সম্পাদকীয়
পাহাড় ক্রমশ পিছনে থেমে যাচ্ছে। বদলাচ্ছে গাছগুলো। অচেনা মানুষের থেকেও অপরিচিত গাছে অস্বস্তি বেশি। সবকিছুর মাঝে নিজেই কেমন যেন অচেনা। কিন্তু কিছু করার ছিল না ওদের। পাহাড় পেরিয়ে, চেনা বাঁক আর বাঁকের ঝুরি গাছের পর ওরা প্রবেশ করছিল এক আজনবী অস্তিত্বে। একান্ত নিরুপায় সেই প্রবেশ। ভাগ্যিস টানেলটা পেয়ে গেছিল! পরে টানেলটাই ললিতের জীবনের দ্যোতক হয়ে উঠবে। সিদ্ধার্থ গিগু’র গল্পে ললিত অন্ধকার, সরু, দীর্ঘ সুড়ঙ্গের কাছে মূর্ত অবসরে ফিরে ফিরে গেছে। যেন তার তুষারশুভ্র আশৈশব বিস্মৃতির সন্ধান নিতেই ফিরে যাওয়া সুড়ঙ্গের কাছে। ঘড়ির টিক টিক যেমন পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে এসে স্তব্ধ হয়, ললিত তেমনই তার অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্বকে ধ্রুব করে তুলেছিল ঐ বিস্মৃতির সুড়ঙ্গ।
ছেঁড়া ক্যানভাসের তাঁবু, স্যাঁতস্যাঁতে উদ্বাস্তু মেঝে পেরিয়ে গল্পের ললিত খোলা আকাশের নীচে সেই অকিঞ্চিৎকর যাপনকে মহার্ঘ্য করেছিল এক শেষ হাসির বিনিময়ে।
কিন্তু নিয়ত বিচ্যুতির ভারে ন্যুব্জ অস্তিত্ব যখন আর খুঁজে নিতে পারে না সরল প্রাকৃতিক অবকাশগুলো তখন অবশিষ্ট থাকে এক কেওটিক স্খলন। অস্তিত্ব আর বিস্মৃতি একে অপরকে গ্রাস করতে চায়। মেতে ওঠে ঝগড়ায়।
ললিত: ঐ ওপারে আমাদের গ্রাম ছিল…রাস্তা থেকে বাঁদিকে নেমে একটু চড়াই উঠে চিনারের গা ঘেঁষে গ্রামে ঢুকতাম …
সুড়ঙ্গ: কোন পারে?
ললিত: তোমার ঐ পারে…
সুড়ঙ্গ: আর এই পারে?
ললিত: এই পারে তো আমাদের শরণার্থী শিবির, ছেঁড়া তাঁবু…রাতে কোত্থেকে জল এসে মেঝে..
সুড়ঙ্গ: তাহলে তো এপারেই এখন তোমার বাড়ি…
ললিত: না..না..বাড়ি আমার এটা নয়..
সুড়ঙ্গ: তুমি যাবে ওপারে? চলে এসো …
সুড়ঙ্গের ভিতর চাপ অন্ধকারকে ললিতের কালো মসলিনের পর্দা বলে মনে হচ্ছিল। একটার পর একটা পর্দা পেরোতে পেরোতে ক্রমশ নির্ভার হতে থাকে ও। একটা সময় বুঝতে পারে পরপর পর্দার পিছনে ফেলে এসেছে শরণার্থী শিবিরের ললিতকে, দিন দিন ক্ষয়াটে মেচেতার দাগওয়ালা বউয়ের স্বামী ললিতকে, মরবো মরবো করেও না মরে ঐ ছোট্ট তাঁবুর একমাত্র খাটখানি দখল করে রাখা বাবার ছেলে ললিতকে। এই নির্ভার ললিত এবার শেষ পর্দা পেরোনোর জন্য রেডি হয়। এই শেষ পর্দা পেরোতে পারলে সুড়ঙ্গের ওপারে ওর গ্রামে পৌঁছে যাবে। বরফঢাকা উপত্যকার চড়াই-উৎরাইয়ের বাঁকে আবারও চিনারের সারি… আবারও হুটোপুটি ঝরা পাতাদের…
কিন্তু শেষ পর্দা পেরোনোর আগেই সুড়ঙ্গটা জোরালো আলোয় ভরে যায়। চোখ ধাঁধিয়ে যায় ললিতের। আমরাও যারা পিছু পিছু ওর গ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম তারাও আলোয় দিশেহারা। চারপাশে ললিত এবং ললিতদের মতো আরও লোক। সবাই সবাইকে চেনে। কেবল আমরাই চিনতে পারছি না।
ওদের নাম কি?
চেহারা দেখে তো অনেককেই মুসলমান মনে হচ্ছে? এদের ললিত চিনল কিভাবে?!
এই বিস্ময়ের অপেক্ষাতেই সুড়ঙ্গটা যেন এতদিন বিস্মৃতির সুড়ঙ্গ হয়েছিল। এবার সে জেগে উঠল। নিজের পরিচয় দিল—জওহর টানেল। আর আমরা যারা কাশ্মীরী পণ্ডিত আর উগ্রবাদী উৎসুক উঁকি মারতে গিয়েছিলাম তাদের ব্যাঙ্গ করে সুড়ঙ্গ বলে উঠল, যেহেতু আমি বিস্মৃতির টানেল তাই আলো ফেলতে হয়।
তোমরা রাষ্ট্রের পুরুষকার দেখছ। পাহাড়ে লিঙ্গ সেঁধিয়ে সুড়ঙ্গ বানিয়ে দিল, কাশ্মীরী মুসলমান আর পণ্ডিতও হল। রাষ্ট্র সংঘকে চোখ টিপে রাষ্ট্রীয় রাইফেলস হল। বেশ ব্যবসা হল, যুদ্ধ হল। কিন্তু একা হয়ে গেল চিনার। উপত্যকার বাতাস, চেনাবের জল ভারী হয়ে গেল। তাই তো মসলিনের পর্দা লাগিয়েছিলাম। ছাঁকতে ছাঁকতে যখন পাহাড়ের মত আদিগন্ত হবে নজর তখন সেই নূর আলোয় ললিত আর উমরদের একসাথে দেখতে পাবে। লেজার গাইডেড শেলিং-এর থেকেও তীক্ষ্ণ সে অবলোকন।

ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
Posted in: Editorial, February 2019