মার্ক্সবাদ, উত্তর আধুনিকতা ও আজকের বিশ্বায়ন – তিমির বরণ চক্রবর্তী, পিনাকী ভট্টাচার্য
মানুষের সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে কি কোনো সাধারণ ধারা দেখতে পাওয়া যায়? মানবসভ্যতা কি নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে উন্নীত হওয়ার ইতিহাস? কান্ট্,হেগেল, মার্ক্স প্রমুখ দার্শনিক তথা সমাজ বিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজে এসেছেন। এদের মধ্যে মার্কস ও এঙ্গেলস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সাহায্যে ইতিহাসের ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যায় তারা দেখিয়েছেন যে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রের উচ্চস্তরে উন্নয়ন। এটাই ছিল আলোকায়ন ও যুক্তিবাদ এর উপর দাঁড়িয়ে ইতিহাসের যাত্রা পথ নির্ণয়।আলোকায়নই প্রথম ঘোষণা করে যে `বিশ্বাসের যুগ ‘ অর্থাৎ মধ্যযুগ শেষ। আলোকায়ন এর সামনে কাউকেই রেয়াত করা হয় নি, তা সে ধৰ্ম হোক বা সমাজ, প্রকৃতি বিজ্ঞান হোক বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। যৌক্তিক বিচারের সামনে যে দাঁড়াতে পারেনি তাকেই খারিজ করা হয়েছে।একথা সত্য যে মার্কস হেগেল দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে অবলম্বন করে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন এক সিদ্ধান্তে পৌঁছান যা কিনা হেগেল এর সিদ্ধান্তের ঠিক উল্টো। হেগেল এর মতে মানব সভ্যতার যাত্রা শেষ ইউরোপীয় বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থায়, এখানে সমাজতন্ত্রের কোনো স্থান নেই। সাম্যবাদের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মার্ক্স এই বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থার মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করেন, যা কিনা শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব। মার্কস এর মতে এই দ্বন্দ্বর অবসান হলেই সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। মার্ক্সের দর্শনে তিনটি সমকালীন ধারণার প্রভাব ছিলো। হেগেল এর কথা আগেই বলা হয়েছে, হেগেল ছাড়াও কান্ট এবং ফয়েরনেখের জার্মান দর্শন, মার্ক্সকে দিয়েছিলো তারদ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তি, এছাড়াও উনবিংশ শতকের ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডোর অর্থনৈতিক তত্ত্ব মার্ক্সকে অনুপ্রাণিত করেছিলো তার অর্থনৈতিক তত্ত্ব সাজাতে আর সর্বোপরি ফরাসী বিপ্লবের চিন্তাধারা তাকে দিয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব নির্মাণের পথ। মার্ক্স বলতেন, ‘এতদিন ধরে দার্শনিকেরা পৃথিবীকে কেবল ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল একে পরিবর্তন করা।’ মার্ক্স তার জীবদ্দশায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আর্থসামাজিক বিন্যাস লক্ষ্য করেন। এই পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শোষণমূলক এবং মানবতাবিরোধী রূপ দেখে তিনি ব্যথিত হন –আর এ থেকে সাধারণ বঞ্চিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তার জীবদ্দশায় পৃথিবীর আর্থ সামাজিক বিন্যাসের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে মানব ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ভিত্তি খুঁজে নেন, এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের শোষণ মুক্ত সমাজ গঠনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন মার্ক্স। মার্ক্স ধারণা করেছেন, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একদিকে যেমন শোষিত শ্রেনী প্রচণ্ড ভাবে শোষিত এবং নিপিরিত হবে, তেমনি তাদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তারা যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে সামিল হবে, আর তাতে তাদের বিজয় হবে অনিবার্য। জনগন প্রবেশ করবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। তিনি মনে করেন এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানায় পরিচালিত হবে এবং তাই এই উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যে উদ্বৃত্ত মূল্য বা ‘সারপ্লাস’ ভ্যালু তৈরি হবে, তা সমাজের স্বার্থেই পুনর্বিয়োগ করা হবে। এর পরবর্তী পর্যায়ে ‘বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী’ সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যা মানব সমাজের সর্বোচ্চ রূপ। কার্ল মার্ক্স তার এই চিন্তাধারাকে প্রয়োগ সম্পর্কিত দর্শন বা ‘ফিলোসফি অব প্র্যাক্টিস’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই উপলব্ধিটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান বলে অনেকেই মনে করেন। আর সেজন্যই একটা সময় মার্ক্সের ধারণা সারা বিশ্ব জুড়ে অগনিত চিন্তাশীল মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলো।
সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর হেগেলীয় চিন্তায় আস্থাবান মানুষজন সাম্যবাদী সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে শুরু করলেও এর অনেক আগে থেকেই সাম্যবাদী ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠতে থাকে। ১৯১৮ সালে কাউটস্কি তার লেখায় লেনিন এর সর্বহারার একনায়কতন্ত্র মার্কসবাদ সম্মত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, ১৯২০ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল একাধিক প্রশ্ন তোলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধর পর পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলিতে সমাজতন্ত্র না আসার কারণ নিয়ে, প্রশ্ন তোলে নাৎসি উত্থান নিয়ে। তাই তারা গড়েতোলে ক্রিটিক্যাল তত্ত্বের যা ক্রমান্বয়ে জন্ম দায়ে উত্তর আধুনিক তত্ত্বের। রেডিকাল কথাবার্তার মোড়কে উত্তর আধুনিক কিন্তু বহুলাংশেই রাক্ষনশীল। মার্কসীয় মহাবাচনিক তত্ব কে খারিজ করে খন্ড বাচন তত্ব কে তুলে ধরার মাধ্যমে একটি নান্দনিক আন্দোলনএর সূচনা করলেও ঘুরপথে পুঁজিবাদ এতে অক্সিজেন পায়। Frederic Jameson এর মতে, আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদ হলো একটি সাংস্কৃতিক গঠন যা পুঁজিবাদের নির্দিষ্ট ধাপের সাথে জড়িত। তিনি পুঁজিবাদের তিনটি প্রাথমিক ধাপের কথা উল্লেখ করেন যা কিনা নির্দিষ্ট ধরণের সাংস্কৃতিক চর্চাকে নির্দেশ করে
১. প্রথমটি হলো market capitalism, এই ভাগে রয়েছে প্রযুক্তিগত উন্নয় এবং একটি নির্দিষ্ট ধরনের নান্দনিকতা যাকে বলা হয় realism।
২. দ্বিতীয়টি হলো monopoly capitalism, এই ভাগে রয়েছে এবং আধুনিকতা।
৩. তৃতীয়টি হলো multinational or consumer capitalism, এটি হলো বর্তমান সময় যেখানে পণ্য উৎপাদনের চেয়ে পণ্য বাজারজাতকরণ, বিক্রি এবং ভোগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। যার সাথে জড়িত পারমাণবিক এবং বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি এবং যার সাথে উত্তর-আধুনিকতাবাদ ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। কিন্তু কি ভাবে? যেহেতু উত্তর-আধুনিকতাবাদ মহাবাচন গড়তে চায় না তাই পুঁজির বিরুদ্ধেও এই তত্ব কোনো মহাবাচন তৈরি করে না, ফলত এই তত্ত্বের থেকে পুঁজির কোনো ভয় নাই। এখন পুঁজির বিরুদ্ধে মহাবাচন টি নাকচ হলেও পুঁজি কিন্তু তার মহাবাচন টি পরিত্যেগ করে না, বরং তার নায়েরেটিভ এ সকল কে টেনে নেয়।তাহলে প্রশ্ন আসে পৃথিবী যুরে পুঁজিবাদ বা ধণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রের উত্তরণের যে ‘আমূল ভবিষ্যদ্বানী’ মার্ক্স করেছিলেন, আজকের বিশ্ব সেই পথে চলছে কি ? মার্ক্স মনে করেছিলেন যে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনী বুঝি কেবল শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হবে এবং এর ফলে শ্রমিক শ্রেনীর পিঠ ‘দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ায়’ তারা ধণতান্ত্রিক সিস্টেমের পতন ত্বরান্বিত করবে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় সফলতা এলেও ধনতন্ত্রের পতন হয়নি, বরং বলা যায় ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদি ব্যবস্থা নিজস্ব সিস্টেমের দুর্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে বিবর্তিত হয়েছে। আজকের দিন এ ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিশীলিত রূপ গ্রহণ করার ফলে শ্রমশক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ কায়িক শ্রম দানের পরিবর্তে বুদ্ধিজনিত শ্রমদান (মেন্টাল লেবার) করছে এবং তারাই মধ্যবিত্তসূলভ জীবন জাপন করছে। মার্ক্সের সনাতন ধারণায় সমগ্র উৎপাদিকা শক্তিকে কেবলমাত্র কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমিকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেছিলেন – যা আজকের দুনিয়ার সাপেক্ষে অনেকটাই বাতিলযোগ্য।এর সাথে যোগ হয়েছে পুঁজির অবাধ গতি। পুঁজির একটা বড়ো অংশই লগ্নি পুঁজি হাওয়ায় তা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাজে না লেগেও শুধু গতিশীলতার জন্য দেশের অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। এই পুঁজি কে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে সরকার কে ও আপোসের রাস্তায় যেতে হচ্ছে। উৎপাদন পুঁজির যে টুকু কোনো দেশ এ আসছে সে ও কোনো এক্সিস্টিং কোনো শিল্প কে অধিগ্রহণে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে, ফলে নতুন করে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক এর যে সমস্ত দাবি থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো জীবিকার অধিকার কে নিশ্চিত করা, যে কারণে সমাজতান্ত্রিক দেশে এ অধিকার সংবিধান স্বীকৃত, কিন্তু বাজারের সেই দায় নাই তাই আসমাজতান্ত্রিক দেশ এ জীবিকার অধিকার থেকে যায় সংবিধানের নির্দেশাত্মক অংশে।এখন পুঁজির গতির সঙ্গে শ্রমিক তো আর গতিশীল নয় তাই তারা সংগঠিত হয়ে আগের মতো শ্রমিক আন্দোলন কে জোরদার করতে পারছে না। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ স্টিগলিজ তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে আমেরিকার বর্তমান পুরুষ শ্রমিক দের রিয়েল ওয়েজ ৬৮ সালের ওয়াজের সমতুল্য। কিন্তু লেবার প্রোডাক্টিভিটি বেড়ে চলেছে , ফলত সারপ্লাস আরনার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন যে ওভার প্রোডাকশন হচ্ছে তার বিক্রয় যোগ্য বাজার পাওয়া যায় না , কারণ অনেক মার্কেট সার্ভে , ইনভেন্টরি সিস্টেম থাকার পর ও উৎপাদন এক্সাক্ট হওয়া সম্ভব হয় না.এর থেকে মুক্তির জন্য বাজার এ bubble তৈরী হয় যা কি না asset এর speculative increase . যার কাছে ওই asset থেকে সে ধনি হয়, ফলে কিছু খরচও করে, যাতে ওই over production সাময়িক দূর হয় কিন্তু bubble collapse করলে আবার সেই সমস্যা। আগেকার দিনে ফ্যাসিস্ট শক্তি যুদ্ধ করে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতো এবং যুদ্ধের ফলে ফ্যাসিস্ট শক্তি ধ্বংস ও হতো। এখন সেই সুযোগ নাই কারণ পুঁজি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকার জন্য capitalist রা চাইবে না কোনো দেশ অন্যদেশ কে আক্রমণ করুক কারণ দুটি দেশই হয় তো তার পুঁজি রয়েছে। এর ফলে সমস্যার সমাধান ও হয় না ফ্যাসিস্ট শক্তি ধ্বংস ও হয় না।প্রশ্ন আসে তাহলে এর থেকে মুক্তি কোথায়? সহজ উত্তর এই সিস্টেম থেকে নিজেদের বার করে না নিয়ে আস্তে পারলে মুক্তি নাই আর তা সম্ভব নতুন প্রেক্ষিতে মার্কস কে খুঁজে নেওয়া। উত্তর আধুনিক চিন্তাবিদ কিন্তু আদতে মার্ক্সিস্ট দেরিদা তার Specters of Marx (1994) বইয়ে দেখান , মার্ক্সের তত্ত্ব নয়, মার্ক্সিজমের এই মুক্তিকামী ‘স্পিরিট’টিকে তারকাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ । মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞানেয় চেয়ে তিনি ‘লিঙ্ক অব এফিনিটি, সাফারিং এন্ড হোপ’ হিসবে দেখতে চেয়েছেন । এ যেন Stephen Jay Gould এর দর্শনে ‘স্বতন্ত্র বলয়’ প্রবর্তন করে ধর্মকে বিজ্ঞান থেকে মুক্ত রাখার প্রচেষ্টার মতো প্রচেষ্টা। এখানে দেরিদা মার্ক্সিজমকে ‘সায়েণ্টিফিক সিস্টেম’ থেকে আলাদা করে ‘মরাল সিস্টেমে’ এর প্রয়োগ করার কথা বলেছেন এবং বুঝিয়েছেন আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে তার এই প্রস্তাবনা মার্ক্সিস্টদের কেন মেনে নেওয়া উচিৎ। উত্তর আধুনিকতার সাহায্য নিয়ে যে ভাবে পুঁজিবাদ ডানা মেলেছে, তার থেকে মুক্তির জন্য এই নতুন দৃষ্টি তে মার্ক্সবাদকে দেখার , ভাবার এবং প্রয়োগের মধ্যেই থাকবে আগামীর হাজারো নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আলোকবর্তিকা।
Posted in: January 2019, Prose