নিউ মার্কেট : সেকাল একাল – সোমা দত্ত

সাল ১৯৩০। বছর চল্লিশের মিসেস ব্রাউন সঙ্গী সহকারিণীকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন লিন্সে ষ্ট্রীট নিউ মার্কেটের পূর্ব দিকের গেটে। নেমেই কুলি নিয়ে নিলেন। হ্যাঁ, রীতিমত কর্পোরেশন-এর রেজিস্ট্রেশন নম্বর সমেত এরা মালবাহকের কাজ করেন নিউ মার্কেটে। ঝুড়ি হাতে কুলিও চলল মেম সাহেবের পিছন পিছন। সেদিন মিসেস ব্রাউনের প্রচুর জিনিষ কেনার আছে। একেতো শনিবার বাড়িতে পার্টি, তার জন্য প্রয়োজনীয় সব্জী ফল মাংস কিনে কুলির মাথায় করে ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন গাড়িতে। এবার তিনি চললেন মার্কেটের মাঝ বরাবর পশ্চিম দিকে। সেখানে কিছু চকলেট কেক, কুকিস কিনে যাবেন উত্তর দিকে। ওদিকে আছে ‘প্যামপোশের’ শোরুম। যদি বা সেটি নেটিভ কাশ্মীরি দোকান কিন্তু সেখানকার কাঠের কারুকাজ করা গয়নার বাক্স আর উপহার সামগ্রীর যথেষ্ট কদর হয়েছে ব্রিটেনে। আগত বড়দিনের উপহার এবারও সেখান থেকেই কিনবেন ভাবছেন। মাঝপথে ‘রেনকেন এন্ড কোম্পানি’র দোকানে দেখবেন বড়দিনের পোশাকের সম্ভার এল কিনা? উৎসবে পরবার জুতোর জন্য ‘কাথবারটসন এন্ড হারপর’-এর দোকানেও একবার ঢুঁ মারতে হবে বই কি। পথে মিস ব্রিগেঞ্জার সাথে দেখা। তিনি ‘আর.ডব্লিউ. নিউমার এন্ড ট্যাকার স্পিন’ থেকে বই আর ষ্টেশনারী জিনিষপত্র কিনে কুলির মাথায় চাপিয়ে ফিরছেন। খানিক কুশল বিনিময়ের পর যে যার পথে ধরলেন…..
ভাবছেন তো এ আবার কেমন গল্প ফেঁদেছি। না, ঠিক গল্প নয়, একটা ছবি। স্বাধীনতার আগে খানিকটা এমনি ছিল ধর্মতলা নিউ মার্কেট। ১৮৭১ সালে তৎকালীন কলকাতা কর্পোরেশন কিনেছিল লিন্সে ষ্ট্রিটের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এই পরিসরের মধ্যে থাকা পুরোনো ফেনউইক বাজার ভেঙ্গে ফেলে গড়ে উঠল ‘নিউ মার্কেট’। যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় সব্জী ফল ফুল মাংস ষ্টেশনারী বই পত্র থেকে পোশাক জুতো ব্যাগ উপহার সামগ্রী সব সমস্তকিছুই পাওয়া যাবে একছাদের নীচে। কোনো কারণেই আর নেটিভ ইন্ডিয়ানদের সাথে গা ঠেলাঠেলি করে বাজার করতে হবেনা কলকাতায় বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরীকদের। ‘ভিক্টোরিয়ান গথিক মার্কেট কমপ্লেক্স’, নিউ মার্কেটের পোশাকি নাম। রিচার্ড রসকেল বাইনির ডিজাইনে মার্কেটটি বানালেন বিল্ডার ম্যাকিনটস বার্ন। ১৮৭৪ সালে মার্কেটটি খুলে দেওয়া হল ক্রেতাদের জন্য, বিশেষত কলকাতায় বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিক আর কলকাতার বন্দরে আসা বিদেশী পর্যটকদের জন্য।
আবার একটা খটকা। ভাবছেন, তবে যে এসপ্ল্যানেড অবস্থিত নিউ মার্কেটকে ‘হগ মার্কেট’ বলে? হ্যাঁ, ২রা ডিসেম্বর ১৯০৩ থেকে এই মার্কেটের পোশাকি নাম হয় ‘এস.এস.হগ মার্কেট’। কিন্তু এর জন্মলগ্নে হগ সাহেব কোথাও ছিলেননা। নিউ মার্কেট চালু হওয়ার বেশ কিছু বছর পর কলকাতা কর্পোরেশন-এর চেয়ারম্যান হয়ে এলেন তিনি। সাহেবের হাত ধরে এই মার্কেটের প্রভূত উন্নতি সাধন হয়। সম্ভবত তাঁর সময়েই মার্কেটের ২০০০ দোকানের বিলি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয় এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও এই মার্কেটে বাণিজ্যের ছাড়পত্র পান।
আজ ২০১৮। ১৪৪ বছর বয়স হল নিউ মার্কেটের। বৃদ্ধ হল ভাবছেন? না,একদমই নয়। যা কিছু প্রতিনিয়ত বদলায়, উত্তরণ ঘটে যার, তাকে কি আমরা বৃদ্ধ বলি? বলি,তরুণ, যৌবনে ভরপুর। অনেক অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে স্বাধীনতার পর থেকেই। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করতে করতে রাজপাটে জাঁকিয়ে বসেছিল আবার রাজপাট গোটাতে গোটাতেই বাণিজ্য পাটও গুটিয়ে ফেলল ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি। সে জায়গায় ভারতীয়রা পেলেন ব্যবসা করার ছাড়পত্র (আর.পি.এইচ)। আজও কলকাতা কর্পোরেশনই মালিক এই মার্কেটের। মিউটেশন চার্জ নিয়ে কর্পোরেশন ব্যবসা করার ছাড়পত্র দেন। আজ আর কাউকে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে ক্রেতার মাল বইতে দেখা যায়না। কুলি ব্যবস্থা বাতিল করেছে কর্পোরেশন। কিন্তু এই মানুষগুলি আছেন মার্কেটেই। এই তাদের জীবিকা নির্ধারণের একমাত্র জানা পথ। এরা এখন এই মার্কেটের গাইড বলতে পারেন আবার দালালও। দেশী বিদেশী পর্যটকদের চাহিদামত দোকান খুঁজে পেতে সাহায্য করেন এরা, সেই দোকানির সাথে অর্থের বিনিময়ে। এ ব্যবস্থা নিয়ম বহির্ভূত তো বটেই, অনেক সময় বিরক্তিকরও। আবার অসুখও বলতে পারেন। যেমন, মার্কেটের সামনের রাস্তায় হকার্স কর্ণারের বাড়বাড়ন্ত, পার্কিং লট না থাকা এমন কতগুলি অসুখে আক্রান্ত নিউ মার্কেট। অসুখ সারানো যায় কিনা, তার জন্য কি করা দরকার তা অবশ্যই মার্কেটের ভার যাদের উপর তাঁরা ভাববেন। আমি ভাবছি অন্য কথা।
স্বাধীনতার পরও বেশ কিছু বছর বিত্তশালী বাঙালিই ছিলেন এই বাজারের নিয়মিত ক্রেতার তালিকায়। সে অবস্থান কিন্তু এখন বদলেছে। উচ্চবিত্ত কলকাতাবাসী (বাঙালি, মাড়োয়ারি, সিন্ধী, বিহারী) থেকে সাধারণত খেটে খাওয়া মানুষ সবাই স্বাগত এই বাজারে।সেলিব্রিটি থেকে অনামী গেরস্ত সবাই এই বাজারের ক্রেতা। বাংলার দূর দূরান্ত মফস্বলের মানুষও এই বাজারের ক্রেতা। ৫০০ থেকে ৫০০০/১০০০০ সব বাজেটের ক্রেতাদের হাত ভরে দিতে সর্বদা প্রস্তুত কলকাতা নিউ মার্কেট। ঈদ,পুজো,বড়দিন সব উৎসবেই এক হৈ হৈ ব্যাপার রৈ রৈ কান্ড চলেছে। আজ আর কোনো বন্দিশ নেই, নেই কোনো হীনমন্যতা। নিউ মার্কেটের ছাদের তলায় পেটের টানে রুজিরোজগারের টানে একত্রিত হয়েছে গোটা ভারতবর্ষ। হিন্দু মুসলিম পার্শি সিন্ধী জাতধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ লড়ে চলেছে বাঁচার লড়াই। হ্যাঁ, এখনকার খুচরো ব্যবসায়ীমহল সাধারণ মানুষ, কোনো শিল্পপতি নয়। মার্কেটের দোকানী তার কর্মচারী, মার্কেটের সাথে যুক্ত হোলসেলার, চা ওয়ালা আশপাশের খাবার দোকান সবাই একই সূত্রে বাঁধা। সবাই নির্ভরশীল এই মার্কেটের উপর। শিল্পপতিরা খুচরো ব্যবসায় প্রবেশ করে একপ্রকার এঁদের ঘাড়েই পা রেখেছেন, সে তো অনেককাল হয়ে গেল। ইদানীংকালের জোড়া ধাক্কা ছিল নোটবন্দী আর জি এস টি। বড্ড কঠিন হয়ে উঠছে দুধেভাতে থাকার লড়াই। এতসব সত্ত্বেও বৃহৎ কোনো প্রতিবাদ-আন্দোলনে যান না ব্যবসায়ীরা।কেন?? কারণ তো নিশ্চয় কিছু আছে? কি হতে পারে?
প্রতিবাদ আন্দোলন মানে অশান্তিপূর্ণ অবস্থান? কাজের দিন নষ্ট, মানে অনেক ক্ষতি, কিন্তু কোনো সমাধান নেই। পরিত্রাণ নেই, সাধারণ মানুষের সুখসুবিধা কবেই বা ভেবেছে রাষ্ট্রের শাসক? ভাববে, এমন কোনো সম্ভাবনা কি দেখা যাচ্ছে অদূর- দূর ভবিষ্যতে?? এত ভাববার সময় কোথায়?? সকাল থেকে রাত চলে যায় ডাল ভাতের ব্যবস্থা করতেই। বাকীটা নিয়তির ভরসা… এ বড় কঠিন জাঁতাকল, যাতে পিষে গেছে মানুষ।
১৯৮৫ ডিসেম্বরে আগুন লাগার পর পরিবর্তন হয়েছে এর কলেবরেও। আগে একই ছাদের তলায় ছিল ২০০০ দোকান। পরে পুড়ে যাওয়া অংশ(বর্তমান কর্পোরেশন বিল্ডিং এর দিক) ভেঙে ফেলে তাকে বেসমেন্ট থেকে নিয়ে মাটির উপরে চারতলা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই অংশ এখন নিউ মার্কেটের ‘নিউ কমপ্লেক্স’ ব’লে পরিচিত। দোকান সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৬০০। একসময় শুনতাম নিউ মার্কেটে বাঘের চোখও পাওয়া যায়। বাঘের চোখ তো দেখিনি বটে কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে কিনা পাওয়া যায় এখানে! কলকাতার যে কোনো অত্যাধুনিক শপিং মল নিউ মার্কেটের সামনে ডাহা ফেল।
Posted in: January 2019, Prose