জাহাঙ্গীরকে লেখা কবিতা : একটি মিনি সমালোচনা – অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

জাহাঙ্গীরকে লেখা কবিতা। অস্তনির্জন দত্তর নতুন বই। অসামান্য কলমের অধিকারী এই কবি এই বইতে অনায়াসে এমন এক সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন যা এক কথায় অনবদ্য। অনবদ্য তার ভাষায়, অনবদ্য তার বুননে, অনবদ্য নান্দনিকতায় আর অনবদ্য কাব্যের নিত্যনতুন রূপ উন্মোচনে। যেন রাগসঙ্গীত তার সুরটুকু ঝালিয়ে নিচ্ছে বাংলা ভাষার আবহে। যেন এক পথভুলো এসে পড়েছে অলৌকিক ফুলেল বাগানে।
এই যে বজর বজর করে ফুলে গেল বোরজ
হওয়া ফুলল তলতলে গোলানোয়
সেই মেহেদি তুমি মেখে নিচ্ছ
এই গ্রীষ্ম প্রধান দেশে কিছুটা কাঁচা হলুদ, নিমমাখানি
(২৬ নম্বর কবিতা)
এই কয়েকটি ছত্র থেকেই বোঝা যাচ্ছে কবির হৃদয় সতত সঞ্চরণশীল। সেই হ্রদয়ে যেখানে ধাক্কা হয় জলবায়ুর। ফুল ও হাওয়ার, গ্রীষ্মপ্রধান নানা সামগ্রীর সেখানে সমাহার। অস্তনির্জন জীবনের নানা বিষয়কে নিজের কবিতায় ব্যবহার করেছেন এক নতুন আঙ্গিকে, বলা ভাল আবিষ্কার করেছেন নতুন আঙ্গিকে। সমস্ত সচেতন কার্যকলাপকে অবচেতন দিয়ে গুন বা ভাগ করে তাঁর হাতে যে গুন বা ভাগফল এসেছে তা যাচাই করে ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। এই কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে মনে হয় কবি কখনই শব্দ ও ভাষার ব্যাবহার অসচেতন ভাবে করেননি। বরং খুব বুঝে, অপার মমতায়, নিজের দেখাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। পাঠক মুগ্ধ হয়ে যান। মুগ্ধ হতে হতে নিজেই বুঝতে পারেন যে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তিনি আগে কখনো হননি। ২৬ নম্বর কবিতা থেকে যাওয়া যাক প্রথম কবিতা…
কিছু পাতা জুড়ে ঘুম, পাতা জুড়ে জুড়ে
সান্ধ্য আহ্নিক এর পর
আমি বলেছি নইনন তোমার বয়স হচ্ছে…
কবি এখানে যে আবহ তৈরি করেছেন তা কিছু অনুপম রাস্তায় এগিয়ে যায়…পরবর্তীতে একটি হাসিতে পৌছয়। সেই হাসিতে যাওয়ার জন্য যে পথ তাঁকে অতিক্রম করতে হয়, এক কথায় অনবদ্য। জীবনের লাল নীলগুলো জোড়া দিতে দিতে কবি হ্যাটতে থাকেন। হয়তো একটা হাসিতে পৌছনোই তাঁর উদ্দেশ্য বা তা পেরিয়ে নতুন কোনো উন্মোচনের দিকে। কিন্তু সবসময়ই কবি তাঁর এই হাঁটাটিকে বিশেষ করে তুলেছেন নিজের দেখা দিয়ে। হাঁটার উদ্দেশ্য কখনোই তাকে ছোট করেনি। বা দূরে সরিয়ে রাখেনি। ৯ নম্বর কবিতায় যেমন দেখা যায়…
এইসব সন্ধ্যেয় আমায় কিছু দীর্ঘ চুল জড়িয়ে রাখে,
ইবাদত জড়িয়ে রাখে, জাহাঙ্গীর
গোসলসারা, ইতস্তত, কারো বুকে
ফুটে থাকা ইস্ত্রির শুকনো দাগ, মেহেদি পাতার মত, যেন খুঁটে, খুঁটে, খুঁটে
নেওয়া যাবে, জড়িয়ে রাখে জাহাঙ্গীর- আমি বসি
কবির এই উচ্চারণ, যে ‘আমি বসি’ এই বসে যাওয়া কখনোই হতাশার নয়, বরং আরো একটু দেখতে চাওয়ার জন্য আরো একটু পর্যবেক্ষণ। আরো খানিক হাঁটার জন্য প্রয়োজনীয় শ্বাস। কবি যেন প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি অনুভবে নিজেকে দেখছেন। নিজেকে উপভোগ করছেন। ওই একই একই কবিতায় উনি লিখছেন
নৌকো চলে যাবে,
যার নিচে জল থাকে, গোসল থাকে, কেউ ভিজে থাকে আল্লা রসুল
কবির এই যে খোঁজা নিজেকে অতিক্রম করে না গিয়ে প্রতিটি সম্ভাব্য অসম্ভাব্যের দরজায় কড়া নেড়ে দেখা সেখানে জীবনের অণু পরমাণুর সমীকরণ। সেটাই এই আটচল্লিশ পাতার কবিতার বইটির অন্যতম অন্তরাত্মা হিসেবে স্থাপিত।
সবশেষে যেটা বলা যায় যে সমস্ত কবিতার মধ্যে যে আধ্যাত্মবাদের চোরা স্রোত রয়েছে। এই বইয়ের নাম ‘জাহাঙ্গীরকে লেখা কবিতা’। অর্থাৎ কিনা এতে এক ধরনের সমর্পণ আছে যা লেখাগুলিকে আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে। ফলে নানা কবিতায় যেমন জাহাঙ্গীরের নামের উল্লেখ আছে তেমনই আছে নানা উর্দু ও পার্শি শব্দের সমাহার। যাতে লেখগুলি আরও সজীব ও আরও নিমগ্ন হতে পেরেছে।
বইয়ের ছাপা ও বাঁধাই চমৎকার। তবে কবিতাগুলির অক্ষরের মাপ একটু বড় হলে ভাল হত। পাঠকের পড়তে সুবিধে হত। তবে এই স্বল্প পরিসরে সামগ্রিকভাবে এই কথা বলা যায় যে, এই বই তার সমস্ত গুণাগুণ নিয়ে অনেক অনেক দিন পাঠক হৃদয়ে বিরাজ করবে।
বই : জাহাঙ্গীরকে লেখা কবিতা
কবি : অস্তনির্জন দত্ত
প্রকাশনী : চেতনা
বিনিময় : ৭০ টাকা
Posted in: Criticism, January 2019