অর্ঘ্যদীপ রায়-এর কবিতা
১
দীর্ঘ একটি বিবমিষা পেরিয়ে একটি বমনকে কিভাবে নিয়ন্ত্রিত করে তোলা যায় এ নিয়ে বিশদ পরীক্ষানিরীক্ষা চলছিল। গিনিপিগ ছিল স্মৃতি ও তার অকালবোধন। একটি গহীন প্রান্তরহীন বনাঞ্চলের ভেতর হাঁটছি বহুদিন। বহুদিন কোনো মানুষের মুখ দেখিনি। সহজ কিছু মহিষের পায়চারি, কিছু অজাতশত্রু পিঁপড়ের বাসা ইত্যাদি। অথচ রাত এলো নিবিড়। যে কাগজগুলি লুকিয়ে রাখা ছিল বহুদিনের ময়লা হয়ে যাওয়া আস্তিনে সেগুলো খোলার মতো সঙ্গোপন এসেছে। অর্থাৎ চাঁদ ছাড়া কোনো জ্যামিতিক মুখ নেই। কোনো প্রতিবেশী নেই যে আয়নায় দাড়ি কাটার প্রতিবিম্বে ভাগ বসাবে। এভাবে এলো সে। যেভাবে একটি সহজাত উদ্বর্তনের ভেতর যেতে যেতে বলিরেখা জন্মায় কপালে, অপরিবর্তনীয় থাকে তিল অথবা একটি অসহযোগ আন্দোলনের শরিক হয় প্রাচীন কুন্তল। অথচ কিছুতেই সেই পুরোনো কবিতার পুনর্নবীকরণ করা যায়না। ভাবতে বসি, একটি অমানিশার উপর মেলে দেওয়া তোমার নিষ্পাপ পোশাকের ঘ্রাণ। ভাবতে বসি কোনো নিছক হেডফোনের পাশে ফেলে রাখা রাতঘুমের চশমারা। অথবা একটি সাদা খাতার পেছনে বেলোয়ারী হয়ে আসা কোনো নামের পুনরাবৃত্তি। চায়ের ভাঁড় জমিয়েছিল যে দশকগুলি তারা ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে আসে। মনে পড়ে রিচার্জ দিদিমনির কথা। যার রুলটানা খাতায় প্রত্যেকটি কথোপকথনের শুরুওয়াদ লেখা থাকতো। কয়টি কুঁড়ি জন্মালো আর কয়টা আঙুলক্লান্ত হয়ে এলো সেসব কথা। অথবা যে ভারাক্রান্ত হসপিটালের বাইরে অধীর প্রতীক্ষা ছিল কখন উৎরে যাবে নড়বড়ে সময়টুকু। চোখ খুলে উঠে বসবে সে। তার নীলচে আলোর বাক্যগুলি ছুঁয়ে যাবে আমার শ্মশ্রুগুম্ফ বিকেলগুলি। আমার মোজাইক নখগুলিতে সঞ্চার হবে নিখুঁত গতিবেগ। একটি ট্যাক্সি আসে ঘটনাচক্রে। যাকে দেখে মনে হয় সে অনেক ঘটনার সাক্ষী। যাকে দেখে মনে হয় তার শার্সিগুলি এতই সাবালক হয়ে উঠেছে যে কোনো অন্তর্দৃষ্টিই অর্জন করতে বাকি নেই তাদের। এভাবে একটি ঘটনাবহুল দিন ধীরে ধীরে মিশে যায় কোনো মানবীর কাঁধে। তাদের অবশিষ্টাংশগুলি দেখে ছুটে আসে অনেক বেলুন-বালক। ভালোবাসার মেদুরতায় বেলুন বড় সহজপাচ্য হয়ে ওঠে। যে বাতাস রুদ্ধ থাকে, তার বাসি হওয়া আবহাওয়ায় একটি নদীর জন্ম হয়। যার ওপারে শহর রাখা ছিল অনেকদিনের, যার ওপারে পুরোনো বইয়েরা সস্তা হয়ে ওঠে, যার ওপারে জ্যোতিষী বসে ক্ষীয়মান কোনো ঘাটে। ক্ষৌরকর্ম করতে আসা কোনো কিশোরের ভাসিয়ে দেওয়া ফুল বেলপাতা বয়ে যায় দোদুল্যমান তরণীর ধার ঘেঁষে।
২
আরব সাগরের জানু বেয়ে শীত এসে যায় বালুতটে। কেউ মুরুড কেউ কিহিম কেউ তারকারলি বুড়ি ছুঁয়ে বসে থাকে। কেউ অসমাপ্ত গানের খাতা ফেলে আসে গুহাগর ঝাউবনে। একটি ওয়াইফাই একসেস পয়েন্টের পাদদেশে জিজীবিষা খুঁজে পায়। তার শীতলপাটি তরঙ্গে হিল্লোল বয়ে যায় নিশীথ মিলিওয়াটে। একটি জান্তব দিনের শেষে দেখতে পাওয়া যায় অতীতের বালি লেগে আছে কর্ণকুহরে। এ শীত নিস্পৃহ অথবা জাগতিক আপেক্ষিক আর্দ্রতায় তার কিছু যায় আসেনা। একটি কুকুর যেভাবে ঘর খুঁজে নেয় মানবিক স্নেহের উচ্ছিষ্টগুলিতে, যেভাবে তিমির আসছেনা তাই মানুষ তমিস্রার শরণাপন্ন হয়। সমার্থক একটি পৃথিবীর সুখ খুঁজে নেয় শব্দবাদী মানুষ। শুয়ে থাকতে থাকতে একটি নিষ্পাপ আলো জেগে থাকে ধ্রুব কোনো পারাপারে। জাগরুক ঋণাত্মক চেতনাগুলি পাশবালিশ খুঁজে পেলো। একটি বৃত্তের তলপেটে জ্যা খুঁজে নিলো ক্ষীয়মান আঙুলগুলি। যে তটে চন্দ্রাহত পুরুষ পেলব রাত ছুঁতে চায়, যে চন্দ্রবিন্দুর পাশে বসতে বসতে মর্তুকাম হয়ে ওঠে বিসর্গ। এমন চেতনার আলো তাদের বহ্নিকে প্রজ্জলিত রাখে। যেখানে কবিতা থাকেনা সেখানে কিংবদন্তী প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সময়ের ছুঁচগুলি চ্যাপ্টা পাতায় অতীত অণুবীক্ষণ এঁকে যায়। একটি অজ্ঞাতকুলশীল বিষাদ ভেসে আসে বহুদূর দেশ থেকে। মনে হয় একটি গতজন্মের মনখারাপ নিয়ে জন্ম নিয়েছে একটি জাতিস্মর। যার না আছে দুষ্টু লোক,না আছে ময়ূর। তবু সেতারের দিনগুলি পোহাতে পোহাতে মনে হয় অপ্রতুল এই স্বাদকোরকের জাড্য। আবহমান একটি পাঁচালি শুনতে শুনতে মানুষ ক্যালেন্ডারে অনিপুণ গোল দাগ রেখে যায় লুব্ধক তারিখগুলিতে।
Posted in: January 2019, Poetry