ইভান ইলিচের মৃত্যু – অমিতাভ মৈত্র

ধরা যাক তলস্তয়ের গল্পের ইভান ইলিচ (“The Death of Ivan Ilych”, 1886) ছিলেন একজন কবি আর গল্পের বর্ণনা মতো মন থেকে পড়ে গিয়ে ছবির ফ্রেমে ধাক্কা লাগা আর যৎসামান্য আঘাত পাওয়া আসলে ছিল তার কবিতার পৃথিবীতে প্রথম পা রাখার মতো। ইলিচের যৎসামান্য শারীরিক যন্ত্রণা, পেশার জীবনে সাফল্য আর আত্মিক কিছু কষ্টকে আমরা এবার মিলিয়ে নেই একজন কবির তাত্ত্বিক পরিচয়ের প্রাথমিক অনিশ্চিত অবস্থানের জায়গার সাথে। এরপর গল্পের শেষে মৃত্যুর মুহূর্তে ইভান ইলিচের চোখে ভেসে ওঠে আলো (এই আলো হয়তো একজন কবির তাত্ত্বিক পরিচয়পত্র)। একটু দেখা যাক গল্পের সেই জায়গাটা।

“And death…where is it?”

He shought his former accustomed fear of death and did not find it. “Where is it? What death?” There was no fear because there was no death. In place of death there was light.

-“So that’s what it is!”

মরে যাওয়ার আগে সে মনে মনে খুঁজছিল তার যন্ত্রণাকে। মৃত্যুকে সে বুঝতে চাইছিল মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে। আর সে পেয়েও গিয়েছিল তার উত্তর। একজন কবি তাঁর তাত্ত্বিক পরিচিতি পেয়ে, কানে পাঞ্চ করে লাগিয়ে দেওয়া “শনাক্ত চিহ্ন” লাভ করে এরকম আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। যেন এই অ্যাড্রেস ট্যাগ ছাড়া তিনি মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন। তার আত্মচিহ্ন সন্ধানের মরিয়া চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। আনন্দোজ্জ্বল চোখে তিনি দেখবেন তাঁর নামের পাশে “আধুনিক”, “উত্তরাধুনিক”, “পুনরাধুনিক” বা “পোস্টমডার্ন” শব্দটি তিনি অর্জন করেছেন।

একটি লেখা—সে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, যাই হোক না কেন, যদি কোন নির্দিষ্ট তকমা মেনে লেখা হয়, তাকে “রাত্রির মাটি” হতে হয় শেষপর্যন্ত। পোস্টমর্ডানিজম তত্ত্বের  দিকে আমি যাচ্ছি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, সার্বিক ধ্বংস অশুভের আবহে কিভাবে এক বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার উদ্ভব সে নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। স্টিভেন ল্যাপ আর ওয়াল্টার বেন মাইকেলস ১৯৮২ সালে তাদের “Against Theory” লেখায় তত্ত্বকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এই ভাবে—“the attempt to govern interpretations of particular texts by appealing to an account of interpretation in general”। আর তাঁরা মনে করেন এটা একটা অসম্পূর্ণ এবং অসম্ভব একটা অবস্থান “to stand outside practice in order to govern practice from without as it entail to consequence for the actual practice of interpretation.”।  এই জায়গা থেকেই তাঁরা মনে করেন—“all the theory should therefore come to an end”। পোস্টমর্ডানিজম অবসান চায় সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যার, পাঠকে উন্মুক্ত করে দিতে চায়। কিন্তু তত্ত্বের এই পূর্ণাবয়ব মৃত্যুর মধ্যে, কপালের লিখন, আমরা এক থিউরি আবিষ্কার করেছি। যা ছিল পুরোপুরি পাঠ সংক্রান্ত—“interpretation of particular texts”—তাকেই আমরা লেখার মধ্যে নিয়ে এলাম। আমরা হয়ে উঠলাম পোস্টমডার্ন কবি! পোস্টমডার্ন কবিতা কিন্তু লেখা যায় না। পোস্টমডার্ন আদর্শে বিশ্বাস করে কবিতা পড়া যায়। লেখার ব্যাখ্যার নির্দিষ্ট ধরন না মেনে মডার্নিস্টদের “high art”, যা শুধু নির্বাচিতদের উপভোগের জন্য, সরে গেল আস্তে আস্তে আর সিনেমা, সংগীত, মজার বিজ্ঞাপন, কার্টুন সব মিলেমিশে নতুন এক গণসংস্কৃতি, অন্য এক গণরুচির রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল পোস্ট মর্ডানিজম। বর্হেস, বেকেট, মার্কেজ, রোলাঁ বার্থ-এর মত লেখকরা তাদের নিজস্ব ভিন্নমুখী লেখা নিয়ে এলেন—ট্র্যাডিশনের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে। ফুকো দেরিদা এলেন তাদের বৈপ্লবিক ধারণাগুলি নিয়ে, মৃত্যু হল লেখকের অথরশিপের। বই আর কোন “সাহিত্য কর্ম” নয়, বই হয়ে উঠল “টেক্সট”—“চিহ্নকারী সমগ্র” যেখানে কারো কোন আলাদা পরিচয় নেই, সব বইই সেখানে আত্মপরিচয় খোয়ানো এক সর্বব্যাপী টেক্সট (e`criture)।

 মুশকিল একটাই হলো। বার্থের “লেখকের মৃত্যু” প্রতিষ্ঠিত হলো, কিন্তু স্টিভেন ন্যাপদের “Against Theory” হয়ে উঠল নতুন এক থিওরি। পোস্টমডার্ন কবিরা এলেন পোষ্টমডার্ন কবিতা লিখতে। সমস্ত লেখাই যদি হয়ে ওঠে পরিচয়হীন এক সর্বগ্রাসী টেক্সট, তাহলে কবি সেখানে নিজের নামে কবিতা লিখেন কী করে! তাঁর তো মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে পোস্টমর্ডানিজম! কবিতা যদি আমার সত্ত্বার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়, যদি সে আমার আত্মা হয়ে থাকে, এবং যদি সেই কবিতা আত্মহীন তখন কিভাবে আমি রক্তমাংসের জীবনে ব্যবহারিক সামাজিক পরিচয়ে থাকছি। খুব সরল একটা লজিক্যাল প্রপোজিশন হতে পারে এরকম:-

(এক)   “কবি” আমার পরিচয় যার পরিচয়।

(দুই)   যার পরিচয় আছে সে “কবি” নয়।

(তিন)   সুতরাং “আমি” নেই।

আমাদের প্রভু দরকার সর্বক্ষণের জন্য। আমাদের সব কিছুর জন্য তত্ত্বের সমর্থন খুব দরকার। তত্ত্ব না থাকলে আমরা ভয়ে কেঁপে উঠি। মেসেজে তর্ক হচ্ছিল একদিন কবি দেবযানী বসু’র সাথে মোটামুটি এই বিষয় নিয়ে। উনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন তত্ত্ব সম্পূর্ণ জেনে, ধর্মীয় নিষ্ঠায় তার যাবতীয় বিধান মেনেই তিনি কবিতা লেখেন এবং লিখে যাবেন। তত্ত্বের একজন ঘনিষ্ঠ সেবক হয়ে ওঠাই কবি / শিল্পীর কাজ। এই স্বেচ্ছালব্ধ অন্ধত্ব আমাদের অনেকেরই একরকম আশ্রয়।  

(২)

মৃত্যুর মুহূর্তে ইভান ইলিচ বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যুকে। “So, that’s what it is!” একজন কবিও হয়তো এভাবেই জানেন তাঁর পরিচয়, তাঁর অ্যাড্রেস ট্যাগ। ইভান ইলিচের মতোই যেন তার তত্ত্বহীন জীবনের অবসান হয় এবার। তিনি জেনে যান তিনি পোস্টমডার্ন  কবি। তিনি শ্বাস টানেন, মাঝপথে থেমে যান, টানটান করেন শরীর, মারা যান।

Facebook Comments

Leave a Reply