ভারতীয় দর্শনে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর অবদান : প্রদীপ গোখলে
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৯১৮-৯৩) ছিলেন স্বনামধন্য এক মার্ক্সবাদী পণ্ডিত। এই সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে আমি প্রচেষ্টা করব ভারতীয় দর্শনে তাঁর অবদানকে মহিমান্বিত ভাবে পরিস্ফুট করার।
সমাজবাদের নিমিত্তে সংগ্রামের এক অঙ্গ রূপে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রতি আলোকপাত করেছিলেন – ভারতের প্রকৃত দার্শনিক সত্তার এক বিষয়গত বিশ্লেষণ, মূলত তার মধ্যে থাকা প্রাণবন্ত এবং নিষ্প্রাণ সত্তার প্রতি অবলোকন হেতু; এবং দ্বিতীয়ত, প্রাণবন্ত উপাদান সমূহের পরিচর্যা তথা নিষ্প্রাণ উপাদানগুলির অবলুপ্তি সাধন। তিনি এই বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে, এই উদ্দ্যেশ্যপূরণ মার্কসবাদের মূলসূত্রগুলির প্রতি ধাবিত হতে সাহায্য করবে। তবে, এমন ভাবনার কোন প্রয়োজন নেই যে, তিনি সনাতন ভারতীয় দর্শনে মার্ক্সবাদকে খুঁজে নিতে চেয়েছিলেন; তবে, এই অনুসন্ধিৎসার অর্থ ছিল এই যে তিনি ভারতীয় দর্শনের এক নির্দিষ্ট অভিমুখকে দেখতে চেয়েছিলেন, যার সঠিক অনুসরণ ভারতীয়দের মার্কসবাদের সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করতে পারবে। এই মনোভাব এবং প্রত্যয় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে অনুপ্রাণিত করেছিল, ভারতীয় দর্শনে নিহিত নাস্তিক তথা বৈজ্ঞানিক প্রবণতাকে অনুসন্ধানে এবং প্রচলিত মনোভাবের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে অবতীর্ণ হতে।
ভারতীয় দর্শনের প্রচলিত মনোভাব ছিল মূলত ভাববাদ এবং ঈশ্বর কেন্দ্রিক । ১৬ শতকে জনৈক বেদান্তিন মহাদেবাচার্য কর্তৃক লিখিত এক আধ্যাত্মিক প্রশস্তি সুলভ রচনা “সর্বদর্শনসংগ্রহ” এই বিষয়কেই তুলে ধরে এবং পরবর্তীতে রাধাকৃষ্ণন ও রানাডে-এর ন্যায় পণ্ডিতবর্গের দ্বারা সেই মনোভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে এই ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ভারতীয় দর্শন হল মূলত ধর্মীয় ভাব এবং বিশ্বাসের আধার মাত্র। এরই বিপ্রতীপে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর গবেষণা পূর্বোক্ত প্রচলিত মনোভাবগুলির ভ্রান্তিকে তুলে ধরে। তিনি দেখান যে, ভারতীয় ভারতীয় দর্শনে নিহিত রয়েছে বস্তুবাদী, নাস্তিকতা এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা। এই পটভূমিকায় তিনি তুলে ধরেন একটি অতি প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা – “ভারতীয় দর্শনে প্রাণবন্ত এবং নিষ্প্রাণ উপাদান কোনগুলি ?” উত্তরে বলা যায়, ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী, যুক্তিবাদী, নাস্তিক এবং বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিতটিই হল সজীব বা প্রাণবন্ত এবং ভাববাদী, ভণ্ড, কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রেক্ষিতটি হল তার নিষ্প্রাণ দিক। ভারতীয় দর্শনে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর কর্মই হল এই সজীব দিকটিকে পুনর্গঠিত করা। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারতীয় বস্তুবাদীতার আবিষ্কার তথা পুনর্গঠন হল দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর সর্বোত্তম অবদান। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত রচনা “Lokayata : A Study in Ancient Indian Materialism”, সনাতনী ভারতে নিহিত বস্তুবাদীতার আবিষ্কারের এক অনবদ্য প্রচেষ্টা রূপে গণ্য হতে পারে।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে অনুসরণ করে বলা যেতে পারে যে, যাবতীয় চিন্তা ও ভাব বা ধারণা বস্তুজাগতিক পরিবর্তন সমূহের উৎস নয়, বরং, যাবতীয় বস্তুবাদী প্রেক্ষিত দ্বারাই চিন্তা ও ধারণার উন্মেষ ঘটে থাকে। সকল প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলন সমূহের ভাববাদী ব্যাখাগুচ্ছের প্রতি জিজ্ঞাসা ব্যক্ত করে তিনি এই বিষয়টিকে পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন যে এমনই বেশ কিছু বিশ্বাস ও অনুশীলন হল সাধারণের বস্তুবাদী আকাঙ্ক্ষা সঞ্জাত। তিনি দাবী করেছেন যে, বৈদিক আচারসমূহ, যেগুলির সাথে, প্রাকৃতিক শক্তিসমুহকে নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে কার্যকর যজ্ঞের ন্যায় কিছু ঐন্দ্রজালিক ধারণা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে, সেগুলিও বস্তুবাদী ভিত্তি সম্পন্ন। তিনি যুক্তি সহকারে দেখাতে চেয়েছেন যে, এইসকল আচার-বিধি মূলত আদিম বৈজ্ঞানিক অধ্যবসায় কেন্দ্রিক ভাবেই বিকশিত হয়েছিল, কিন্তু, পরবর্তীতে শ্রেণি বিভাজনের আবির্ভাবের সূত্রে অত্যাচারীদের একাধিপত্যের দরুন কুসংস্কারে পর্যবসিত হয়। এই প্রেক্ষিতেই তাঁর আলোচনায় স্থান পেয়েছে অসুর, সাংখ্য, লোকায়ত এবং তন্ত্রের ধারণা এবং গণপতি ও গৌরির ন্যায় আরাধ্যের ধারণা, যেগুলি ছিল তাঁর মতে বস্তুবাদী আকাঙ্ক্ষা তথা দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত ধারনাগুচ্ছ। এভাবেই তিনি তাঁর Lokayata তে Lokayata নামক শব্দকে বুঝতে চেয়েছেন সাধারণের মধ্যে বিস্তৃত এক দর্শন Lokesuyatamlokayatm রূপে, যা হল মূলত এমন এক বস্তুবাদ যেটি নিছক দার্শনিক বস্তুবাদ অপেক্ষা এক প্রাগ্রসর ধারণা বিশেষ।
সনাতনী লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের পক্ষাবলম্বন:
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর চিন্তায় এক সনাতনী দার্শনিক চিন্তাগোষ্ঠী রূপে লোকায়ত ছিল সাধারণ মানুষের সকল বস্তুবাদী আকাঙ্ক্ষার এক পরিশীলিত রূপ, এবং তিনি নিজেও এটিকে সমর্থন করতেন। সে কারণেই তিনি চেয়েছিলেন, সনাতনী চার্বাক দর্শন বা লোকায়ত-এর প্রতি যে কলঙ্ক আরোপিত হয়েছিল—এই দার্শনিক ধারাটি যুক্তিগতভাবে যথেষ্ট দুর্বল এবং নৈতিকভাবে অধঃপতিত—সেটিকে অপসারণ করতে। অপরাপর ভারতীয় দার্শনিক ধারাগুলি লোকায়তকে এভাবেই আক্রমণ করতে অভ্যস্ত ছিল। এই মনোভাবই প্রকট হয় ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ নামক রচনায়। মহাদেবাচার্য এই রচনায় স্পষ্টভাবে চার্বাকদর্শন সম্প্রদায়কে নাস্তিক, নিরীশ্বরবাদী বলে আক্রমণ করেন। মহাদেবাচার্য-এর মতানুসারে, চার্বাকরা কেবলমাত্র উপলব্ধিকে প্রমাণ রূপে স্বীকার করে এবং যুক্তির অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে থাকে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এই ধরনের নিন্দাকে স্বীকার করেন নি। তাঁর মতানুসারে, চার্বাকরা নিশ্চিতভাবেই এক বিশেষ ধরনের অনুমানকে প্রমাণ রূপে গণ্য করেছেন। তিনি তাঁর মতামতের সপক্ষে পুরন্দরের ব্যাখ্যাকে তুলে ধরেছেন, “Even according to the Carvakas inference was valid within the range of empirically known world; if, however, one proposed to extend its application beyond the range of this – worldly objects, one’s claim would be forbidden one.”
যদিও লোকায়তরা এক বিশেষ ধরনের অনুমানকে প্রমাণ রূপে মান্যতা দেয়, তাঁরা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধিকে প্রাথমিক রূপে গণ্য করে অনুমানকে গৌণ রূপে গ্রহণ করে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর মতে, চার্বাকরা এটি করে থাকেন মূলত ধর্মীয় প্রবঞ্চকদের দ্বারা ধর্মীয় নিপীড়নকে নিবর্তন করার নিমিত্তে; কারণ সেই প্রবঞ্চকগণ অনুমানকে প্রবঞ্চনার মাধ্যম রূপে অহরহ ব্যবহার করতে সিদ্ধহস্ত। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এই কারণেই লোকায়ত বর্গকে ভারতের সর্বপ্রথম যুক্তিবাদী রূপে প্রশংসিত করেছেন। তাঁরা অনুমানকে ব্যবহার করতেন ধর্মীয় প্রবঞ্চনার হাত থেকে সাধারণের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখার নিমিত্তে। যেখানে তথাকথিত ধার্মিকরা এর বিপরীত কাজটাই অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করতেন।
মহাদেবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’তে চার্বাকদের ইন্দ্রিয়সুখবাদী রূপে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, এই ধারার মূল বক্তব্যই হল, মানুষের মুখ্য উদ্দেশ্য হল ইন্দ্রিয়সুখানুভুতিলাভ করা। তিনি এই প্রেক্ষিতে চার্বাকদের একটি বিশেষ মতকে তুলে ধরেছেন, “while life remains, let a man live happily, let him feed on ghee even though he runs in debt” (ঋনং কৃত্যা ঘৃতং পীবেৎ, যাবৎ জীবেত সুখং জীবেৎ)।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় যুক্তি সহকারে দেখিয়েছেন যে, লোকায়তদের ন্যায় ভাবের প্রতি এটি নিছকই এক অপব্যাখ্যা। তাঁর মতে, ভোগ সুখের এই তত্ত্ব চার্বাক বিরোধীদের অপকর্ম বিশেষ। তাহলে চার্বাকদের কি আদৌ কোন নৈতিক মূল্যবোধ ছিল? এর উত্তরে তিনি মহাভারতের শান্তি পর্বের প্রতি আলোকপাত করে তথাকথিত রাক্ষস চার্বাক-এর কাহিনী তুলে ধরেছেন। চার্বাক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুধিষ্ঠির কর্তৃক নিজ আত্মীয়দের হত্যার জন্য যুধিষ্ঠিরকে সমালোচনা করেছিল। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর মতে, চার্বাকের সেই সমালোচনার বানী, প্রজাতিসত্তার সংরক্ষণের মূল্যের দ্যোতক; যদিও তা কোনোভাবেই অহিংসার যথাযথ ধারণার সমার্থক নয়। এভাবেই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় নিজের মত ব্যক্ত করেছেন এই মর্মে যে, চার্বাকগণ উপলব্ধিকে জ্ঞানের মাধ্যম রূপে গণ্য করেছেন এবং চার্বাক দর্শনকে যেভাবে ভোগ-সুখ-ইন্দ্রিয়বাদী রূপে চার্বাক বিরোধীরা চিহ্নিত করেছেন, তা চার্বাক দর্শনের বিকৃতি সাধনের অপচেষ্টা ব্যতীত আর কিছুই নয়।
চার্বাক দর্শন উত্তর পর্বে ভারতীয় বস্তুবাদের বিস্তৃতি:
ভারতীয় ঐতিহ্য সর্বদাই চার্বাক বা লোকায়তকে দমন করতে সচেষ্ট হয়নি। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, কৌটিল্যর মধ্যে লোকায়ত দর্শনের দৃঢ় সমর্থনকে খুঁজে পেয়েছেন। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রের বিদ্যাসমুদ্দেশ্য নামক অধ্যায়ে আন্বিক্ষিকি নামক যুক্তিবাদী দর্শনের অবতারণা করেছেন। আন্বিক্ষিকি হল কৌটিল্যের মতে এক বিশেষ দার্শনিক অনুসন্ধিৎসা যার দ্বারা যুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বিবিধ বিজ্ঞানের শক্তি ও দুর্বলতাকে সন্ধান করা হয়ে থাকে। সেদিক হতে বিচারে, কৌটিল্যের মতে লোকায়ত হল এক অনুসন্ধিৎসা যা জ্ঞানের মাধ্যম রূপে যুক্তিবাদীতাকে গ্রহণ করে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এর মতানুসারে , সাংখ্য, যোগ এবং লোকায়ত –এই ত্রিদর্শন তাদের যুক্তিশীলতা এবং বস্তুবাদীত্যের বিচারে সমধর্মী। তাঁর মতে সনাতনী সাংখ্য বা অকৃত্রিম সাংখ্য অবশ্যই বস্তুবাদী। তিনি আরও দাবী করছেন যে, “পুরুষ”, যা সনাতনী সাংখ্যের বিচারে সচেতনতাকে নির্দেশ করে থাকে, তা আদি সাংখ্যের বিচারে কখনই এক স্বতন্ত্র সত্তা রূপে গণ্য হয়নি। চরকসংহিতাতে যে আদি সাংখ্যের পরিচিতি লাভ করা যায়, সেখানে এই একই বিষয় উঠে আসে। সেখানে “প্রকৃতি” হল মৌল ভিত্তি এবং তার অব্যক্ত প্রেক্ষিত হল “পুরুষ”। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এক্ষেত্রে তুলে ধরেছেন এস এন দাশগুপ্তের চিন্তাকে, যিনি এই ধারণা পোষণ করতেন যে, মহাভারতে স্থান লাভকারী চরিত্র পঞ্চসিকা, যিনি আদতে ছিলেন কপিল মুনির অনুগত এবং সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা, তিনিও এই একই ধারণা পোষণ করেছিলেন। ধ্রুপদী সাংখ্য পুরুষকে স্বতন্ত্র সত্তা রূপে গ্রহণ করে তাকে বিশুদ্ধ সচেতনতার সমার্থক রূপে চিহ্নিত করেছিল, যা দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর মতে, বৈদিক ভাববাদের প্রভাব মাত্র।
সাধারণত, যোগ নামক ধারনাটি এক বিশেষ ধারার অভ্যাসকে নির্দেশ করে, যার জনক হলেন পতঞ্জলি। তবে, কৌটিল্য যেভাবে ও যে অর্থে আন্বিক্ষিকিকে চিহ্নিত করেছেন, তার সাথে যোগ-এর এই ধারণার কোন সাদৃশ্য নেই বলা যায়। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এক্ষেত্রে, ফণীভূষণ তর্কবাগীশ এবং কুপ্পুস্বামী শাস্ত্রী-এর ন্যায় পণ্ডিতবর্গকে অনুসরণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছেন যে, কৌটিল্য যে যোগ এর কথা বলেছেন, তা হল মূলত ন্যায় – বৈশেষিক মতের প্রতিফলন, তার সাথে ধ্যান যোগের কোন সম্পর্ক নেই। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর মতে, ন্যায় এবং বৈশেষিক মতের প্রবক্তাগণ যুক্তি ও পারমানবিক বস্তুবিদ্যার বৈজ্ঞানিক দর্শনের বিকাশ সাধনে আগ্রহী ছিলেন; এবং বৈদিক কর্তৃত্বের অনুসরণের প্রতি তাঁদের কোন আকর্ষণ ছিলনা। কিন্তু, বৈদিক কর্তৃত্ব কর্তৃক আরোপিত দার্শনিক নিষেধকে একপ্রকার উপেক্ষা করতেই তাঁরা তাঁদের দর্শনে বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের এক অদ্ভুত সমন্বয় সাধন করেছিলেন এবং এর ফলে তাঁদের দর্শনচিন্তা এক ব্যতিক্রমী বাহ্যিক রূপ লাভ করেছিল। পরবর্তী স্তরে তাঁরা ঈশ্বর-এর অস্তিত্বের সপক্ষেও যুক্তি বিন্যাস করেছিলেন; যদিও প্রাথমিক পর্বে তাঁরা কেউই আস্তিক ছিলেন না। তাঁরা প্রাথমিক পর্বে বস্তুবাদী হওয়ার কারণে কোনোভাবেই সচেতনতার স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে স্বীকার করতেন না, যদিও আত্মা র স্বাতন্ত্র্য কে তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে চেতনা বা সচেতনতা ছিল আত্মার এক আকস্মিক গুন বিশেষ। তাঁদের মতে চেতনা আবির্ভূত হয় অচেতন বস্তুবর্গের সম্পর্ক শৃঙ্খলার মাধ্যমে, নিম্নলিখিত প্রক্রিয়ায় –
“আত্মা + শরীর + আভ্যন্তরীণ বোধ + বাহ্যিক বোধ + বাহ্যিক বস্তু = চেতনা / চৈতন্য ”
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর মতানুসারে, ন্যায়-বৈশেষিকদের দ্বারা নির্ধারিত উপরোক্ত সমীকরণ লোকায়ত দর্শনের ব্যাখ্যার অনুরূপ, যেখানে এই ধারণা করা হয়ে থাকে যে, বিবিধ বস্তুর পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমেই চেতনার উৎপত্তি ঘটে থাকে।
বস্তুবাদ বনাম ভাববাদ – ভারতীয় দর্শনের মুখ্য বিতর্ক:
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর What is Living and What is Dead in Indian Philosophy (1976) নামক গ্রন্থে ভারতীয় দর্শনে নিহিত মুখ্য বিতর্ক-এর প্রতি প্রশ্ন আরোপ করেছেন। তাঁর মতানুসারে, এই বিতর্ক মূলত বস্তুজগতের অস্তিত্ব কেন্দ্রিক। তিনি দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষিত হতে এই বিতর্ককে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাঁর মতে, বেশ কিছু ভাববাদী চিন্তা কাঠামো রয়েছে, যেগুলি, কোন বস্তুর বাস্তব অস্তিত্বকে অস্বীকার করে থাকে; এবং তার সাথেই রয়েছে ভাববাদের প্রতিবাদ, যা আবার বস্তুবাদী চিন্তা কাঠামো সঞ্জাত। তিনি ভাববাদ অর্থে সেই চিন্তা গোষ্ঠীকে নির্দেশ করেছেন, যা চেতনার অবিসংবাদিতাকে স্বীকার করে নেয়, এবং বস্তুজগতের অস্তিত্বকে মান্যতা দেয় না। তিনি প্রধানত তিনটি চিন্তা গোষ্ঠীকে ভাববাদী রূপে চিহ্নিত করেছেন – অদ্বৈত-বেদান্ত, যোগাচার বৌদ্ধমত এবং মাধ্যমিক বৌদ্ধমত। এর পাশাপাশি তিনি ভাববাদের প্রতিবাদী ধারা রূপে চিহ্নিত করেছেন, ন্যায়–বৈশেষিক, সাংখ্য, পূর্ব মীমাংসা এবং লোকায়ত দার্শনিক ঘরানাকে। এই তিন ঘরানার মধ্যে তিনি একমাত্র লোকায়ত ধারাকেই সর্বাপেক্ষা উন্নত প্রতিবাদী ঘরানা রূপে গণ্য করেছেন এবং তিনি আদি সাংখ্য ও ন্যায়–বৈশেষিক ধারাকেও বস্তুবাদী প্রকৃতি সম্পন্ন হওয়ার কারণে প্রতিবাদী ঘরানার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পূর্ব মীমাংসা ধারা বেদকে অ–পৌরুষেয় রূপে স্বীকার করলেও, তার মধ্যে যে নাস্তিকতা ও ভাববাদ বিরোধিতার প্রবণতা রয়েছে, তাকে প্রত্যক্ষ করে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এই পূর্ব মীমাংসা ধারার প্রশংসা করেছেন ।
ভারতীয় দার্শনিক ঘরানার ক্রমোচ্চস্তরবিন্যস্ততার অবসান:
মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ নামক গ্রন্থে ভারতীয় দর্শন ধারা গুলিকে ক্রমোচ্চ ভাবে বিন্যস্ত করেছিলেন, যেখানে তিনি লোকায়ত ধারা দিয়ে শুরু করে অদ্বৈত-বেদান্ত ধারা দ্বারা উপসংহার টেনেছিলেন। তিনি এই বিভাজনের ক্ষেত্রে পূর্বপক্ষ–উত্তরপক্ষ প্রণালী অনুসরণ করেছিলেন। তাঁর সেই বিন্যাসে চার্বাক ধারার স্থান হয়েছিল সর্বনিম্নে এবং অদ্বৈত-বেদান্ত ধারাকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা হয়েছিল। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-এর দৃষ্টিতে এহেন বিন্যাস সত্যের বিকৃতি রূপেই প্রতিভাত হয়। তাঁর মতে, চার্বাক দর্শন যেহেতু বৈজ্ঞানিক এবং একই সাথে সত্যবাদী, তাই তাঁর স্থান হওয়া উচিত সবার উপরে এবং ভাববাদী ধারা প্রকৃতই অবৈজ্ঞানিক হওয়ার কারণে তার স্থান হওয়া উচিত সর্বনিম্ন স্তরে। তাই তিনি এই বিন্যাসের বিপরীতে স্বরচিত ‘Popular Introduction to Indian Philosophy’ (1964) গ্রন্থে সম্পূর্ণ বিপরীত বিন্যাস রচনা করেন, যেখানে চার্বাক বা লোকায়ত ধারা ও অদ্বৈত-বেদান্ত ধারাকে যথাক্রমে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তরে রাখা হয়। এক্ষেত্রে ওয়াল্টার রুবেন-এর অভিমত প্রণিধানযোগ্য – “If Mahadeva began his Sarva-Darsanasangraha with the Lokayata as the lowest school and ended with the Advaita–Vedanta as the highest school of Indian Philosophy, Debiprasad, as a materialist, follow the opposite line …”
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এইভাবেই ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে বস্তুবাদের যথাযথ সম্মানজনক স্থানকে নির্দিষ্ট করেছিলেন। ঠিক এমনভাবেই তিনি তাঁর ‘Indian Atheism : A Marxist Analysis’ (1969) শীর্ষক গ্রন্থে নাস্তিকতার স্থান ও ভূমিকাকে নির্দিষ্ট করার সাথে সাথে ‘Science and Society in Ancient India’ (1977) এবং ‘History of Science and Technology in Ancient India’ (vol I, II – 1991 , 1996) গ্রন্থদ্বয়ে যথাক্রমে আয়ুর্বেদ ও মহাকাশ বিদ্যার ঐতিহ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই ভাবেই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় দার্শনিক ধারায় সজীব উপাদান রূপে বস্তুবাদী, নাস্তিক, বৈজ্ঞানিক ঘরানার অনুসন্ধানের কাজটি সুসম্পন্ন করেছিলেন।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে প্রকৃতই একজন মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক বলা যায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকে গেলেও, এ’কথা বলা যেতে পারে, ভারতীয় দর্শনের একজন আধুনিক পণ্ডিত রূপে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন; যিনি পরবর্তীতে, ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে বস্তুবাদীতাকে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর কৃত, ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা ধর্মনিরপেক্ষ ও সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল। তাঁর চিন্তা প্রাগ্রসর চিন্তাবিদ মহলেও সমালোচনার শিকার হয়নি। ভাববাদ বনাম বস্তুবাদের দ্বন্দ্বের প্রতি তাঁর তীব্র অনুসন্ধিৎসা তাকে প্রশংসা এনে দিলেও, ব্রাহ্মণ – অব্রাহ্মণ বিরোধের প্রতি তাঁর অনাগ্রহের দরুন তাঁকে সমালোচিত হতে হয়েছে। চার্বাক দর্শনের অবদানের প্রতি তাঁর যত্নশীলতা ছিল প্রশংসনীয় কিন্ত তিনি যেভাবে এই দর্শন ধারাটিকে কেবলমাত্র বস্তুবাদীতার মধ্যেই সীমিত রেখেছিলেন, তা অবশ্যই সমালোচনার লক্ষ্য হতে পারে; যদিও এই সামান্যতম সমালোচনা তাঁর মূল দার্শনিক অবদানকে কখনওই খর্ব করতে পারবে না।
ভারতীয় দর্শনের যুক্তিপূর্ণ অধ্যয়ন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এর অবদান অপেক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, এই কথা অনস্বীকার্য ।।
নির্বাচিত গ্রন্থমালা:
Sharad Patil, the author of Dasa-Shudra Slavery (Allied Publishers 1962).
Eli Franco (in Perception, Knowledge and Disbelief (A Study of Jayarāśi’s Scepticism), Delhi, Motilal Banarsidass, 1987)
Pradeep Gokhale (in Lokāyata/Cārvāka: A Philosophical inquiry, OUP, 2015)
Lokayata: A Study in Ancient Indian Materialism New Delhi: People’s Publishing House (First published in 1959; Fourth edition, 1978).
Indian Philosophy: A Popular Introduction, New Delhi: People’s Publishing House, (First edition, 1964)
Indian Atheism: A Marxist Analysis Calcutta: Manisha (First edition, 1969)
What is Living and What is Dead in Indian Philosophy (1976) New Delhi: People’s Publishing House. (First Published in 1976, Third Edition, 1993)
Science and Society in Ancient India, Calcutta: Research India Publications. (First published in 1977; Reprint 2014, K.P. Bagchi and Company, 978-81-7074-335-4)
___________________________________
[লেখক – অবর অধ্যাপক, দর্শন এবং পালি বিভাগ, সাবিত্রীবাই ফুলে পুনে ইউনিভার্সিটি]
ভাষান্তর : জয়ন্ত ঘোষাল
Posted in: January 2019, Prose