ক্যাপ্টেন হুররা : এক ঠিকানা খোঁজার সফর – সৌরভ দত্ত

“আমি এমন একটা দেশে থাকি, যেখানে বৃষ্টি পড়লে সব জায়গা ভিজে যায়, শুধু আমার শুকনো মনটা ছাড়া… যেখানে আলো পড়লে সব জায়গা ঝলমলিয়ে ওঠে, শুধু আমার মনের অন্ধকার কোনটা ছাড়া…”
কথাগুলো কি খুব চেনা লাগছে? একদম নিজের বলে মনে হচ্ছে? এমন দেশে কি আমরা সবাই থাকি? কথাগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ভাবিয়ে চলেছে। আসলে একটা কথা ইদানীং প্রায়ই শুনি, “থিয়েটার শুধুই বিনোদনের একটা মাধ্যম।” অথচ ছোট থেকে শুনে এসেছি “থিয়েটার বিনোদনের এমন একটা মাধ্যম যা নতুন ভাবনা, নতুন চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করে, বিনোদনের অন্য কোনও মাধ্যম যা এত তীব্র ভাবে করতে পারেনা। আর এই কারণেই সংস্কৃতির সব থেকে শক্তিশালী এবং সংবেদনশীল মাধ্যম থিয়েটার।” আমি অর্বাচীন। তেমন কোনও জ্ঞান থিয়েটার সম্পর্কে নেই। তবে হ্যাঁ বার বার থিয়েটার দেখতে যাই মগজের কোষগুলোতে পুষ্টি জোগানোর জন্য। নতুন করে আরও একটু পুষ্টি যোগ হল ‘ইচ্ছেমত’-র নতুন প্রযোজনা, মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘ক্যাপ্টেন হুররা’ দেখে।
কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? এ নাটকের মঞ্চ এমন একটা ইল্যিউশন তৈরি করে যাকে আরো বেশি জীবন্ত করে তোলে আলো। মঞ্চ জুড়ে ছড়ানো ছেটানো গ্রাম, মই, টায়ার, বস্তা, কাঁটাতার, টিনের বাক্স, সুটকেসের স্থাপত্য সমস্ত চেনা ছকের বাইরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। আলোর সাথে সারাক্ষণ ধরে মিশে থাকা ধোঁয়া যেন নতুন করে আজকের সময়ের রাজনৈতিক ধোঁয়াশাকে সামনে নিয়ে আসে। থিয়েটারের সমস্ত উপকরণ যখন একে অপরকে টপকে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে তখন থিয়েটার কানায় কানায় পূর্ণ করে দেয়। যখন জীবনের যন্ত্রণা গুলো কবিতা হয়ে যায় আর ক্ষয়ে ক্ষয়ে বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত নতুন স্বপ্নের দিকে টেনে নিয়ে যায়, তখন বাঁচার মত বেঁচে ওঠার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে মন। নতুন করে ভাবতে শেখার শুরু এখান থেকেই।
না, নাটকের গল্পটা বলবনা। সেটা যারা চাইবেন তারা হলে গিয়ে দেখবেন। শুধু বলব, একটা নাটক শেষ হওয়ার পর ভালোলাগায় পরিপূর্ণ মন যখন নতুন ভাবনার জন্ম দেয়, থিয়েটার তখনই থিয়েটার হয়ে ওঠে। তীব্র সংকটের মধ্যেই যে সম্ভাবনার বীজ লুকিয়ে থাকে তা আবার সামনে নিয়ে এলো ক্যাপ্টেন হুররা। ভীষণ কঠিন বিষয়কে যিনি ভীষণ সহজ করে বলতে পারেন, আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক বিষয়ের নাটকে এমন ভাবে একের পর এক পুরনো হিন্দি গানের অর্থবহ প্রয়োগ, সাবলীল ভাবে কৌতুকের ব্যবহার যে নির্দেশক করতে পারেন তার সামনে নতজানু হতেই হয়।
তুর্ণা দাশ এর অভিনয় নিয়ে কিছু বলতে চাওয়ার কোনো ধৃষ্টতা আমার নেই। অপ্রতিম সরকারের অভিনয়ের গুণমুগ্ধ এর আগের নাটক গুলো দেখেই হয়েছি। আর, আজ নতুন করে গুণমুগ্ধ হলাম সুলগ্না নাথ আর শুভায়ন ঘোষ-এর। খুব ছোট্ট দুটো চরিত্রে জাস্ট ছিটকে দিল অরিন্দম সর্দার আর কুশল চট্টোপাধ্যায়। কৃষ্ণেন্দুর গীটার গান এবং অভিনয়ের অনুরাগী আগে যেমন ছিলাম, আবারও নতুন করে মোহিত হলাম। নতুন করে শুভ্রজ্যোতির যন্ত্রানুসঙ্গের প্রেমে পড়লাম। প্রেমে জড়াল আলোর কারিগর সৌমেন চক্রবর্তী, মন কাড়ল দেবদীপ মুখার্জি, যিনি এই নাটকের সংগীতকার। যে সঙ্গীত নেপথ্যের হয়েও কখনই নেপথ্যের নয়।
এই নাটকের মূল কারিগর সৌরভ পালোধী’কে আবারও সেলাম। প্রায় চার দশক আগে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এই নাটক আজকের দিনের কথা হয়ে ওঠে কি ভাবে তা দেখিয়েছেন সৌরভ। পাশ কাটিয়ে নয়, বরং ভীষণভাবে পক্ষ অবলম্বন করে সৌরভ নির্মাণ করেছেন এই নাটক।
বহু বছর আগে সুমন তার গানে বলেছিলেন “আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি কার তাতে কী…” এখন তো স্বপ্ন দেখতেও রাষ্ট্রের অনুমতি লাগে। ইচ্ছেমতো র সকলে এই আকালে দাঁড়িয়ে যে জাহাজটায় সফর করাল সেই “সিন্ধু সহচর” এর নাবিক ক্যাপ্টেন হুররা এমন একটা দেশের দিকে নিয়ে যেতে চায় যেখানে রাষ্ট্রের চোখ রাঙানি নেই। যে জাহাজে দাঁড়িয়ে ওরা সবাই গেয়ে ওঠে –
এমন একটা দেশ,
যার ম্যাপ কোথায় নেই জানা
হাত বাড়ালে বুক ভরা বাতাস,
মাটি খুঁড়লেই সোনা
সব কিছুই নয় শেষ,
দুঃখে কেঁদো না কেউ
যেতেই হবে কমরেড,
যেথায় চোখ তুললে ঢেউ…
ভীষণ ভীষণ আশার কথা, হাতে গোনা অন্য কয়েকজনের মত সৌরভ-তুর্ণার হাত ধরে থিয়েটারের একটা ‘শিক্ষিত প্রজন্ম’ তৈরি করছে ‘ইচ্ছেমতো’।
ক্যাপ্টেন হুররা
নাটক- মোহিত চট্টোপাধ্যায়।
পরিচালনা- সৌরভ পালোধী।
সহকারী পরিচালনা- শান্তনু মণ্ডল, শুভজিৎ দাস।
সঙ্গীত- দেবদীপ মুখার্জী।
সঙ্গীত সহযোগিতা- কৃষ্ণেন্দু সাহা, শুভ্রজ্যোতি বাগচী।
আলো- সৌমেন চক্রবর্তী।
মঞ্চ ভাবনা- ‘ইচ্ছেমতো’র সকলে।
পোশাক- অমিত রায়, সুদেষ্ণা বসু।
নেপথ্য সহযোগিতা- সজল চক্রবর্তী, দিব্যজ্যোতি, শুভেন্দু বিশ্বাস , অনুরাগ রায় চৌধুরী, অব্যয় সাধু।
অভিনয়- অপ্রতিম সরকার, সুলগ্না নাথ, শুভায়ন ঘোষ, অরিন্দম সরদার, কুশল চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চক্রবর্তী, শুভাশিস খামারু ও নাম ভূমিকায় তূর্ণা দাশ।
Posted in: Criticism, January 2019
অসাধারণ রিভিউ।