এশিয় উৎপাদন পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা – নিত্যানন্দ ঘোষ

‘এশিয় উৎপাদনের পদ্ধতি’ (এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন) নিয়ে কার্ল হেইনরিখ মার্ক্সের ভাবনা কম চর্চিত এবং মার্ক্স-পণ্ডিততদের কাছে এটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। বিংশ শতাব্দী তো বটেই এমনকি একবিংশ শতাব্দীর সমাজ তাত্ত্বিকদের কাছেও বিষয়টি সঠিকভাবে অনুধাবিত নয়। মার্ক্সের দ্বিশতবর্ষ জন্মলগ্নেও বিষয়টি কম চর্চিত। ব্রেন্তন ও’লিয়েরি-র মত মার্ক্স চর্চাকারের কাছেও ‘এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন’ ‘সবচেয়ে বিতর্কিত উৎপাদন পন্থা’ যে কোন মতাদর্শের ভারতীয় বামপন্থীরা (প্রধান ধারার কমিউনিস্ট পার্টিগুলি, বিশেষত বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলি, ত্রতস্কিপন্থীরা অথবা মাওবাদীরা) এই প্রশ্নে নতুন কোন ভাবনা বা চর্চা শুরু করতে পারেননি। মার্ক্স ‘এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন’ নিয়ে যা বলেছিলেন, বাম দলগুলি সেই ধারণা গ্রহণ করেনি। জোসেফ স্তালিন এ প্রশ্নে বিতর্ক বন্ধ করে দিয়েছিলেন ১৯৩০-এ।  বিশেষজ্ঞদের অভিমত ভারতীয় বামপন্থীরা সোভিয়েত আমলাদের রঙিন চশমায় অ-সমালোচনামুলক দৃষ্টিতে মার্ক্স সন্দর্ভ চর্চা  করার জন্য তাদের মার্ক্স চর্চা আমলাতান্ত্রিক পথেই পরিচালিত হয়েছে। রমিলা থাপারের মত ঐতিহাসিকও মনে করেছিলেন ‘এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন’ সংক্রান্ত মার্ক্স-ভাবনা ঠিক ছিল না। ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের মতে এটি ছিল ইউরোপ কেন্দ্রিক (ইউরো-সেন্ট্রিক) যা মার্ক্স যেভাবেই হোক হেগেলের থেকে গ্রহণ করেছিলেন। স্তালিন আমলের রুশ অর্থনীতিবিদ ওয়াই ভার্গা মার্ক্স-এর ‘এশিয় উৎপাদনের পদ্ধতি’ নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করেছেন।     

শোভনলাল দত্তগুপ্ত’র মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত হল মার্ক্সের ‘এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন’ সংক্রান্ত ভাবনা নিয়ে জটিলতা আছে। এ নিয়ে ভারতীয় মার্ক্স-চর্চাকাররা স্পষ্ট কোন ধারণা রাখতে পারেননি। রাখলেও তাঁরা এটিকে ইউরোসেন্ট্রিক বলেই দায় সেরেছেন।  তাঁর মতে মার্ক্সের এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন সংক্রান্ত প্রথম দিককার চিন্তা পরে সংশোধিত হয়েছে। মুরজবান জাল ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি সাপ্তাহিকে (১০ মে ২০১৪) এক বিশেষ লেখাতে বলেছেন – এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন সংক্রান্ত ভারতীয় প্রকরণ ও জাতের মধ্যে সম্পর্ক যুক্ত করতে গেলে মার্ক্সের জাত সংক্রান্ত বিবৃতি “প্রাচ্যের বিপর্যয়ের জমাটবদ্ধ স্থিতি”-র উপর জোর দিতে হবে। যাঁরা ভেবেছিলেন যে মার্ক্স তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভাষ্য থেকে জাত সরিয়ে রেখেছিলেন, এ প্রশ্নে উল্লেখ প্রয়োজন যে তাঁর জন্য (মার্ক্সের ভাবনা জোর আমাদের), জাত কেবলমাত্র এশিয় বিপর্যয়ের ‘জমাটবদ্ধ স্থিতি’ নয়, এই বিপর্যয়, এমনকি, উল্লেখ করছে বন্য দিকভ্রান্ত, অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয়ের স্থিতি যা দাঁড়িয়ে আছে এক ধরণের ভারসাম্যে, এক সাধারণ বিকর্ষণ ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার উপর। মার্ক্সের ১৮৫৩ সালের ‘এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন’-এর ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’র পর্যবেক্ষণ ভাবা যেতে পারে। অধ্যাপক জাল ‘এশিয় উৎপাদন পদ্ধতি’র সমর্থক (মূল জার্মন টেক্সটও ঘেঁটেছেন)।      

“এই শান্ত ছবির মত প্রজাতন্ত্রগুলি (রিপাবলিকস), তাদের গ্রামগুলির সীমানা ঈর্ষাপরায়নতায় প্রতিবেশী গ্রামগুলির সীমানায় সীমায়িত ও সংরক্ষিত, তা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অংশের চমৎকার রূপের সুসংরক্ষিত গ্রামগুলির মতই বিরাজ করছে, যেগুলি বর্তমানে ইংরেজরা দখল করেছে। আমি মনে করি না যে একজন এশিয় বিপর্যয় ও স্থিতাবস্থাকে আরও জমাটবদ্ধ দেখতে পারে।”   

মার্ক্সের এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন বুঝতে গেলে ভারতবর্ষে জাত-এর  বিষয়টি অবশ্য প্রণিধানযোগ্য।  উত্তর-কাঠামোগত শিল্পসুলভ সমালোচনা সত্ত্বেও, যা আমরা ‘প্রয়োজনবাদ’ (এসেনশিয়ালিজম) বলে জানি, একজন হেগেল-এর ‘সায়েন্স অর লজিক’ থেকে দুটো বিভাগ (ক্যাটেগরি) নিতে পারে – উৎস (এসেন্স) ও ধারণা (কনসেপ্ট) ভারতীয় সমাজের গঠনসমূহ বুঝতে। বিশেষ প্রশ্নটি–“ভারতীয় সমাজের প্রসঙ্গ ও প্রবল সামাজিক শ্রেণি ও জাতের মতাদর্শ কৌলীন্যবাদী ভারতীয়রা জনতাকে শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বেঁধে রাখে, যা ভারতীয় বিপ্লবকে প্রতিহত করে?”—চিন্তকরা মনে হয় এড়িয়ে চলে। এটি করেন, কারণ, তাঁরা ‘এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন’-এর বৃহত্তর শিল্পরূপ থেকে জাতকে বিচ্ছিন্ন করেন। এর এক সহজ উত্তর – জাত কেবল মাত্র মার্ক্সবাদের একমাত্র ভিত্তি নয়। এটি হেগেলের উৎস ও ধারনাতে ভারতবর্ষের সামাজিক গঠনকে সুত্রায়িত করে। মুরজবান লিখছেন – এতদসত্ত্বেও  একজন যদি মার্ক্স এর চোখে জগত দেখেন তাহলে তিনি দেখবেন ভারতীয় সভ্যতার এটি এক মনোরোগ যার দ্বারা “যখন চকিতে ধ্বংস হয় (জাত) এবং পুনরায় গজিয়ে ওঠে একই জায়গায়।” (মার্ক্স) যে কেউ জানেন যে এই ধরণের চরিত্রায়ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এডওয়ার্ড সাঈদ, আশিস নন্দী থেকে ইরফান হাবিবের মত চিন্তকরা ভেবেছেন মার্ক্স-এর ‘এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন’ ইউরোপীয় পর্যটকের দৃষ্টিতে ভারতীয় সমাজকে দেখা। তা এমনই এক সমাজ যার কোন ইতিহাস নেই। তা সত্ত্বেও আমাদের ভিন্ন ও স্পষ্ট উচ্চারণে ইতিহাস (ইতিহাসগুলি) পর্যালোচনা প্রয়োজন। যেখানে ইউরোপীয় জ্ঞানদীপ্তিতে সরলরৈখিক পথে ইতিহাস পরিচালিত হয়েছে যা আমরা জেনে এসেছি, তা বহুমুখী ও অতিনির্ভরতায় ইতিহাসের বহু রূপে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।  এই পদ্ধতিতে, ইতিহাস কেবলমাত্র এগিয়ে যাওয়ার পথেই নয়, একইসঙ্গে প্রতিবিপ্লবী পথেও ধরা পড়েছে, যাকে মনোরোগের ইতিহাস বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।          

মুরজবানের বক্তব্যে স্পষ্ট যে মার্ক্স-এর ‘এশিয়াটিক মোড অব প্রোডাকশন’ নিয়ে ভারতীয় সমাজতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ তো বটেই অন্যান্য মার্ক্স পণ্ডিতরা এটি ঠিকঠাক বুঝতে পারেন নি বললে ভুল হবে আসলে তাঁরা বুঝতেই পারেননি। ভারতে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে মার্ক্স-এর ভাবনার কিছু বক্তব্য তুলে ধরা যাক।  ১৮৫৩ সালে ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে শিরোনামে কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর একটি সঙ্কলন থেকে জানা যাচ্ছে –

“যেমন মিশরে ও ভারতে, তেমনি মেসোপটেমিয়া, পারস্য প্রভৃতি দেশেও বন্যার জল দিয়ে জমিকে উর্বর করা হয়; জলস্ফীতির সুযোগ নিয়ে সেচের খালগুলিতে জলের যোগান দেওয়া হয়, বিনা অপচয়ে ও সমবেতভাবে জল ব্যবহারের এই মৌলিক প্রয়োজন, যথা ফ্ল্যানডারসে (উত্তর সাগর তীরবর্তী পশ্চিম বেলজিয়ামে ও উত্তর ফ্রান্সে) ও ইতালিতে, ব্যক্তিগত উদ্যোগ সমুহকে স্বেচ্ছামুলক সম্মেলনের পথে পরিচালিত করেছিল, তারই জন্য প্রাচ্যে, যেখানে সভ্যতা ছিল খুবই নিচের স্তরে আর রাষ্ট্রের এলাকা অতি বিস্তীর্ণ, আর তাই স্বেচ্ছামূলক সমিতি জন্মলাভ করতে পারেনি, সেখানে সরকারের কেন্দ্রিভবনকারী হস্তক্ষেপ জরুরী হয়ে পড়ে। আর তাই সকল এশিয় সরকারের ওপরে একটি অর্থনৈতিক দায়িত্ব, পূর্ত দপ্তরের কাজ, এসে বর্তায়।   

ভারতের অতীতের রাজনৈতিক দিকটা যতই পরিবর্তনশীল বলে মনে হোক না কেন, সুদুর পুরাকাল থেকে উনিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত তার সামাজিক অবস্থা অপরিবর্তিত থেকেছে। একদিকে সকল প্রচ্যবাসীর মতো, হিন্দু তার কৃষি ও বাণিজ্যের প্রধান শর্তস্বরূপ বড় বড় পূর্তকর্মের ভার কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর অর্পণ করেছে, এবং অন্যদিকে সারা দেশে ছড়িয়ে থেকেছে, আর কৃষি ও শিল্পোদ্যোগের ঘরোয়া বন্ধনে ছোট ছোট কেন্দ্রে জোট বেঁধেছে – এই দুই পরিস্থিতি, প্রাচীনতম কাল হতে সৃষ্টি করেছে এক বিশেষ চরিত্রের সমাজ ব্যবস্থা – তথাকথিত গ্রাম-ব্যবস্থা, যা এই সব ছোট ছোট সম্মিলনের প্রতিটিকে প্রদান করেছে তাদের স্বাধীন সংগঠন ও বিশিষ্ট জীবন ধারা। ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশ ‘হাউস অব কমন্স’-এর একটি পুরনো সরকারী দলিলে প্রাপ্ত নিম্নোক্ত বিবরণ থেকে এই ব্যবস্থার অদ্ভুত চরিত্রটি বোঝা যাবে। (এই বিবরণ ১৮১২ সালে প্রকাশিত হয়, মার্ক্স তা জি ক্যাম্পবেল রচিত ‘মডার্ন ইন্ডিয়া : এ স্কেচ অব দি সিস্টেম অব সিভিল গভর্নমেন্ট’, লন্ডন ১৮৫২, পৃষ্ঠা ৮৪-৮৫ থেকে উদ্ধৃত করেন): ভৌগলিকভাবে দেখলে একই গ্রাম হল কয়েক শত বা কয়েক হাজার একর আবাদি ও পতিত জমির এক বিশিষ্ট অঞ্চল; রাজনৈতিকভাবে দেখলে তা একটি কর্পোরেশনের বা টাউনশিপের মত। তার আমলাদের ও সেবকদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিবরণ নিম্নরুপ (এই বিবরণে ব্যবহৃত পদগুলি পশ্চিম দাক্ষিনাত্যে প্রচলিত):    

পটেইল বা (গ্রামের) অধিবাসীদের প্রধান (মোড়ল), সে সাধারণভাবে গ্রামের অবস্থা-ব্যবস্থা তদারক করে, অধিবাসীদের মধ্যেকার বিবাদের নিষ্পত্তি করে, পুলিশ এলে হাজির থাকে ও তাদের দেখাশোনা করে এবং গ্রামের থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে – (গ্রামবাসীদের ওপর) তার ব্যক্তিগত প্রভাবের এবং জনজীবনের অবস্থার এবং উদ্বেগগুলির খুঁটিনাটির সাথে তার পরিচিতির সুবাদে, এ দায়িত্ব পালনের জন্য সেই যোগ্যতম ব্যক্তি। কর্ণম – চাষের হিসাব রাখে এবং তার সাথে সম্পর্কিত সব কিছু নথি বদ্ধ করে। তল্লিয়ের এবং জেটি, প্রথম জনের কাজ […] অপরাধীর সংবাদ সংগ্রহ এবং যারা গ্রাম হতে অন্য গ্রামে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে যাওয়া ও তাঁদের রক্ষা করা;  অন্য জনের এক্তিয়ার গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়, অন্যান্য কাজের মধ্যে যে ফসল পাহারা দেয় ও তার পরিমাপে সাহায্য করে। সীমানাদার – গ্রামের সীমানা রক্ষা করে এবং বিবাদ উপস্থিত হলে সীমানা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়, জলাশয়ের ও জলের নালার তত্ত্বাবধায়ক […] কৃষির জন্য জলের বিলিব্যবস্থা করে। ব্রাহ্মণ গ্রামের পূজা অর্চনা করে। গুরুমশাই – দেখা যায় যে সে গ্রামের ছেলেপুলেদের বালির ওপর লিখতে পড়তে শেখাচ্ছে, পঞ্জিকা-ব্রাহ্মণ বা জ্যোতিষী ইত্যাদি।  সাধারণত এই অব আমলা ও সেবকদের নিয়েই একটি গ্রামের প্রভাবশালী ও পরিবর্তন বিরোধী গোষ্ঠীটি গড়ে ওঠে; কিন্তু দেশের কোন কোন অঞ্চলে এই ব্যবস্থা এতো বিস্তারিত নয়, একই ব্যক্তি উপরোক্ত দায়-দায়িত্বের কয়েকটি পালন করে, আবার অন্য অঞ্চলে উপরোক্ত ব্যক্তিগুলির সংখ্যা কিছু বেশি। […] এ দেশের অধিবাসিরা স্মরণাতীত কাল থেকে পুরশাসনের এই সরল রূপের আওতায় বাস করে আসছে। গ্রামগুলির সীমানা পাল্টেছে […] কচিত; আর যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা রগ-ব্যাধিতে গ্রামগুলি কখনও কখনও ক্ষতিগ্রস্ত, এবং এমনকি উজাড় হয়ে পড়লেও, যুগের পর যুগ ধরে সেই একই নাম, একই সীমানা, একই স্বার্থ, এবং এমনকি একই বংশধারা বিদ্যমান থেকেছে। রাজ্যের ভাঙাভাঙি ও বিভাজন নিয়ে গ্রামবাসীরা  মাথা ঘামায়নি; গ্রামটি অখণ্ড থাকলেই হল, তা কোন শক্তির হাতে গেল, বা কোন সার্বভৌম নৃপতির ভাগে পড়ল – তা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত হয় না; গ্রামের ভেতরের অর্থনীতি অপরিবর্তিতই  থাকে। সেও একই পটেইল প্রধান অধিবাসী বিবেচিত হয়, এবং তখনও সে পাতি জজের বা ম্যাজিস্ট্রেটের, এবং গ্রামের কর আদায়ের বা খাজনা বিলির কাজ করে যায়।” 

সমাজদেহের এই ছোট ছোট বাঁধি-গতের রুপগুলি (আজ) বহুলাংশে ভেঙে পড়েছে ও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, তবে তা ব্রিটিশ কর সংগ্রহাকের ও ব্রিটিশ সৈন্যের বর্বর হস্তক্ষেপের ফলে ততটা নয় যতটা ইংরেজের অবাধ বাণিজ্যের ক্রিয়ায়। ওইসব পারিবারিক-গোষ্ঠীগুলির ভিত্তি ছিল গার্হস্থ শিল্পোদ্যোগ – হাতে সুতো কাটা, হাতে কাপড় বোনা আর লাঙল দিয়ে চাষের এক অদ্ভুত সমন্বয়ে তারা আত্মনির্ভরতার শক্তি অর্জন করেছিল। ইংরেজের হস্তক্ষেপ সুতাকাটুনির স্থান নির্দেশ করেছে ল্যাঙ্কাশায়ারে, আর তাঁতির জায়গা ঠিক করেছে বাংলায়, অথবা হিন্দু সুতাকাটুনি ও তাঁতি উভয়কেই নিশ্চিহ্ন করে, এইসব ছোট ছোট অর্ধ-বর্বর, অর্ধ-সভ্য জনগোষ্ঠীগুলির অর্থনৈতিক ভিত্তিকে উড়িয়ে দিয়ে তাঁদের বিধ্বংস করেছে এবং এইভাবে এশিয়ার এযাবৎ যা শোনা গেছে তার মধ্যে সর্ববৃহৎ, সত্যি কথা বলতে কি, একমাত্র সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করেছে।    

এখন ওইসব লক্ষ লক্ষ শ্রমপরায়ণ, পিতৃতান্ত্রিক ও নিরীহ সামাজিক সংগঠন অসংগঠিত হয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, ডুবছে দুর্দশার এক সমুদ্রে, সে সংগঠনের সদস্যরা হারাচ্ছে যুগপৎ তাঁদের প্রাচীন সভ্যতা ও প্রাণধারণের বংশানুক্রমিক সংস্থান – দেখতে এটা মানবিক অনুভুতির কাছে যতই পীড়াদায়ক হোক, একথা যেন না ভুলি যে এই সব শান্ত, সরল মনোরম গ্রাম-গোষ্ঠীগুলিকে যতই নিরীহ বলে মনে হোক না কেন, তারাই প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রের দৃঢ় ভিত্তি হয়ে এসেছে চিরকাল, তারাই মানুষের মনকে যতদূর সম্ভব ক্ষুদ্রতম পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে, তাকে বানিয়েছে কুসংস্কারের অপ্রতিরোধী ক্রীড়নক, করেছে চিরাচরিত নিয়মের দাস, হরণ করেছে তার সকল মহিমা ও ঐতিহাসিক কর্মোদ্যম। যে বর্বর আত্মপরতা কোন একটা ক্ষুদ্র ভুমিখণ্ড আঁকড়ে ধরে শান্তভাবে  প্রত্যক্ষ করে গেছে সাম্রাজ্যের পতন, অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতার অনুষ্ঠান, বড় বড় শহরের অধিবাসীদের হত্যাকাণ্ড, এই সব ঘটনাকে প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর ভাবেনি, এবং কোন আক্রমণকারীর কৃপাদৃষ্টি পড়লে যে নিজেও হয়ে উঠেছে তার অসহায় শিকার – সে আত্মপরতার কথা যেন না ভুলি, যেন না ভুলি যে এই মর্যাদাহীন, নিশ্চল, উদ্ভিদসুলভ জীবন, এই উদাসীন অস্তিত্ব হতে অন্যদিকে, তার পাল্টা হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে বন্য, লক্ষ্যহীন, সীমাহীন ধ্বংসশক্তি এবং তা হত্যা ব্যাপারটিকেই হিন্দুস্থানে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করেছে, যেন না ভুলি যে এই সব ছোট ছোট জনসমাজ জাতিভেদ-প্রথা ও দাসত্ব দ্বারা কলুষিত ছিল, অবস্থার প্রভু মানুষকে উন্নত না করে তাকে তারা বাইরের অবস্থার অধীন করেছে, স্বয়ং বিকশিত একটি সামাজিক অবস্থাকে তারা সদা অপরিবর্তিত প্রাকৃতিক নিয়তিতে রূপান্তরিত করেছে এবং এইভাবে তৈরি করেছে প্রকৃতির এমন এক পূজা যা মানুষকে পশু করে তোলে, যে মানুষ প্রকৃতির প্রভু তাকে বানর হনুমানের এবং গাভীশালার (বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীর) অর্চনায় নতজানু করে নিজ অধঃপতনের পরিচয় দিয়েছে।     

একথা সত্য যে হিন্দুস্থানে সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে গিয়ে ইংল্যান্ড শুধুমাত্র হীনতম স্বার্থবুদ্ধি থেকে প্ররোচিত হয়েছিল এবং সে স্বার্থ সাধনে তার আবরণ ছিল নির্বোধের মতো। কিন্তু সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল: এশিয়ার সামাজিক অবস্থায় মৌলিক একটা বিপ্লব ছাড়া মানবজাতি কি তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে? যদি না পারে তাহলে ইংল্যান্ডের যত অপরাধই থাক, সেই বিপ্লব সংঘঠনে সে…ই ইতিহাসের অসচেতন হাতিয়ার। সেক্ষত্রে, প্রাচীন এক জগতের ভেঙে পড়ার দৃশ্যটি আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতির পক্ষে যতই তিক্ত হোক না কেন, ইতিহাসের দিক থেকে, গ্যাটের সাথে আমাদের ঘোষণা করার অধিকার আছে:  

“এ পীড়ন যদি দেয় বৃহত্তর সুখ

তবে তার সন্নিধানে কেন এ যাতনা?

হয়নি কি অগণন আত্মার নির্বাণ

তৈমুরের সে দুঃশাসনে?”

                                                       [গ্যয়টের ‘জুলেখার উদ্দেশে’ প্রতীচী ও প্রাচীর কাব্য ৮৯]

ভারতবর্ষের ইতিহাসের বিশেষত্ব বিচার করতে গেলে বহু প্রশ্ন এসে পড়বে। তবে অন্যতম প্রশ্নটি হল জাতের বিষয়। এশিয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি নিয়ে নানান চিন্তক নতুনভাবে আলোচনা করেছেন। এটি কেবল শ্রেনি-দ্বন্দ থেকে উদ্ভুত নয়। কিন্তু এশিয় আমলাতান্ত্রিক অভিজাত শ্রেণি থেকে উদ্ভূত যেখানে এটি একটি আর্থ-ব্যবস্থার নিজেই একটি অংশ। মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ভিত্তির সংমিশ্রণ এশিয় রাষ্ট্রের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। অর্থনৈতিক পার্থক্যে ঘনত্বের ভিত্তি নির্ভরশীল নয়। সমাজের স্তরীকরণের উপর এর নীতি নির্ভর করে সমাজ কীভাবে তৈরি হবে। জনজাতির বিশুদ্ধতা এবং দূষণের অন্ধ বিশ্বাসের উপর এর স্তরীভবন নির্ভর করে। তৃতীয়ত যেটি অন্যতম বিতর্কিত ও ঝামেলার তা হল এশিয় পদ্ধতিতে জমির মালিকানাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতির প্রশ্ন। পশ্চিম ইউরোপীয় ভাবনায় যারা ব্যক্তিমালিকানা অনুপস্থিত দাবি করেন সেটি ভারতবর্ষের কর্তৃত্ববাদী ও সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে দেখেন।                

মার্ক্স ‘আ কনট্রাডিকশন টু দা ক্রিটিক অব পলিটিকাল ইকনমি, আ সর্ট আউটলাইন অব ওয়ার্ল্ড হিস্টরি’ বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছিলেন: বিস্তৃত পরিসরে এশিয়, প্রাচীন, সামন্ততান্ত্রিক এবং আধুনিক বুর্জোয়াদের উপকরণের পদ্ধতিকে সমাজের অর্থনৈতিক গঠনকে চিত্রায়িত করা যায় প্রগতিশীল যুগের শুরু হিসাবে। ওয়াই ভার্গ মার্ক্সের এই বক্তব্যকে স্মরণ করে বলেছেন – এটি দেখায় যে মার্ক্স এশিয় উৎপাদন পদ্ধতি কম গুরুত্ব দেননি পরবর্তী উৎপাদনের পদ্ধতির তুলনায়। তিনি আরও বলেছেন – তদসত্ত্বেও “এশিয় উৎপাদন পদ্ধতি” এই শব্দবন্ধ সাবেক সোভিয়েত মার্ক্স-সাহিত্য থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে।  মার্ক্স এশিয় ও প্রাচ্য (ওরিয়েন্টাল) শব্দবন্ধ দুটি  একটির পরিবর্তে অন্যটি ব্যবহার করেছেন। মার্ক্স  ‘এশিয় উৎপাদনের পদ্ধতিকে’ ভৌগলিক অর্থে বোঝাতে চাননি কারণ তাঁর ভাবনায় বিস্তৃত আফ্রিকার অংশও ছিল, যেখানে মূল ভুমি উঁচু, সেচের জলের অভাব আছে কিন্তু ক্যানাল কেটে কৃত্রিম পদ্ধতিতে সেচের ব্যবস্থা করা হয় এবং প্রাচ্যের কৃষি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। জলের এই বন্দোবস্তের জন্যেই সরকারের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তিনি (মার্ক্স) বলেছিলেন মিশর, ইয়েমেন, পার্সিয়া এবং হিন্দুস্থান যেগুলি এক সময় গজিয়ে উঠছিল, এখন এগুলির অবস্থা অত্যন্ত খারাপ কারণ এগুলি মরুভুমিতে পরিণত হয়েছে কারণ সরকার জনতার জন্য সেচ প্রকল্প সংগঠিত করতে ব্যর্থ। ১৮৫৩ সালে মার্ক্স এসব লিখেছেন। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশ উপনিবেশ সৃষ্টি হবার পর পুরাতন উৎপাদন পদ্ধতি ভেঙ্গে পড়ছে, ব্রিটিশ নতুন করে উৎপাদন পদ্ধতিতে হস্তক্ষেপ করছে। ফলে পুরাতন সমাজের সাম্য বিঘ্নিত হয়েছে, উপনিবেশবাদী অর্থনীতি কায়েম হচ্ছে। এসব সত্ত্বেও মার্ক্স ‘এশিয় উৎপাদন পদ্ধতি’কে প্রগতিশীল পদ্ধতি বলেছেন।

[লেখক – অবসরপ্রাপ্ত উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক ও মার্ক্স-পন্থী প্রাবন্ধিক]

Facebook Comments

Leave a Reply