কবিতা অতিক্রান্ত দূরত্ব ও দৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত – শুভ আঢ্য

কবিতা কোথায় ফলে? কোথায় বা ফুলে ওঠে বুক তার? কোথায় বা অভিমুখ থাকে যেখান থেকে সে হয়তো বা গড়িয়ে পড়েছে নিচে, কোথায় বা হুক তার আটকেছে মুনিয়ার ঠোঁটে?

        আপাত প্রবাহ ঘটনা ও ঘটনার আপাত প্রবাহে কিভাবে চলা যায়, কিভাবে চলে যেতে হয় পথ, ছেড়ে দিয়ে কিভাবে কফি, আঙুলও দোটানায় ফেরেঘরে সেখানেই কবিতা। এভাবেই খানিক শ্রী শৌভ চট্টোপাধ্যায় অতিক্রম করে গেছেন তাঁর খুঁটিনাটি, দৃষ্টি রেখে গেছেন কবিতায়, পাহাড়ের কোলে যেখানে মভ রঙের কবিতারা ফুটে উঠেছে উচ্চ ফলনশীল আপেলের মতোই। যদিও অতিক্রম করে যেতে তো হয়ই, কোথাও না কোথাও, অথবা এক জার্নির ভেতর মুখ নিয়ে সেঁদিয়েছে কবিতা, উটের মতো – বড় গলা, খাটোছোটো শব্দ নিয়ে তার।

        প্রচ্ছদশিল্পী শি – তাও’র আঁকা ছবিটি প্রথমেই জার্নির গানটুকু বেঁধে দেয়। একটি পাহাড়ের সামনে দু’টি মানুষ সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে। একজন অতিক্রম করে গেছে অপরজনকে দৃষ্টিগতভাবে, তাঁর সামনে খাদ। কিন্তু আসলেই দু’জন, দু’জনকে অতিক্রম করে ফেলেছে বোধহয়।

        “– একটা রাস্তা শেষ হলে, আরেকটা শুরু হয়, তারপর আরেকটা, তারপর…” শুরু হয় দেখা। শুরু হয় বস্তু থেকে তার ভেতর দেখা – বস্তুর বাইরে বসে, আবার কখনও বস্তুর ভেতরে বসে লক্ষ্য করা তার অবস্থানটুকু। কবিতা এই ধূসর অঞ্চলে থাকে। কবি লিখছেন, “ঘরের ভেতরে বসে কে-ই-বা দেখতে পায় বাড়িটিকে?” অথচ একটি ঘর নিজেকে দেখে উঠছে, একটি বাড়িকে দেখে উঠছে, সান্ত্বনার মতো করে দৃশ্য একটার পর আরেকটা তৈরী হচ্ছে, তারপর… ক্ষণস্থায়ী শীতের ভেতর দানা দানা শব্দের ঘ্রাণ কাচের বাসনগুলিকে দৃশ্যমান করে তুলছে, ভেঙে উঠছে একটার ওপর আরেকটা। কবি সেই ঘর ও কাচের বাসন অতিক্রম করে যাচ্ছেন, কবি যাচ্ছেন শব্দ অতিক্রম করে, অথচ অক্ষরগুলি ফুটে উঠছে পশমে পশমে। যদিও কবি জানতেন “কীভাবে নকল/ করতে হয় পাখিদের ডাক, ঝড়ের আওয়াজ” সেই অক্ষরগুলি শুধু টুকে রাখছেন জার্নি খাতায় মুনিয়ার কোলে অথবা রুবাইয়ের ঘুমের ভেতর।

        চেতনা এক সম্যক ধোঁয়াশা যা আঙুলের ডগায় থেকে যায়। কবি বলছেন, “দারুণ বিষে আমাদের হাতের আঙুল/ ধীরে ধীরে বেঁকে যায়” যতটুকু বাঁকে একটি শব্দ একটি অক্ষর, জলের তলায়, সেটুকুই কবিতা হয়ে থেকে গেছে। সেই অপসৃত পথ ঘিরে কবিতার গোনাআনা হাজারো সিক্কার। প্রতিটি অনভ্যস্ত মালির বাগানে একটি করে কবিতা ফুটে থাকে, হয়তো সেখানেই ফুটে ওঠে ভাষা তার, অথচ তেমনও বাগানটিতে রয়েছে কবিতা পড়ে যা শ্রী শৌভের নজর এড়ায় না। তিনি দেখছেন, “বাগানে কোথাও কোনো ফুল নেই, পুষ্প নেই/ টগর দোপাটি কিছু নীরবে ফুটেছে”। এই বাস্তবিক না থাকার ভেতরেই হয়তো কোথাও জমেছে আলো – আবার জমেছে আলো যেখানে, বাস্তবিক গাঢ় হয়েছে অন্ধকার ততটাই। এটাই না থাকা কবিতার গায়ের অলঙ্কারটুকু।

        ওঁর মুনিয়া আপাত সরল, কবিতার মতো হয়তো বা চোখ তার, সেখানে দীঘির ভেতর বিকেলের ছায়াটুকু পড়েছে এবং রয়েছেও যত্নে। তার “সরলতা/ ক্রমে জটিলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে”, তার যত্ন পরিপাটি অযত্নের ভেতর জড়িয়ে পড়েছে। বেশ কিছু যাপনের ভেতর রুবাই তাঁর কাছে ফিরেঘুরে আসে। তিনিও রুবাইয়ের ভেতর ঢুকে পড়েন, আর জড়িয়ে যান ক্রমশ। তিনি এই বিশ্বাস থেকেই ভাষাকে দেখেন যে, ভাষাকে ভাষার ভেতর থেকেই দেখা ও অনুধাবন করা যায়, অথচ অবিশ্বাসটুকুকেও লালন করতে তিনি ভোলেন না। কবি বলেন, “… এত বিশ্বাসের ভার/ ভাষা কি সইতে পারবে?” উলঙ্গ ভাষার নির্ভার অংশের সামনে তিনি ভাষাকে সংকুচিত হতে দেখেন, তার জারিত লজ্জাকে দেখেন, আর দেখেন নিরস্ত্র ভাষা কিভাবে হঠাৎ হত্যাকারী হয়ে উঠতে পারে, যদিও “দ্বিধায় বিভক্ত ফল, সে-ও জানে/ হত্যার সমস্ত গল্প ভয়াবহ নয়”।

        কবি আপাত দিনের ভেতর দেখেছেন যুবক ও যবতীটির আধারে রোদ্দুরের রঙ। কবি মানুষের আধারে প্রকৃতিকে দেখেছেন, শব্দের আধারে দেখেছেন অন্ধকারের ওপর ডট ডট আলো জোনাকির মতো সামান্য জ্বলে আছে, নিভে যাওয়াটিও দেখেছেন। অরূপের ভেতর দেখেছেন প্রতিটি দিন অনন্ত ছুটির আর সে দিনের সামনে “অরূপ, সামান্য দূরে, ঝুঁকে আছে”। বেসিক্যালি, শৌভ চট্টোপাধ্যায়, দৃষ্টি প্রসারিত করে গেছেন, শব্দ আর অক্ষর শুধু ধারণ করে গেছেন মাত্র। যেন সামান্য আধারে চুবিয়ে দৃশ্য এঁকে গেছেন কোনো চিত্রশিল্পী, শব্দেরা রঙ হয়ে ফুটেছে কোথাও টেম্পোরা হয়ে আবার কোথাও গুয়াশ হয়ে নিজেই ফ্যাকাসে হয়েছে। কবিতা আপনেই সেখানে পিয়ানোর রিডে বসে আছে, ভাষার আদলে মাছিটির উদ্‌বিগ্ন গতিতে স্থির বসে আছে সেখানকার যথাযথ অবস্থান্টুকু ঘিরে কবি রুবাইয়ের পাশে।

        কবিতা আদপেই অন্ধকারের সাথে কথা বলে। প্রচ্ছদের ছবিটিতে দু’টি মানুষ যখন পরস্পর থেকে দূরত্বে (হোক না সামান্য) ধরা যাক তখন অন্ধকার। শ্রী শৌভ সেখানে শব্দকে এনেছেন, দূরত্বের বাইরে শব্দই একমাত্র একক সেখানে যা প্রামাণ্য পরিমাপের। সারাদিন অসুখের মতো জেগে আছে আন্তরিক ঘাস। এসবের মাঝে কবিতা আনত, কখনও উলম্বভাবে ধরা আছে, “শুধু তার সম্ভাবনা, দূরত্বকে কিছুদূর আন্তরিক করে”

        এইসব দিন, এইসব যাপন প্ররোচনামূলক। সেখানে কবিতা দূরে বা অনতিদূরে তার জালটি বিছিয়েছে। সেভাবেই ধরা পড়ে প্রতিটি যাত্রা তাঁর। প্রতিটি কবিতাই খাদ থেকে দেখা ছোটো ছোটো বাড়ি ও ঘরের মতো, অথচ তাদের ভেতরেও একটি খাদ আছে, হয়তো বা সেখান থেকে দু’টো মানুষ তাকিয়ে রয়েছে পাহাড়ের দিকে। কবিতা ভ্রম। বাড়ির ভেতরের কবিতা হয়তো বা আসলে পাহাড়ের ঢালে, আবার হয়তো বা পাহাড়ের কবিতা কাচের জানলাটির কাছে বসে আছে তুষারের মতো। এই যাপন, এই ব্যপ্তি, দৃষ্টির এই স্ট্রাকচার নিয়ে শুধু চলে যাওয়াটুকু আছে, বইটিতে। আছে চলে যাওয়াটুকুর ভেতর প্রতিটি পায়ের দাগ, প্রতিটি ঘাসের ওপর দিয়ে জ্যোৎস্নার নির্ভার গতিবিধি। আছে মুনিয়া, রুবাইয়ের ভেতর থেকে যাওয়া এক ড্রেওয়ার ভর্তি বিষণ্ণতা। পাঠক, নিজের ভেতর সেই টর্চ নিয়ে কবি খুঁড়ে গেছেন তাঁর যাত্রাপথটুকু, যার ভেতরে তিনি দেখেছেন একটি মাইলফলকে বসে আছেন এমনই নির্জন কবি, হয়তো বা মুনিয়া ও রুবাইয়ের জন্য।

[কবির প্রতি – শৌভদার কবিতা অনুধাবন করা একটা বিশেষ চ্যালেঞ্জ। “মুনিয়া ও অন্যান্য ব্যূহ” বইতে যেভাবে দেখেছেন, এ দেখা অনেক আলাদা। আমি হয়তো চশমাটা পরলাম ঠিকই তবে পাওয়ারের তফাতে কতটা দেখলাম, আর কতটাই বা চিনলাম, সে নিয়ে দ্বিধা রয়ে গেল। সেই দ্বিধাবনত কথাগুলোই খানিক লেখাজোখা হল। কবিতার পাঠ শুধুই ছন্দ কি, শুধুই মাত্রা কি! দেখাও কি কবিতা নয়?]

বই – নিঃশব্দে অতিক্রম করি

কবি – শৌভ চট্টোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ – শি – তাও

প্রকাশক – শুধু বিঘে দুই

মূল্য – ১২৫ টাকা

Facebook Comments

Posted in: Criticism, March 2019

Tagged as: ,

Leave a Reply