উপন্যস্ত: উপন্যাসের খোঁজে – দেবাঞ্জন মিত্র

বৈভাষিক প্রকাশনীর অন্যতম কর্ণধার ও আইআইটি অধ্যাপক অর্ক চট্টোপাধ্যায় যে প্রবন্ধ ছাড়াও মাঝে মাঝে সাহিত্য চর্চা করে থাকেন এটা জেনে আমি অবাক হয়েছিলাম, তাই যখন ২০১৮ সালে উপন্যস্ত বাজারে এলো তখন কিনে ফেলি। এবং পড়তে শুরু করে অব্ধি শেষ না করে বইটা নামাতে পারি নি। উপন্যস্তর ভাষা নিয়ে তাই এ প্রবন্ধর আলোচনা শুরু করবো। প্রথমেই বলি সমসাময়িক নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অন্তর্ঘাত নিয়ে এই কাহিনীটি রচিত হয়েছে তাই এর ভাষা অনেকটা আত্মকথনের মতো যার লক্ষ্য হয়তো বা আত্মোন্মোচন, হয়তো বা এক নিবিড় অশেষ রহস্যময়তা। অনেকটা ইংরেজি stream-of-consciousness আর স্বীকারোক্তিশীল monologue ঘেঁষা। একটার পর একটা করে সমস্ত চরিত্র যেন আপনাকে, আপনার সত্ত্বাকে অনেকগুলো স্তরে ঘিরে ধরে একটি অদ্ভুত সামাজিক আলোচনা-পর্যালোচনার আসরে ঘাড় ধরে বসিয়ে দেবে যার থেকে ওঠার উপায় নেই, যার যুক্তিযুক্ত প্রশ্নোত্তর আপনি মানুন আর না মানুন তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এরই মাঝে কাহিনী এগিয়ে চলে। পাঠক হিসেবে আমার পড়তে কেমন লেগেছে তা যদি বলতে যাই, তাহলে একটি উপমা দেবো। ধরে নিন, আপনি খুবই প্রকৃতিপ্রেমী একজন মানুষ। নিরালায় প্রকৃতি সঙ্গলাভ করতে অভিলাষী। সেই সূত্রে এক বর্ষণমুখর রাতে মাঝদারিয়ায় নৌকাপাড়ি দিলেন। তখন যেরকম উত্তাল ঢেউ আর মুহুর্মুহু দোলায় আপনি দুলবেন কতকটা সেরকম হলো উপন্যস্ত পাঠের অভিজ্ঞতা। তার কিছু অংশ সামাজিক ইতিহাস, পুঁজিবাজার, আখ্যানের মায়াবী কুহক আর স্মৃতিকাতর স্মৃতিলেখে ভরা আর কিছুটা একজন মানুষের নিজের ভেতরে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া অস্তিত্ববাদের ধ্বংসাবশেষকে খোঁজার কাহিনী। তার কিছুটা পাঠকমনে হেঁয়ালির ঝড় তোলে, কিছুটা গভীর ভাবায়, কিছুটা চোখের কোণে জল আনে, কিছুটা হয়তো কোনো চিন্তার বিস্ফোরণ ঘটায়, কিছুটা আত্মপ্রত্যয়ী করে আবার কিছু অংশ একদমই বোঝা যায় না।
বেশি উদাহরণ না দিয়ে দু-এক কথায় কেন এ কথা বলছি বলি। কাহিনীর এক জায়গায় মি. বিষয় ও মিসেস বিষয়ী বাক্যালাপে রত। মিসেস বিষয়ী কম্যুনিস্ট আইডেওলজিকে নিয়ে ধন্দে থেকেও উপলব্ধিতে আসতে চায় যে মেটিরিয়ালিস্ট আইডিয়ালীসম ছাড়াও কম্যুনিষ্মের একটা বৈপ্লবিক দিক রয়ে যায়। এর উত্তরে মি. বিষয় বলে, “সে তো সোনার পাথরবাটি!” মি. বিষয়ের এই যুক্তিতে মিসেস বিষয়ীর দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বিস্ফোরক উত্তর: “কমিউনিজম, হে লুপ্তপ্রায় চড়াই! তোমায় আমি গদ্যের সোনার পাথরবাটিতে খেতে দেব।”(১৩) এটাকে কি বলবো কমিউনিজমে দীক্ষিত বাঙ্গালী মনীষায় জর্জরিত কাতর স্বীকারোক্তি ছাড়া যা আমাদের চিন্তাশীল মনের ভেতরের প্রতিটা পরত কুড়ে কুড়ে খায়! আর একটি উদাহরণ দি। কাহিনীর শেষ অংশর নাম ‘শতরূপা ও গল্পের উত্তরাধিকার’। এ অংশের বক্তা একটি শাঁখচুন্নি যার দোসর সহায় আর বেঁচে নেই। কথাটা হচ্ছে আঙ্গিকগতভাবে দেখতে গেলে যখন কোনো লেখক সাহিত্যের ভেতরে নিজের গড়ে তোলা পাঠজগতের জাল গুটিয়ে আনেন তখন তার প্রায়-সমাপ্ত লেখা তার কাছে অতীতের প্রেত/প্রত্ন অস্তিত্বে পরিণত হয়। কিন্তু এটুকু ছাড়াও অর্কবাবু সহায়ের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে যে দিকে আমাদের মন টানছেন তা এক কথায় লেখক ও লেখার এই বাজারি পরিস্থিতিতে অসুরক্ষা হতে পারে, আবার লেখকের নিজের লেখার জন্য না বলা চিন্তাসকল বা অনিশ্চয়তাও হতে পারে। পাঠের এ বিশেষ অংশে এসে পাঠক হিসেবে আমি এখানে ভাবতে বাধ্য হই যে যা যা আমরা বুঝি, পড়ি, লিখি, চিন্তা করি সবই কি একটি সহায়হীনতার পথে যাত্রা নয়? যে লেখক আজ থেকে একশো বছর আগে লিখেছেন লেখার পর তিনি কি তার নিজের লেখা নিয়ে কোনোরকম সহায়হীনতা বোধ করেন নি? কোথাও কি সব লেখাই আবার একটু একটু করে নিজের কাছে, নিজের অস্তিত্ব ও নিজের অনুভূত মুহূর্তের কাছে ফিরে আসা নয়? অক্ষর, লিপি ও ভাষাকে অবলম্বন করে নিজের পরম আশ্রয় আপনত্বের জন্য সহায় খোঁজা নয়? একটা দীর্ঘ খরতাপে পোড়া মানুষের কাছে যেমন ঝুরিভরা বটতলা একটি নিরাপদ আশ্রয় তেমনি লেখা কি লেখকের কাছে একটা ঠাঁই নয়? তাই এ আখ্যানের শেষটা যেন অনেক সম্ভাবনাময় প্রশ্নকে খুঁচিয়ে তোলে। কয়েকটি লাইন তো দুর্ধর্ষ: “এসে গেল তার আমাকে শোনার দিন…” বা ” রাষ্ট্রের প্রতিনিধিও হয়তো এভাবে সাহিত্যের অভিসন্ধির কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ কর্তব্যরত রাষ্ট্রকর্মী হিসেবে কিছু একটা তো করতেই হত। তাই নিজেকে গল্পের ভেতর সেঁধিয়ে দিয়েছেন বাচাল পাঠক হিসেবে। গল্পটাকে নাকচ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কে জানে হয়তো এভাবেই তিনি গল্পের ভেতর ঢুকে অমর হয়ে থাকতে চেয়েছেন।” (১০৩)–এ রকম জায়গা পড়ে আমার অন্তত স্পিভাক কৃত দেরিদার অনুবাদ, Of Grammatology-র কথা মনে পড়েছে। নিজের লেখায় নিজে ঢোকা তারপর নিজেই তা থেকে নিজের করা নির্যাসকে নষ্ট করা–এ এমন এক আত্মবিনির্মাণ যার অনেক মানে হয়। নাকি পুরো লেখাটাই একটা ট্রেন জার্নির স্বপ্ন, একটা delirious feeling যা পক্ষান্তরে একটি ছায়াঘেরা রাতের ক্ষয়মান প্রেতপাঠ: যা কেবল আধো-জাগরণের-আধো-স্বপ্নের জগতে লেখকের একাকী পদচারণা যেখানে তিনি একা, এক সম্পূর্ণ একা নিঃস্ব পথিক। এখানে পাঠক অসহায়, যে খালি লেখকের দেখা/বলা/অনুভূত ছায়ার পেছনে ছুটছে। ছায়াগুলো কিসের বা আলোর উৎস কি এ নিয়ে তার কোনোই ধারণা নেই। নিছক আইডিয়ালিসম? নাকি নিজের দীর্ণ অস্তিত্বের প্রেত হাহাকার-জানি না অর্কবাবুকে পড়ার পর কোন বোধ থাকে। হয়তো একটু ভাবতে হবে এটাই লেখকের একক দাবি। তাকে বলতে দিতে হবে, ও শ্রোতাকে তার কথা ধৈর্য ধরে শুনতে হবে আর তার সঙ্গে চলতে হবে, অন্তত শেষ স্টেশন অব্ধি, না নেমে-এটুকুই হয়তো লেখক চান।
কিছু প্রশ্ন অবশ্য রয়েই যায় ভেতর ভেতর। প্রথমত, লেখাটা কি এক পথে বের হয়ে অনির্দিষ্ট পথের কোনো পথহারা যাত্রীর স্মৃতিচারণা যার থামার জো নেই? দ্বিতীয়ত, সেটা কি এক আবেগতাড়িত মানুষের স্বমেহন যার পটভূমি জীবন আর যার সামনে সিনেমার সিনের মত ব্যাকড্রপে পড়ে থাকে জীবনমঞ্চে ঘটে চলা অভিনয়ের দৃশ্যরাজি? লেখকের পরিচয় কি? সে কেন বহুস্বর শুনছে? নাকি এটা জয়েসের Ulysses-এর মতোই এক তীর্থযাত্রা? নাকি ভূমিকায় যেমন অর্কবাবু বলেছেন:এটা আসলে এক বেতালের গল্প, মানে বেতাল কোনো এক লিলুয়াবাসীর গল্প কারণ লিলুয়া জায়গাটা লেখায় উল্লিখিত হয়েছে। মজার কথা, লোকায়ত বেতালের গল্পে এই জ্ঞানী প্রেতটি আপন মুক্তির জন্য নিজের তুল্য এক বিক্রমশালী জ্ঞানী মানুষের অপেক্ষায় থাকে যার কাছে তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর আছে। অবশ্য সব উত্তরই আপেক্ষিক, এবং এটা জানে বলেই না সহায় মরে যাওয়ার আগে (বা সে যে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে এটা আমরা বোঝার আগেই) narrative therapy-র কথা বলে। এইসব উল্লিখিত কারণেই এক এক সময় এই উপন্যাসে লিখিত কোলাজগুলো জেলখানায় বদ্ধ ইন্টারোগেশন রুমে বসা কোনো একা স্বীকৃতি দেওয়া বেনামী কয়েদীর আশাবাদী জবানবন্দীর মতো মনে হয়। এক এক সময় মনে হয় এলোমেলো কিছু কথা যেন লিপিবদ্ধ করা হলো। আবার এক এক সময় মি. বিষয়কে আমার সহায় মনে হয়েছে পুঁজিবাদ যাকে মেরে ফেলেছে। আবার এটাও আমার মনে হয়েছে যে কাহিনীটি হয়তো আসলে মি. বিষয়ের সঙ্গিনী স্বপ্নিল চোখের শাঁখচুন্নির স্বপ্নযাত্রা যে আসলে মিসেস বিষয়ী। শাঁখচুন্নি বিষয়ী কারণ সে আজও মি. বিষয়ের স্বপ্নগুলো নিয়ে কোনো এক শ্যাওড়াগাছের নিভৃত মগডালে বসে অপেক্ষা করে এই আশায় যে যদি কখনো কেউ তার মৃত প্রেমিকের এ ভাবনাগুলো শোনে; কিন্তু তাই বলে সে কিছুতেই চায় না যে তার প্রয়াত প্ৰণয়ীর লেখার বাণিজ্য হোক কারণ বাণীর মতোই এতে সহায়ের সমস্ত জীবনের চিন্তাভাণ্ডারের চাবিকাঠি বা সূত্রগুলি লুকোনো আছে যা তার যক্ষের ধন। প্রশ্ন রয়ে যায়, তবে কার জন্য এ উত্তরাধিকার, এ জ্ঞাননিষ্ঠ কথকতার আসর? পাসকাল বলেছিলেন লেখক নাকি সহস্র আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রদের জন্যও মাঝে মাঝে লেখ্য সুরের নৈবেদ্য ভাসিয়ে রাখেন যা ব্রহ্মাণ্ডের দিকে দিকে ছড়াতেই থাকে যতক্ষণ না কোনো আরেক সত্ত্বায় তার অনুরণন সৃষ্টি হয়। কোন পাঠক সে অনুরণন পাবেন সেটা বোধহয় কেবল মহাকাল জানেন, তবে অনন্তের পথে কেউ না কেউ যে এ ডাক পাবেই সেটা নিশ্চিত। কারণ চিন্তা আর অধিকার দুটোই অর্জন করতে হয় আর কেউ না কেউ সেটা করেই। এক অনন্য আইডিয়ালিসম বা আশা তাই রয়েই যায়। আর ততদিন অব্ধি সব পাঠ অসম্পূর্ণ কারণ তা কেবল ন্যস্ত করা বা ঘাড়ে চাপানো, যা পাঠ করার লোক খুঁজে মরে। লেখা তাই আঁচড় হয়ে রয়, লিপি হয়েই রয় যতক্ষণ না মানে বের করার জন্য কেউ উত্তরসূরি হিসেবে আসছে। এটা অবশ্য আরও পাঠকেরাই বলবেন যে অর্কবাবুর লেখার নাম এই সূত্রকে নির্দেশ করে কিনা। এই ছোট পরিসরে নিজের কিছু ছোটখাটো চিন্তাভাবনা সবার সামনে তুলে ধরলাম। আশা করছি আরো নতুন কোনো পাঠক আমার মতই উপন্যাসটির অভিনব কোনো পাঠ প্রতিক্রিয়া উপহার দেবেন। এভাবেই উপন্যস্তের আলোচনা চলতে থাকবে।
[লেখক:- দেবাঞ্জন মিত্র, সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, মৃণালিনী দত্ত মহাবিদ্যাপিঠ]
Posted in: Criticism, February 2019