অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার

আমরা ভারতবর্ষের এমন একটি সময়কালে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে যাবতীয় আধুনিকতা এবং প্রগতিশীলতাকে ধরেই নেওয়া পশ্চিমের জ্ঞান, শিল্প, দর্শন চর্চার হয় সুফল অথবা কুফল হিসেবে। মজার ব্যাপার হল হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থা এবং তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানবতাবাদ এই বিষয়ে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। এক দল মনে করে যে সনাতন ভারতীয়ত্ব নষ্ট হয়েছে ঔপনিবেশিক কালে এবং আরেক দলের মত ভারতীয় আধুনিকতার সূচনাপর্বই হল ঔপনিবেশিক কাল। স্বাভাবিক ভাবে নারীবাদের পরিসরও এই ভাবনা বৃত্তের বাইরে বেরোতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। ফলত নারীবাদের এমন একটি ধারার চর্চা হয়ে চলে যেখানে হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থাকে প্রতিরোধের জন্য ‘পাশ্চাত্যবাদী’ চর্চা ও চর্যাকে ‘মান্য’ প্রেক্ষিত হিসেবে সাধারণত ব্যবহার করা হয়ে থাকে, খুব বেশি হলে উনিশ শতকীয় নবজাগরণের বাংলার নারীদের লেখাগুলিকে প্রতিরোধী প্রেক্ষিত হিসাবে আনা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে যখনই নারীর একটি পৃথক লিখন পরিসরের তত্ত্বে জোর দেওয়া হয়, হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থা দেখাতে চায় যে যেহেতু ‘হিন্দু’ আদি তিন দেবতা ব্রহ্মা , বিষ্ণু , ও মহেশ্বর একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ সত্ত্বা ধারণ করেন যা আপাত ভাবে পাশ্চাত্য দর্শনের  মত নারী ও পুরুষকে বিপরীতমুখী সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে না তাই ভারতীয় হিন্দু পরিসরে নারীর জন্য পৃথক কোনো লিখন পরিসরের প্রয়োজনীয়তাই ছিল না। এই তত্ত্বের বিরোধিতা করার জন্য যখনই উদার মানবতাবাদীরা   ভার্জিনিয়া উলফ, বোঁভোয়া, গিলবার্ট ও গিউবার, কেট মিলেট, শোঅল্টার, আঁদ্রে রিচদের তত্ত্ব আনেন তখনই আজকের ভারত একে পশ্চিমের আমদানি বলে অপরায়িত করে ; এমনকি উত্তর ঔপনিবেশিক নারীবাদী টেক্সট ও তাত্ত্বিকদেরও এই বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়। তাই স্পিভাক, লীলা গান্ধী , চন্দ্রা তালপাঁড়ে মোহান্তিদের বারংবার নিজেদের ভারতীয় প্রেক্ষিতে নিজেদের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে হয়। ভন্দনা শিবার ইকো-ফেমিনজমের ভারতীয় প্রেক্ষিতিকরণ এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলেই  আমরা ধরব। এই ধারাকে এই অনুবাদ প্রকল্প ধরতে চেয়েছে ভারতীয় নারীদের কবিতার প্রবহমানতা দিয়ে।  এই অনুবাদের কাজ নারীবাদের  বি-ঔপনিবেশিকরণকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছে রাজনৈতিক অভিমুখ হিসেবে। তথাকথিত ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিরোধ করার জন্য ভারতীয় চর্চা ও চর্যাকে প্রতিরোধের রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করাই এই অনুবাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য।  

   ভারতীয় নারী নিজ সত্তা শারীরিক ও আত্মিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে নিজেই লিখতে পারে, পুরুষের লিখন দ্বারা নারী সত্তা নির্মাণের প্রয়োজন ভারতীয় পরিসরে নেই— সেই ধারাটির খোঁজই এই অনুবাদ প্রকল্পের রাজনীতি। অন্যভাবে বলতে গেলে কালিদাস, বিদ্যাপতি, জয়দেব, ভানু সিংহ এঁদের দ্বারা নির্মিত নারী সত্ত্বার রাজনৈতিক প্রয়োজন ভারতীয় নারীবাদের লিখন পরিসরে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তা অনেকাংশে নারীর সক্রিয়তাকে অবদমিত করেছে— এটি প্রতিষ্ঠা করাও এই কাজটির আরেকটি অভিমুখ। সময়কাল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে খ্রিষ্টাব্দ হিসেবে দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রাকৃত কবিতার সময়কাল থেকে সাম্প্রতিক সময় অবধি।  প্রত্যেকটি সংখ্যায় অনুবাদ থাকবে কোনো নির্দিষ্ট ধারা বা একই রীতির কয়েকজন কবি বা একজন নির্দিষ্ট কবির কিছু কবিতার যে কবিতাগুলি উপরোক্ত রাজনীতি সম্পৃক্ত। এবং প্রত্যেকটি কবিতাই নারী দ্বারা রচিত।  এই সংখ্যায় থাকল প্রাকৃত ভাষার নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ।    

আনুমানিক খ্রিষ্টাব্দ হিসেবে দ্বিতীয় শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন রাজা হালা ‘গাথাসপ্তসতি’  নামে প্রাকৃত ভাষায় রচিত নারীদের এই কবিতাগুলির সংকলন করেন। কবিদের নাম পাওয়া যায় না। এটি  প্রাচীন ভারতীয় কবিতার অন্যতম একটি নিদর্শন। এই  নির্বাচিত কবিতাগুলিতে আমরা নারীদের সেই স্বর শুনতে পায় যেখানে অনুরাগ, প্রেম, রতি প্রত্যেকটি ক্ষেত্রই রচিত হয়েছে নারীর প্রেক্ষিত থেকে। ফলত পিতৃতান্ত্রিক ট্যাবু অনেক জায়গাতেই ভেঙে পড়ে। অনুবাদের ক্ষেত্রে  নির্বাচিত প্রাকৃত কবিতাগুলির পাশাপাশি অরবিন্দ কৃষ্ণ মেহরোত্রার ইংরাজি অনুবাদকেও সোর্স-টেক্সট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

গাথাসপ্তসতি: নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ

। ১।

কাঁদিস কেন সই?

প্রেম তো এমনই

শশালতার কাঁটা ভিন্ন

আর কিছু নয়।

। ২।

রাতে তার গালে আলোর নাচন

একশ রকমে আদর কাড়ে

সকালে সে চোখে শরমের ভার

ভেবে সারা হই, এ কি সেই মেয়ে!

। ৩।

ভালোবাসাবাসির পর চলে যায় সে

দুয়ার থেকে ফিরেও আসে আরেকবার

ঠোঁটে রাখতে ঠোঁট

সে চলে গেছে, তার ফেলার অপেক্ষায়

অনাঘ্রাতা

। ৪।

শুধাও বরষা রাত্রিদের

শুধাও হড়পা আসা গোদাবরীকে

কত না ভাগ্য ধরে সে

কেমন বাঁধভাঙা সাহস এ মেয়ের!

। ৫।

মোর এলো চুল

এখনও অগোছালো

যাওয়ার কথা তুলছিস

তুই আবারো?

। ৬।

আটপৌরে রতির ধরণ

বড্ড ক্লান্ত করে

স্বভাব উতল আমি

নতুন কিছুর তরে

। ৭।

স্বামীর পায়ের শব্দে

সে লুকায় অভিসার

বলে, এ এসেছে মোর

বাপের ঘর থেকে

। ৮।

অধর দংশন করো না—

উস্কে দাও ফিসফিসে বাতি

দমবন্ধ হোক, আর

স্বাদ নাও নিষিদ্ধের।

। ১০।

আটপৌরে রতি তাকে ক্লান্ত করে

যদি নতুন কিছু করি,

আমায় সন্দেহ করে।

বল সই, কী করি?

। ১১ ।

শয্যায় পুরুষের উপরে

থাকতে না পারার হতাশায়

ভোগে সে

তার গর্ভের অন্তিম সপ্তাহে

। ১২ ।

ছটপটায়, ফোঁপায়

শ্বাস হয়ে ওঠে ঘন

বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে, লুটায়

বলে, যেও না পান্থ।

। ১৩ ।

পুত্র মোর, মহুয়া নেশার কী দরকার?

যদি শেষ কাপড়টুকু নিস খুলে

কেই বা শুনবে শীৎকার এই বনে?

আমি তো একাই, আর গ্রামটি অনেক দূরে!

। ১৪ ।

যখন সে দূরে

শতেক শঠতা মনে পড়ে, জ্বলি।

দেখলে তারে, মুহূর্তে ভুলি।

। ১৫ ।

চেয়েছি তোমার প্রেমিকা হতে বারবার।

বুঝে উঠতে পারিনি কী উপায়ে!

শিখিয়ো কখনো।       

 

Facebook Comments

Leave a Reply