিক্রিয়া তাপ অথবা আলোয় ক্রিয়াশীল হয়ে কি ফলাফল দেবে, কি পদার্থ তৈরি করবে—তাঁদের এই নিয়ম থেকে বুঝতে পারা যায়।

১৯৬০ সালে ইভা বর্জেসসন-কে বিয়ে করেন রোয়াল্ড; তাঁদের দুই সন্তান হিল্লেল জ্যান আর ইনগ্রিড।

কবিতার প্রতি তাঁর আকর্ষণ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে। যদিও তা ছিল নিভৃত যাপন। সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে লেখার শুরু। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় অবশ্য দেরিতে–১৯৮৪-তে।

 প্রথম কবিতার বই ‘The Metamict State’ প্রকাশিত হয়। তারপর ১৯৯০-তে ‘Gaps and Verges’, ১৯৯৯-এ Memory Effects’, ২০০২-তে‘Solution’কবিতা অনুদিত হয়েছে জার্মান, রুশ, পোলিশ, পর্তুগিজ, ইতালিয়া, ক্রোয়েশিয়ান এবং বাংলায়। লিখেছেন নাটক ‘অক্সিজেন’, Should Be’, ‘Something That Belongs  To You’।

গদ্যের বই Roald Hoffmann on the Philosophy, Art, and Science of Chemistry’, ‘ Beyond the Finite : The Sublime in Art and Science’, ‘Old wine, New Flask: Reflections on Science on Jewish Tradition’ (শিরা লিবোইয়ুইৎজ-এর সঙ্গে) ও ‘The same and Not the Same’।

বিজ্ঞান তাঁর কবিতায় এসেছে অবশ্যম্ভাবী ভাবে। হফম্যানের কথায়, “শিল্প বিপ্লবের কাছাকাছি সময় থেকে, হয়তো এরই প্রতিক্রিয়ায়, হয়তো অন্য কোনো কারণে, বিজ্ঞান আর তার ভাষা কবিতার থেকে সরে এলো। প্রকৃতি আর ব্যক্তিগত অনুভূতি হয়ে উঠল কবিদের প্রধান খেলার মাঠ। ব্যাপারটা কোনো বিজ্ঞানী বা কবি দুজনের জন্যই হল খুব খারাপ, তবে আমাদের মতো যারা এই দুইয়ের মধ্যে ঘোরাঘুরি করি তাদের জন্য তৈরি করল অনেকটা খোলা জমি। একজন কাঠুরে যদি কবিতা  লিখতে পারেন তবে একজন বিজ্ঞানী বা কেন নন? এও তো অভিজ্ঞতা, এও এক যাপন। আর তা বেশ রোমাঞ্চের।”

বলেছেন, “আমার কিছু কবিতায় বিজ্ঞান রয়েছে, কিছুতে নেই। আমি অবশ্য বিজ্ঞানের কবিতাকে বাকিদের থেকে বেশি গুরুত্ব দিই না। বিজ্ঞান তো আমার জীবনের একটা অংশ মাত্র।”]

সেই মানুষটি সবকিছুই যার সহজে হয়ে যায়

(THE MAN FOR WHOM EVERYTHING CAME EASY)

উদ্বাস্তু পরিবার থেকে আসা ছেলেটির

১৬ বছর বয়স অব্ধি

নিজের কোনো বই ছিল না।

তার আকাঙ্ক্ষারাও ছিল সাদাসিধে:

চেলোয় ফরনিয়ারের বাখের সোনাটা বাজানো, সে এক উজ্জ্বল দুনিয়া।  

স্কুলে পড়াশুনোয় ভালো ছিল

আর দেশটা তো আমেরিকা

তাই একটু সহজ হল।

খাটত খুব,

রিসার্চ করত দারুণ

একটা সময় জোড়া টেলি ফটো লেন্সের একটা নিকন

আর বাখের সোনাটার পুরোনো রেকর্ড

কিনে ফেলতেই পারত।

(ফরনিয়ার নিয়ে তো একটা ভুল করে ফেলেছিল)

একটু মনখারাপও ছিল

যখন আরেকটা পুরোনো গাড়ি কেনার দরকার হয়ে পড়েছিল

তার পোর্সের কথা তোলাটাকে 

বউ একদম যাচ্ছেতাই বলেছিল।

সারা পৃথিবী থেকেই বক্তৃতার জন্য ডাক আসতে লাগল।

সব থেকে বেশি যেটা চাইত (বলতে ভয়ই পেত)

তার সন্তানেরা যেন ভালো বই পড়ে

হার্ড রক নিয়ে যেন বেশি সময় নষ্ট না করে।

ব্যাপারটা কঠিনই

ছেলেপুলেদের তো আর পয়সা দিয়ে

অপছন্দের কাজ করানো যায় না। তবে

বড়ো হয়ে টলস্টয় তুলে নিলো তারা

তাই না, কখনোসখনো

রেকর্ডপ্লেয়ারে চেলোয় সোনাটা চালিয়ে দিত।

লোকটাও যে সবই ঠিকঠাক করে নিতে পারে

রকও ভালো লেগে গেল তার

অন্তত এর সাথে নাচতে,

(গানের কথা শোনা যাচ্ছে না এই অভিযোগ অবশ্য ছাড়ল না)

দিনে ছ মাইল ছুটে

বউয়ের থেকে সহজেই ওজনটাও কম রাখল।  

প্লেনে ফার্স্ট ক্লাসে যাতায়াত শুরু করল,

কিকেরকেগার্দের শ্রেণীতে ওঠবস চলতে লাগল।  

লোকটা যার সব কিছুই আছে  

তার নতুন বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের ইদানীং বলে

আমার নিজের সবচে পছন্দের যে আমার হৃদয় আছে

যেন তা নয়-ই।

[ফরনিয়ার – পিয়ের ফরনিয়ার ( ১৯০৬  -১৯৮৬ ), ফরাসি চেলো বাদক।

 চেলো – পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র।

 বাখ – যোহান সিবেস্টিয়ান বাখ ( ১৬৮৫ – ১৭৫০ ) পাশ্চাত্য সঙ্গীতের স্বনামধন্য কম্পোজার।

 পোর্সে – গাড়ির কোম্পানি, তুলনামূলক দামি মডেলের গাড়ি।

 কিয়েরকেগার্দ – সোরেন কিরেরকেগার্দ(১৮১৩ -১৮৫৫), ড্যানিশ দার্শনিক, অস্তিত্ববাদের ধারণায় তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য]

মানুষ আর অণু

(MAN AND MOLECULES)

ঝুলন্ত মিথাইল গ্রুপ,

অশেষ নির্দোল গতিতে পেটানো।

একটি অণুর সাঁতার,

কার্যকারিতা ছড়িয়ে পড়ছে,

বিক্রিয়াশীল কেন্দ্র তছনছ।

প্রতিটি সংঘর্ষেই নয়,

প্রতিটি কেতাদুরস্ত কক্ষপথেই নয়

যা দিয়ে বিলিয়ার্ড-বলের সংঘ

পৌঁছয় তাদের মাপকরা মিলনক্ষেত্রে

আর ঘটে যায় বিক্রিয়া।

বেশিরভাগ মোলাকাতই

পার্শ্ব-মধাড়াক্কায় ফুরিয়ে যায়।

জাড্যের হস্তান্তর,

সামান্য দিক বদল,

        আর আমাদের জন্য এটুকুই।

সজোরে ধাক্কাই একদম ঠিক হত।

চোখ বন্ধ করতে হত, আর

কে পড়ত আকাঙ্ক্ষার মিটমিটে আলো।

পরিস্থিতিটাই আসল।

লোমের নরম তুলি

বা হাতের স্পর্শ।

একটু সুগন্ধি বাতাস।

মানুষ (আর মানুষীও)

যেরকম ভাবে

অণুদের থেকে আলাদা কিছু তো নয়। 

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি

(THE SCIENTIFIC METHOD)

ভালো থিওরি হল সেগুলোই

যাদের ভুল প্রমাণিত হওয়ার

ক্ষমতা থাকে, বলেছেন কার্ল

পপার । ব্যাপারটা এইরকম

আমি যদি

সামনের সপ্তাহেও আসি

একদম এখানেই

কফি নিয়ে বসি আর

মুখ তুলে দেখি

তোমাকে,

দেখব যে তুমিও

আমাকে দেখছ

আবারও,

ওখানেই,

এবার শুধু

একটু হাসির

        সুযোগ পেয়ে যাব।

[কার্ল পপার ( ১৯০২-১৯৯৪),  অস্ট্রিয়ান- ব্রিটিশ দার্শনিক, বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান দর্শনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব]

উচ্চতা  

[HEIGHT]

যে  বলেছিল

পর্বতের চূড়ায় উঠলে

সেটিকে তুমি আর

দেখতে পাবে না

সে ছিল

এক খনিকার।   

স্বজ্ঞা 

[INTUITION]                      

লাল-চুলের মেয়েটি

বলেছে কাচ

বেশ জমাট।  

সে তো জানে না

বিশৃঙ্খল

সিলিকা চেন, রিং

আর গঠনগত  

হতাশার ব্যাপারে।

তাকিয়ে থাকে সে

শুধু ভাঙা সবুজ

কানার

দিকে।

পাখি-স্থান

(BIRDLAND)

.

পাখি তো

পাখিই,

তবু

একই পাখি নয় ।

.

পাখি

হতে হলে :

চড়ুই, ছাতারে

ময়না, কাল প্যাঁচা 

ছোট-আংলা ঈগল 

চামচিকে, বুলবুল

মিশরীয় শকুন

দোয়েল পাখি

হতে হয়

.

আর যেমন

দেখায় যাকে, সে তা-ই;

ওল্টানো, আরও তীক্ষ্ণ

মাটির পাখির কথা,

লোকজন ভাবে, ওহ্‌

যে কোনো পাখির

দুই দিক 

একইরকম ।

কিন্তু হয় না তা, দ্যাখো,

এদিকের 

পালকগুলো

আলতো পিছে-মোড়ানো

আর ওই, দ্যাখো, ওই যে, 

বিপজ্জনক

শূন্য

স্থান

.

যুদ্ধবিমানের

ধুম্রপুচ্ছ

পের হচ্ছে যে

পাখি

মানুষ/ পাখির

স্বর্গে

উড়তে

সানুগ্রহে রাজি

.

আমি,

এক পাইন গাছ,

ছ’টা কালো পাখি;

এক/ অনেক

সমস্যা

ঘাবড়িয়ে

মিটেও যায়।

.

পাখিটা

উঠছে, ওকের ঝাড়

আর মেঘের

গতিময় সম্পর্কে ।

দ্বিতীয় দিনে

বিচ্ছিন্নতাই

করে

তোলে

পূর্ণ। 

.

ওই

ছড়িয়ে থাকা

চড়ুইয়ের দল

শূন্যকে গড়ে তোলে

ঠিক যেরকম

যেখানে 

রয়েছে

ওরা

.

পাখি

গান গায়, তবে

একটা খাঁচায়, গাছে

ঝোলানো – না, একটা

নয়, দশটা! ওহ,

কত পাখিই

যে লাগে

শিক-কাবাব বানাতে 

কোথায়, শিকারী,

হারিয়ে যাবে 

ওদের বুকের

দাগ?

.

এক

বার,

একবারই,

একটা পাখি, পাখিটা

আমার দিকে ঝাঁপিয়ে এলো

পুরোপুরি মেলে দেওয়া

তির হয়ে গিয়ে

নিজের লক্ষ্যকে

উজ্জ্বল করল।

পাখি সম্পর্কে

এই আমার

ধারণা।

Facebook Comments

1 thought on “রোয়াল্ড হফম্যান-এর কবিতা অনুবাদ – অনিন্দ্য রায় Leave a comment

Leave a Reply