কাশ: জীবন, স্মৃতি ও আশার খোঁজে: একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া – দেবাঞ্জন মিত্র

সব মানুষেরই জন্মভূমির প্রতি একটি সহজাত টান থাকে কারণ ভূমি থেকেই সে তার প্রাথমিক জাতিগত জন্মপরিচয় লাভ করে। একটি বিশেষ ভুমিক্ষেত্র ধরেই মানুষের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি-বিষয়ক ধারা বিকশিত হয়–এর থেকেই পরে সে একটি জাতি/সমষ্টিগত পরিচিতি ও ইতিহাসচেতনা লাভ করে। ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের জাতীয় ইতিহাস গর্বের সঙ্গে দাবি করে যে ভারতভূমির সনাতনী চরিত্র বহু বৈচিত্র্যময় ধর্ম-সংস্কৃতি-বর্ণসঙ্করতায় ভরা আমাদের দেশ ঐতিহ্যবাহী, স্বর্গাদপি গরীয়সী। যদিও স্বাধীনতা যুদ্ধের অতীত সাক্ষ্য বহন করে যে ভারতবর্ষের ভৌগলিক বিস্তৃতি ঔপনিবেশিক কালের চেয়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে বহু অংশেই হ্রাস হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৭-এর ভারতীয়-ব্রিটিশ চুক্তিবদ্ধ স্বাধীনতা তাই বাংলা ও পাঞ্জাব ভূখণ্ডের নব সীমারেখা গঠনের বহু রক্তাক্ত-কলঙ্কময় গরিমার সাক্ষী। এর পরতে পরতে জমে আছে বহু নৈঃশব্দ্য, কাঁটাতার, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ছিন্নমূল হওয়ার বেদনা ও গ্লানির নীরব ইতিহাস। এক কথায়, “freedom in an idiom of loss”। এ তো গেল সার্বিকভাবে স্বীকৃত জাতীয় ইতিহাস কথন। এর অপর প্রান্তে থেকে যায় জীবন্ত সাধারণ মানুষের সংগ্রামের অগ্রন্থিত ইতিহাস–যার সঙ্গে তার নিত্যনৈমিত্তিক ভয়, লজ্জা, ক্ষোভ, দুঃখের–আজন্ম নাড়ির সম্পর্ক। আমার মতে এই ইতিহাস জীবন্ত কারণ তা মানুষের স্মৃতিতে বাহিত হয় ও পরে তার গোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাস হিসেবে তার জাতিসত্ত্বায় রয়ে যায়। আবার এও সত্যি যে এই ইতিহাস সময়ের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতিদেরকে নতুনভাবে দিশা দেয়, নির্মাণ করে। এতে যা যা দ্বন্দ্ব বা দ্বেষের অবকাশ রয়ে যায় তাই পরে সামাজিক ক্ষয় ও ধ্বংসের সূচনা করে। এই ইতিহাস অবশ্যই অস্বীকৃত, অস্বস্তিকর, ও স্বভাবে নীরব। এমনই একটি প্রান্তিক ইতিহাসের দলিল স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের প্রথম অধিগ্রহণ নীতি, যার মাধ্যমে তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনী ঔপনিবেশিক কালে ভারতীয় রাজন্যবর্গ-শাসিত চারটি বিশেষ অংশকে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করে। এই চারটি রাজ্য: কাশ্মীর, জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও গোয়া অবশ্যই অধিগৃহিত হয় সমকালীন শাসকদের বলপ্রয়োগ ও চুক্তিবদ্ধ অঙ্গীকারের মাধ্যমে।
গণতান্ত্রিক, সাম্যবাদী, সার্বভৌমত্বের দাবিদার ভারত তাই এই সব রাজ্যবাসীর কাছে এক বৃহৎ ক্ষমতাসীন রাষ্ট্র, এক আপাত বহুত্ববাদী রাষ্ট্রযন্ত্র মাত্র হয়ে ওঠে যা হিংস্রতা ও শোষণের নামান্তর। এর মধ্যে বিশেষভাবে লাঞ্চিত হয় কাশ্মীরের জনগণতন্ত্র কারণ সেখানকার শাসক হরি সিং কাশ্মীরিদের মতামত না নিয়েই “Instrument of Accession” নামক একটি দলিলের মাধ্যমে কাশ্মীরকে স্বাধীন ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে নথিভুক্ত করেন। উত্তরস্বাধীন ভারতবর্ষে মহারাজ হরি সিংয়ের এই বিশেষ সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর এক অপূরণীয় ক্ষতের সৃষ্টি করে। এই সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ কাশ্মীরবাসী হিন্দু-মুসলমানদের সহাবস্থানে ফাটল দেখা দেয়। কাশ্মীর উপত্যকা হিংসাজীর্ণ এক সংগ্রাম মুখর ক্ষেত্র হয়ে ওঠে–তার সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়–এবং এই সাম্প্রদায়িক চিড় আজও এই উপত্যকাটিকে রক্তাক্ত করে রেখেছে।
তাই ২০১৮ সালে যখন বৈভাষিক প্রকাশনীর “কাশ: কাশ্মীরি পণ্ডিত ও কাশ্মীরি মুসলমানদের সাম্প্রতিকতম ছোটগল্পের অনুসৃজন” সংকলন গ্রন্থটি হাতে আসে তখন এর উপাধিটি আমায় ভারী অবাক করে, ভাবায়। সত্যি তো ভারতীয় হিসেবে কতটা “একাত্মতা” বোধ করি আমরা আমাদের কাশ্মীরি সঙ্গীদের জন্য? যাদের বাড়ির আত্মীয়রা ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বা কোনো অন্য সম্পর্ক সূত্রে কাশ্মীরের সঙ্গে আবদ্ধ নয়, তাদের বাইরে কতজন ভারতীয় কাশ্মীরি মানুষজনের কথা ভাবে, তাদের দুঃখে চোখের জল ফেলে? অথচ দেশের সীমাসূত্রে তারা আমাদের পরমাত্মীয়। ঐতিহাসিক ভাবেও বাঙালি ও কাশ্মীরি জাতি আত্মীয়। সম্পাদকদ্বয় অদ্বয় (চৌধুরী) ও অভিষেকবাবু (ঝা) তাই বলে ওঠেন: “(বাঙালি ও কাশ্মীরি উভয় গোষ্ঠীই) দেখেছে উচ্ছেদ ও বিতাড়ন, তারা দেখেছে উদবাস্তু জীবন, তারা দেখেছে শরণার্থী শিবির, তারা দেখেছে সত্তরের রাষ্ট্রীয় দমনব্যবস্থা, তারা দেখেছে মৃত্যু-মিছিল।” তারা আরো বলেন যে কাশ্মিরীদের কাছে তাদের মাতৃভূমি “কাশ্মীর হামারে থা” হিসেবেই আজ বেশি পরিচিত। যদিও অন্যান্য ভারতীয়দের কাছে কাশ্মীরের ভূখণ্ড এক জাতীয় আবেগ: “কাশ্মীর হামারে হ্যায়”–যা কার্গিল যুদ্ধে পাকিস্তান-বিজেতা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর রাজমুকুটে এক অমূল্য পালক। এটা আজ স্বীকৃত যে ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি ১৯৪৭ সালের আগেই ঘটিয়েছিল, কিন্তু কাশ্মীরি হিন্দু-মুসলিমদের জীবনচিত্র ও সম্পর্ক এই আপাত সরলীকরণে পড়ে না কারণ তা আরো অনেক রাজনৈতিক ও সামরিক চুক্তিতে জটিল। এই যুক্তির স্বপক্ষে এটাই বলবো যে এজন্যই হয়তো কাশ্মীরের সাহিত্য নিয়ে বিশেষ অনুবাদের কাজ বাজারে বহুলভাবে প্রচারিত হয় না, আঞ্চলিক ও জাতীয় খবরের কাগজগুলোতে কাশ্মীর ও সমস্যা পরিপূরক শব্দবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সর্বোপরিভাবে, পাহাড়কে ভালোবেসে ঘোরে বা একাত্মতা বোধ করে এমন ভ্রমণার্থী পর্যটকদের ছাড়া আর সবার কাছেই কাশ্মীর ভারতের এক সীমান্তবর্তী এলাকার উপাধি মাত্র। এহেন কাশ্মীরের সাহিত্য পড়াটা যে একজন বাঙালির কাছে অনুসৃজন হবে এটা জানা কথা। এই সূত্রে প্রচ্ছদে অর্ক চট্টোপাধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেন যে: “অনুবাদ এক রাজনৈতিক প্র্যাকটিস–এই বাক্যটি লেখা রয়েছে এই সংকলনের রক্তমাংসে। …কাশ্মীর এমন এক ভূ-রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, আঞ্চলিক ভাষায় যার অনুবাদ হওয়া আমাদের সময়ের জরুরি দাবি।” ঐতিহাসিক সুগত বসুও সখেদে নিজের ভূমিকায় আশা রাখেন যে, “কাশ্মীরি গল্পকারদের মর্মস্পর্শী” ছোটগল্পের এই সংকলনটি “সক্ষম হবে (কাশ্মিরীদের ও অন্যান্য ভারতীয়দের মধ্যে) উভমুখী ভাবের আদান-প্রদান” ঘটানোর এক সেতু তৈরি করতে, কারণ গত তিন দশক ধরে “ভারত রাষ্ট্র কাশ্মীর সমস্যাকে মানবকেন্দ্রিক আঙ্গিকে বিচারের পরিবর্তে বস্তুকেন্দ্রিক আঙ্গিকের নিরিখে বিচার করে এসেছে।”
এ তো গেল উপাধির রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, কিন্তু প্রশ্ন রয়েই যায় যে এই সাহিত্যগুলি কিভাবে, কেন, কতটা প্রাসঙ্গিক? মানব জীবনের মর্মস্পর্শী ধারাগুলি কি কাশ্মীরি সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়? পাঠক হিসেবে বলবো এই সংকলনে অনুসৃজিত কাশ্মীরি গল্পগুলো আমাকে আরো অন্য অনেক কারণে ভাবতে বাধ্য ও ঋদ্ধ করেছে। অরভিন্দ গিগুর “বৃষ্টি” তাই হয়ে ওঠে না-বলা-শোকের এক ধারাবিবরণি যা ভারতীয়দের কাশ্মীরের মানুষদের সম্পর্কে অজ্ঞতাকে অন্ধত্বের তকমা দেয়। উজমা ফলকের “একটি তিন শব্দের গপ্প” ও শাহনাজ বাশিরের “মৃত্যুর খবর” গল্পগুলো আমাদের নিষ্ঠুরভাবে বাধ্য করে রক্তিম কাশ্মীরের রক্তমাখা উপত্যকায় চোখ খোলা রেখে হাঁটতে। মৃত্যু ও জীবন-মৃত্যুর নিত্য লড়াই যে কতভাবে কাশ্মীরি জীবনের মূল সম্পর্কগুলিকে প্রতিনিয়ত ঘিরে রয়েছে এই সংকলনের গল্পগুলো তার প্রামাণ্য দলিল। “বিষ, অমৃত”-তে সিদ্ধার্থ গিগু দেখান যে শরণার্থী শিবিরের জীবন কিভাবে বাবা-ছেলের মতো এক অতি পরিচিত সম্পর্ককে অস্বস্তি ও অবিশ্বাসে ভরে তোলে; পীরজাদা মুজামিলের “আজহার” এর উল্টোদিকে দেখায় যে এক সুন্দরী মেয়ের বিপন্ন, বিষদগ্রস্ত বাবা কিভাবে বাধ্য হয় তার একমাত্র আদরের দুলালিকে খুন করতে। মানব সম্পর্কের এই ক্ষয়গুলি যেন সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে কাশ্মীরি মানুষের এক নিত্যনৈমিত্তিক বোঝাপড়া! “পরিযায়ী” ও “কারফিউ দিনের মৃত্যু” গল্পগুলিতেও এই কথাই অনুরণিত হয়: যেখানে মুহাম্মদ তাহির ও হুজাইফা পণ্ডিত দেখান যে “জঙ্গি” শব্দটি কিভাবে ভারতীয় রাষ্ট্র ও কাশ্মীরি মানুষদের ভেতর এক অতলনীয় দূরত্ব তৈরি করে; তবে “কারফিউ” গল্পে বিপন্ন মানুষের ছবি আরও স্পষ্ট ফুটে ওঠে কারণ সেখানে শিশুদের সঙ্গে হওয়া হিংসা গল্পটিকে এক অন্য মাত্রা দেয়। হরি কৃষেণ কাউলের “আঙুল” ও সুশান্ত ধরের “উশুল” গল্পদুটি হিন্দু-মুসলমান আন্তর্সম্পর্কের অলিতে-গলিতে থাকা অবিশ্বাসের চিড়গুলিকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে কারণ এই দুই কাহিনীতেই বন্ধুত্বের স্নেহের সম্পর্ক একে অপরের প্রতি অবিশ্বাসে, ঘৃণায় ও প্রতিশোধের প্রবল বাণে ধীরে ধীরে ক্ষণভঙ্গুর হয়ে ওঠে। ওমিয়ের ভাট “নজরদারি”-তে দেখান যে কাশ্মীরের ছাত্রসমাজ আজ কতটা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত, বিপন্ন ও ক্ষয়গ্রস্ত। আবার গওহর গিলানি-র “সন্ত্রাসবাদী তানভীর সংক্রান্ত দু’চারটে কথা” কাশ্মীরি ছাত্রসমাজের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৈরি হওয়া সন্দেহবাতিকের এক অদ্ভূত ধারাভাষ্য যা আমাদের এই নব প্রজন্মের উপর ঘনায়মান দুর্যোগ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করে। হিনা খানের “একজন জুতো-চোর আর তার বেকারি” গল্পটি ইয়ানা ও তার মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ ছেলের দুর্ভোগকে এক নতুন মানবিক মূল্যবোধের আখ্যান করে তোলে। বীণা পণ্ডিত কউলের “আমার আকাশ কোনখানে?” আর কে. এল. চৌধুরীর “ত্রিপুর সুন্দরীর রহস্যময় ইচ্ছেসকল” গল্পদুটি দু ভিন্ন মাত্রায় মানুষের চিরন্তনভাবে ঘর খোঁজার ও ঘর করার সামাজিক ইচ্ছে নিয়ে গঠিত। প্রথম আখ্যানটি ভূষণ ও বাসন্তীর সুষ্ঠভাবে নিজেদের পরিবারকে একটি সুস্থ জীবনে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দিয়ে ভরা: এটি তাই কাশ্মীরিদের সুষ্ঠভাবে বাঁচার তীব্র আকাঙ্খার একটি ভরসাযোগ্য দলিল হয়ে উঠেছে; অন্যদিকে হার্পিসে আক্রান্ত শাদিলাল কাশ্মীরি পণ্ডিত ও মুসলমানদের মধ্যে ঘটে থাকা সাংস্কৃতিক বিরোধকে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে কোনো এক নৈতিক সহাবস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে: তার এই মানসিকতাই তাকে হার্পিসের তীব্র বেদনার মধ্যেও যেন দেবী ত্রিপুর সুন্দরীর এক বিশ্বাসী একনিষ্ঠ সেবক করে তুলেছে। উভয় গল্পেই সামাজিক অসন্তোষ, অসুরক্ষা ও তৎসত্ত্বেও একজন সাধারণ কাশ্মীরির এই সামাজিক পরিমণ্ডলেও সম্প্রীতির জন্য চাহিদা–এই কাহিনীগুলির জন্য যেন একটি নতুন ভাষ্য তৈরি করেছে: এই একাত্মবোধই এ কাহিনীদ্বয়কে পাঠকের কাছে নতুনভাবে মানবিক ও প্রাসঙ্গিক করে তোলে। একই কথা খাতে আউতার মোটার “তারাবতী” গল্পের ক্ষেত্রে: সদ্যপ্রয়াত বৃদ্ধা তারাবতীর সম্পূর্ণ বটবৃক্ষসম জীবন নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়া, তারাবতীর বৃহত্তর পরিবারের কাছে, তারাবতীকে কাশ্মীর ভূখণ্ডের দ্যোতক ও প্রতিভূ করে তোলে: কোথাও যেন তাই, এই পরিবারটি কাশ্মীর মাতৃভূমির জন্য কাশ্মীরি জনগোষ্ঠীর মিলিত হাহাকারের এক যোগ্যতম প্রতিনিধি হয়ে ওঠে; অন্যদিকে আদর্শ অজিতের “ক্যানসার” গল্পের কাশ্মীরে অনাবাসী অসুস্থ কানোয়ালের কাশ্মীরে পুনর্বাসন করার ইচ্ছে ও ঘর বেঁধে তার জন্মভূমিতে স্বতন্ত্রভাবে বাঁচার ইচ্ছে, যেন তাকে কোথাও আজকের দিনের এক আশাবাদী অসহায় সংগ্রামী চরিত্র করে তোলে যার আদর্শবাদ তাকে এক আদর্শ কাশ্মিরী প্রতিনিধি করে তোলে। এই সবকটি কাহিনীই তাই পাঠকের কাছে সন্ত্রাসে ত্রস্ত কাশ্মীরের এক অন্য রূপকথার কথন হয়ে ওঠে। এই সবকটি কাহিনীই একসূত্রে বাঁধা পড়ে এক সুন্দর আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সূত্রে। বার বার কাশ্মীরে সংঘটিত মানবিক মূল্যবোধের বিপন্নতা আমাদের আমাদের কাশ্মীরি ভাইবোনেদের সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে জুড়ে দেয়: মর্মস্পর্শী সংবেদনশীলতা ও সমবেদনা কোথায় যেন গঙ্গা-পদ্মা-ইছামতীর সঙ্গে সিন্ধু উপত্যকার পঞ্চনদের হাহাকারদের একই ধারায় মিশিয়ে বঙ্গোপসাগরের জলরাশির ভেতর একত্রে বিসর্জিত করে স্নিগ্ধতায় মনটাকে বিষণ্ন ও ভারী করে তোলে… এ সংকলন তাই কোথাও কোথাও যেন অনবদ্যভাবে কাশ্মীর ভূখণ্ড ও তার অধিবাসীদের জীবন নিয়ে তৈয়ার করা এক তথ্যচিত্র হয়ে ওঠে।
শেষে পাঠক হিসেবে নিজের কিছু ব্যর্থতার দায় স্বীকার করতে আমি বাধ্য। পাঠক হিসেবে আমার সবচেয়ে আক্ষেপের জায়গা এটাই যে এই সংকলনে উল্লিখিত কোনো গল্পেরই পাঠ আমি তার মূল ভাষায় করি নি: এর প্রধান কারণ আমার কাশ্মীরি ভাষা নিয়ে অজ্ঞতা। তাই এ বইয়ের উপাধির “অনুসৃজন” কথাটি আমায় ভাবায়। যাইহোক, এই সংকলনটি পড়তে গিয়ে আমার পাঠক হিসেবে বার বার মনে হয়েছে যে সম্পাদকমন্ডলী এই কাশ্মীরি গল্পগুলি শুধু আক্ষরিকভাবে বাংলা ভাষায় তর্জমা করেন নি; উপরন্তু আপন আপন জাতিগত/সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার রস এই কাশ্মীরি কাহিনীগুলোতে মিশিয়ে সেগুলি বাঙালিদের জন্য আরো উপযোগী ও রমণীয় করে তুলেছেন। সেই অর্থে এ সংকলনটিকে cultural translation এর একটি উদাহরণস্বরূপ ধরা যেতে পারে। নিজের এই বক্তব্যের স্বপক্ষে দুটি যুক্তি দিচ্ছি। এক, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর একটি নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির আলাদা ভাণ্ডার বা ক্ষেত্র থাকে যার ভেতর কিছু অংশ কখনোই অন্য আরেকটি সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীর মত/অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না। অপরপ্রান্তে, এই কারণেই দুটি বা তারও বেশি জনগোষ্ঠী একইসাথে সহাবস্থান করলেও তাদের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণই রয়ে যায়; একই কথা ভাষা সম্পর্কেও খাটে। তাই বাংলা সংস্কৃতির/ভাষার সমানুপাতিক কিছু অনুভব/অভিজ্ঞতার যথাযোগ্য কথা/স্মৃতি/ঘটনাশৈলী কাশ্মীরি সংস্কৃতি/ভাষায়/স্মৃতিভাণ্ডারে অনুপস্থিত। কিন্তু এই বিভিন্নতা সত্ত্বেও এই সংকলনের প্রতিটি গল্প একটি সাবলীল পাঠ ও অনুভুতির জায়গা বাঙালি পাঠককে দেয়। পড়তে পড়তে বোধ হয়, এ কাহিনীগুলো যেন বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের মানসপট থেকেই উঠে এসেছে। ফলস্বরূপ, এই সংকলনটি একটি cultural transmission ঘটায় ও বাঙালি-কাশ্মীরি সাংস্কৃতিক সংলাপের একটি বিশেষ মানসিক জায়গা পাঠককে উপহার দেয়; তাই এ গ্রন্থটি একটি সফল “অনুসৃজন” হয়ে ওঠে কারণ অনুবাদকারীরা এই কাহিনীগুলিকে বাংলার মানুষের জীবনের সঙ্গে খুবই সুন্দরভাবে সাযুজ্যপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। আর একটি ছোট কথা। এই গল্পগুলি পড়ে মনে বারংবার প্রশ্ন জাগে, কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জীবনযাত্রা কি সত্যি আজ অমানবিকতার চারণভূমি, ভারতীয় রাষ্ট্রের রাজদণ্ডে পরাভূত এক উৎপীড়নকামী নারকীয় রাজ্য মাত্র, যার বসবাসকারীদের কাছে ভারত এক “অন্য” ক্ষমতার কেন্দ্র, এক “শক্তিশালী”শোষক ও উৎপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্র মাত্র? এছাড়াও, এই সংকলনটিকে কিছু কাশ্মীরি শব্দ/শব্দবন্ধের আলাদাভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে যা আমাদের কাশ্মীরি জনজীবন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ও সচেতন করে তোলে। এক ভিন্ন ভাষাবাদী সংস্কৃতির পাঠকের এই সচেতনতা পাওয়াটা একটা বিরাট পাওনা। সাধারণ ভারতীয়দের মানসে কাশ্মীর উপত্যকার ঐতিহ্য ও ভূস্বর্গসম সৌন্দর্যের খ্যাতি ভুবনবিদিত ও সর্বজনস্বীকৃত; তাই আশা আছে যে এই গল্পগুলো আমাদের সামনে আমাদেরই দেশের কাশ্মীরি অধিবাসীদের জীবনবোধ ও অনুভূতিগুলিকে বোঝার এক নতুন পথ হয়ে উঠবে।
[লেখক – সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, মৃণালিনী দত্ত মহাবিদ্যাপীঠ]
Posted in: Criticism, January 2019