ছিল…আছে…থাকবে… – জয়ন্ত ঘোষাল
সমাজচিন্তার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে মার্কসবাদ আত্মপ্রকাশ করেছিল মূলতঃ বঞ্চিত, শোষিত, সর্বহারা, নিপীড়িত শ্রেণিকে মুক্তির এক সম্ভাব্য অথচ আয়াসসাধ্য পথের সন্ধান দানের উদ্যেশ্যেই। উদারনীতিবাদ একসময় পাশ্চাত্য কে সম্পদ সৃষ্টির রাজপথে এনে দাঁড় করিয়েছিল। ঘটে গিয়েছিল শিল্পবিপ্লব। প্রাচুর্য আর সীমাহীন সম্পদে প্লাবিত হয়েছিল সমাজের এক শ্রেণির মানুষ। জন্ম নিয়েছিল পুঁজিবাদ। যার অসীম ক্ষমতা আজও অনুভূত হয়ে চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। তবে, এই প্রাচুর্যের চোখ ধাঁধানো রূপের একটা অন্ধকারময় দিকও ছিল। সেটা ছিল সেইসকল মানুষের সমন্বিত এক রূপ, যাকে উদারবাদ উপেক্ষিত করেই রেখে দিয়েছিল। অথচ, তাদের সঞ্চিত শ্রমশক্তির উপরেই দণ্ডায়মান ছিল পশ্চিমের পুঁজিবাদী শিল্পোন্নত সভ্যতা। পশ্চিমের সেই রাষ্ট্র বা রাজনীতি পারেনি নিজের স্বাতন্ত্র্য কে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রভাব মুক্ত রাখতে। ফলে, তৎকালীন রাষ্ট্র – রাজনৈতিক ব্যবস্থাও হয়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক ভিত্তির যান্ত্রিক প্রতিফলন। রাজনীতি, অর্থনীতির বশংবদ হয়ে পড়েছিল। রাজনীতিতে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ প্রবরগণ। রাজনীতি হারিয়ে গিয়েছিল, মতাদর্শ লাভ করেছিল সমধর্মিতা। এই বিশেষ সন্ধিক্ষনেই আবির্ভাব ঘটেছিল মার্কসবাদের। যা, নিপীড়িত মানুষকে দেখিয়েছিল মুক্তির স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নপুরনের ঐতিহাসিক দায়িত্ব অর্পণ করেছিল, তাদের হাতেই। তাত্ত্বিকতার দিক হতে বিচার করলে দেখা যায় যে, মার্কসবাদই সর্বপ্রথম প্রমান করেছিল রাজনীতির অসহায়তাকে। দাবি করেছিল যে রাজনীতির স্বাতন্ত্র্য আছে, রাজনীতি কখনই অর্থনীতির যান্ত্রিক প্রতিফলন নয়। বলা যায়, এই ভাবেই রাজনৈতিক চিন্তা ও অনুশীলনের জগতে উদারবাদ বনাম মার্কসবাদ এর এক চিরস্থায়ী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে গিয়েছিল। যে যুদ্ধের তীব্রতা আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল রাশিয়ায় ভ্লাদিমির লেনিনের এবং চিনে মাও জে দং এর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার উত্তরপর্বে। বলা যায়, উদারবাদের জন্মভূমি ইউরোপেই সমাজতন্ত্রবাদ এতটাই বিস্তারলাভ করেছিল যে উদারবাদ বাধ্য হয়েছিল গনতন্ত্র নামক আদর্শকে আশ্রয় করতে। যে কারণে, আশির দশক পর্যন্ত ইউরোপীয় তাত্ত্বিকবর্গ উদারবাদকে জনমানসে এবং চিন্তার জগতে বৈধতা দানের জন্য উদারবাদের পুনর্বিন্যাস সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন। পুঁজিবাদের কদর্য রূপটিকে আড়াল করতেই জন্ম দেওয়া হয়েছিল জনকল্যানবাদ, সমাজকল্যানবাদ, এর ন্যায় নূতন ধরনের একাধিক উদারবাদী চিন্তাধারার। তবে, এই সময়কালে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী আন্দোলন দ্বিধাগ্রস্ত, বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়লে এবং জন রলসের মত উদারববাদী তাত্ত্বিক এর নতুন চিন্তাধারার আবির্ভাবে , চিন্তার জগতে পুনরায় উদারবাদের জয়লাভ সুনিশ্চিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সমাজতন্ত্রবাদের বিস্তার যাত্রাকে প্রতিহত করে। সমগ্র বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন তথা চিন্তাধারা সঙ্কটাপন্ন হয়। সে সঙ্কট যে আজও আছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই, থাকতে পারেনা।
তবে, মানুষের চিন্তা রাজ্যে কোন কিছুই সার্বভৌম এবং চিরস্থায়ী নয়। সেখানে সর্বদাই গতিশীলতা বজায় থাকে। তাই, উদারবাদ পুনরায় প্রশ্নের মুখে পড়তে থাকে, ঠিক সেই সময় হতেই, যখন পুঁজিবাদ ও নয়া সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নের দৌলতে চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছে। এক্ষেত্রে, রাজনৈতিক চিন্তার জগতে আবির্ভূত হলেন বেশ কিছু নতুন তাত্ত্বিক, যারা কোন তত্ত্বকেই নির্বিবাদে মেনে নিলেন না, সব চিন্তাকেই তাঁরা সন্দেহের চোখে বিচার করতে থাকলেন, তৈরি করলেন রাজনীতি চিন্তার এক নতুন অভিধান; মিশেল ফুকো, দেরিদা, লিওতার, বদ্রিয়ার, দিফেরস এর মত সেই চিন্তাবিদরা জন্ম দিলেন এক নতুন বিনির্মাণ পদ্ধতির, যার নাম উত্তরাধুনিকতাবাদ। এই চিন্তা পদ্ধতি এযাবৎ প্রচলিত সকল মহাআখ্যানের প্রতি অবিশ্বাস জ্ঞাপণ করে থাকে। তাই সে উদারবাদ বা মার্কসবাদ কাউকেই মানতে চায়না। বলা যায়, ১৮ শতকের ইউরোপে আলোকপ্রাপ্তিকে আশ্রয় ক্রে পাশ্চাত্যে যে আধুনিকতার প্রতিস্থা ঘটেছে, তারই সমালোচনা করে উত্তর আধুনিকতাবাদ। পাশ্চাত্যের যে ভোগবাদী আধুনিকতার সমালোচনা মার্ক্সবাদে দেখা যায়, তারই আর এক রূপ হল এই বিশেষ চিন্তাধারা। সেই পশ্চিম এর আধুনিকতার অসঙ্গতি, অকল্যান, অন্ধকার, অযৌক্তিকতা, ও অসত্যকে উন্মোচিত করতে চায় এই চিন্তাধারা।
আধুনিক প্রচলিত সকল রাজনৈতিক তত্ত্ব এটাই ধারণা করে থাকে যে , একটি যুক্তিসঙ্গত রাজনীতি্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাই সেই রাজনীতির মধ্যে বাস্তববোধ, বৈজ্ঞানিকতা, স্বাভাবিকতা থাকবেই। উদারবাদ সেভাবেই বিশ্বাস রাখে ব্যক্তি নিরপেক্ষ, সর্বজনীন যুক্তির উপরে। যে যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে একটি সামগ্রিক উদারনৈতিক গনতন্ত্র। তেমনই মার্কসবাদ মনে করে যে শ্রেণি নিরপেক্ষ কোন যুক্তি থাকতেই পারেনা, এবং শ্রমিক শ্রেণির যুক্তিই হল বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য। সেই যুক্তির ভিত্তিতেই সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। বলাবাহুল্য, একজন উতর আধুনিকের চোখে এই ধরনের দাবীগুলি উদ্ধত মনোভাবের নির্দেশক। কারণ, নিজেকে সত্য বা বৈজ্ঞানিক বলে দাবী করার পশ্চাতে থাকে ক্ষমতার বাহুল্য। তাই, উত্তর আধুনিকতাবাদ মনে করে যে অভ্রান্ত জ্ঞান বলে কিছুই হয়না। তাই সে সব কিছুকেই ভেঙ্গে ফেলতে উৎসাহী। সে মনে করে যে রাজনীতি হল মূলত ক্ষমতার লড়াই, যে ক্ষমতা আসে জ্ঞান থেকে; বিস্তৃত জ্ঞান নতুন ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়, তাই শেষ লড়াইটা জেতে রাজনীতি। এখানেই, মার্কসবাদ এবং উতরাধুনিকতার সেতু বন্ধন ঘটে যায়। কারণ, রাজনীতি তখনই শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যখন তা মতাদর্শের দ্বারা বলীয়ান হয় …
[ক্রমশ]
ঋণস্বীকার: প্রদীপ বসু
[লেখক – অধ্যাপক, জর্জ স্কুল অফ ল, কোন্নগর, হুগলী]
Posted in: January 2019, Prose