‘ব্রেদলেস’ সিনেমার একটি পাঁচ সেকেন্ডের ফ্রিজ শট যা দেখায় – অদ্বয় চৌধুরী
‘কোনো সাহিত্য প্রকৃতই উত্তরাধুনিক হয়ে ওঠে তখনই, যখন সেই সাহিত্যের ‘ফর্ম্যাল ল্যাংগুয়েজ’ বা পোষাকী ভাষা, স্বতস্ফূর্তভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে তারই নিজের ‘ফর্ম্যালিটি অফ ল্যাংগুয়েজ’ বা ভাষার পোষাকীপনার বিরুদ্ধে।’
বাংলা গদ্যের অ্যাখ্যানশৈলী, সেই উত্তর-স্বাধীনতা কাল থেকে, এক দীর্ঘমেয়াদী মায়াজালে আবদ্ধ ছিল, এবং সেই মায়াজাল ছিল উত্তর ঔপনিবেশিকতাবাদের জাদুদণ্ডের কারসাজি। ওই ঐন্দ্রজালিক ছাঁচ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার প্রবণতা দেখা দেয় হয়তো বেশ কিছুকাল আগে থেকেই, বেশ কয়েকজন লেখকের আখ্যান কাঠামোয়, কিন্তু সেই গঠনতন্ত্র থেকে সার্থক নিষ্ক্রমণ ঘটে যে কয়েকজন লেখকের কথনশৈলীতে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য ও সুবিমল মিশ্র, যাঁদের মধ্যে শেষোক্ত ব্যক্তি একদা এক সাক্ষাৎকারে উচ্চারণ করেছিলেন উপরের ওই অমোঘ বাণী। সন্দীপন, সুবিমলরা প্রচলিত গদ্যভাষা ও কথনশৈলীকে ভেঙ্গেচুরে নিজস্ব ডিকশন ও আখ্যানশৈলী নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা গদ্যের ভাষার পোষাকীপনার বিরুদ্ধে এঁরা জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন, এবং সেই জেহাদের হাতিয়ার ছিল, সুবিমলের কথা অনুসারে, নিজেদের গদ্যের পোষাকী ভাষাই। গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের একচ্ছত্র অথরিটি নাকচ করে সেই অথরিটি নিয়ে এক রকমের খিল্লি প্রবণতা ধরা পড়ে এই তিনজনের লেখা, ভাষা বা সমগ্র উপস্থাপনাতেই, এবং সেই নাকচ প্রবণতাই হয়ে ওঠে তাঁদের আখ্যানের পোষাকী ভাষা, যা তাঁদের লেখনীকে মুড়ে রাখে আশিরনখর।
শুরু করা যাক শিরোনাম থেকে। কোনো গ্রন্থের একটি মাত্র নির্দিষ্ট শিরোনাম প্রদান হল এক প্রকার ‘এসেন্সিয়ালাইজেশন’। এই ‘এসেন্সিয়ালাইজেশন’-এর বিরুদ্ধে গিয়ে ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’-এ পরপর ৯টি নাম সাজিয়ে দেন সুবিমল মিশ্র, তাঁর পাঠকদের উদ্দেশ্যে—

যে কোনো শিরোনামের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে পাঠ শুরুর আগে পাঠকদের দিশা দেখান, গ্রন্থ বা লেখার বিষয় সম্বন্ধে নূন্যতম ধারণা প্রদান করা। কিন্তু সুবিমলের এই কারসাজি কার্যত পাঠকদের দিকভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্ভবত সুবিমল এই বিভ্রান্তিটা চাইতেন খুব সচেতনভাবেই— যেমনটা চাইতেন সন্দীপনও। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কিছু শিরোনাম অত্যন্ত ডিসেপ্টিভ, এবং মূল টেক্সটের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘কলেরার দিনগুলিতে প্রেম’, ‘আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’, ‘হিরোসিমা মাই লাভ’। এই অপ্রাসঙ্গিক প্যারডি আসলে শিরোনাম ও কাহিনির চিরাচরিত সম্পর্কের প্রতি, সেই সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত ‘এসেন্সিয়াল লয়ালটির’ প্রতি এক চরম বিদ্রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সন্দীপনের লেখায় অবশ্য ‘এসেন্সিয়ালাইজেশন’ নিয়ে উলটো এক খেলা দেখা যায়, তাঁর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এর ব্যবহারে। তাঁর ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’-এর অদ্ভুত সহাবস্থান এক অদ্ভুত ঢঙে এই উত্তরাধুনিকতাবাদী আনডিসাইডেবিলিটিকে নাকচ করতে করতে এগোতে থাকে—
‘যাই-হোক, দেখতে দেখতে ৩ ও ৪ তাকের ছোটবড় সব খুপড়িগুলোয় একসঙ্গে ধরে গেল আগুন, এখন গোটা সেল্ফ জ্বলছে . . . ধোঁয়ার মধ্যে রুমালে নাক চেপে জ্বালাভরা চোখে এখন আর বিশেষ-কিছু দেখতে পাচ্ছে না রাজমোহন, রাজমোহনের শরীর বেঁকে যেতে থাকে, সে আরো ঝুঁকে পড়ে। মিল্ক অ্যাজ এ মিরাক্ল ড্রাগ নামে বইটা ছিল, একটা পাখির বই ছিল, কাকাতুয়া-পায়রা ছিল অনেক, গোরা ছিল। গোরা? হ্যাঁ, গোরা। নষ্টনীড় ছিল। ভূপতি ফিরে এসে হাত চেপে ধরে বলল, ‘আচ্ছা চলো।’ চারুলতা বলিল, ‘না থাক।’
“গোরা ছিল। গোরা? হ্যাঁ, গোরা। . . . চারুলতা বলিল, ‘না থাক।’’— এই দুটো বাক্যকে ভালোভাবে দেখলেই বোঝা যায় এখানে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ একে-অপরকে লাগাতার নাকচ করতে করতে এগিয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হল, এখানে আনডিসাইডেবিলিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও পাশাপাশি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে প্রচলিত বাক্য-বিন্যাসও, এক অভূতপূর্ব জেহাদী ভঙ্গিতে। সন্দীপনের বহু লেখাই শুরু হয়েছে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ দিয়ে, এবং এক্ষেত্রে পাঠকদের মনে পড়তে বাধ্য জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’-এর অষ্টাদশ তথা শেষ পরিচ্ছেদ ‘পেনেলোপে’-এর শুরুয়াত।
শুরুয়াতের বদলে গল্পের এন্ডপয়েন্ট কীভাবে ‘এসেন্সিয়ালাইজেশন’-এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘অন্ধ বেড়াল’ গল্পটি—
“জলের ধাক্কায় আর উন্মত্ত বাতাসের দাপটে হোটেলটা যখন কেঁপে কেঁপে উঠবে, নদীর দিকের খুঁটিগুলো যখন একটা একটা করে টলে যেতে থাকবে তখন হোটেল মালিক বাসনকোসন আর চেয়ার টেবিলগুলো সামনের গলির ওপারে যে রকের মতো জায়গাটা আছে সেখানে নিয়ে গিয়ে ডাঁই করে রাখতে পারে। এপাশ-ওপাশ দুলতে থাকা লন্ঠনটাও সে নিতে ভুলবে না। কিন্তু জল বেড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেও তা শুরু হবে টাল খাওয়া দিকটার থেকে। অন্ধ বেড়াল তখন বড়োজোর অপেক্ষাকৃত উঁচু দিকটায় সরে যেতে পারে। কিন্তু ও ঘর ছেড়ে বেরোবে না। এখানেও দুটো সম্ভাবনা রইল। ঘরটাতে আস্তে আস্তে জল বাড়তে পারে অথবা এক ঝটকায় দোতলাসমেত হোটেলটার গোটা কাঠামোটাই নদীতে ধ্বসে পড়তে পারে। এর যে কোন একটা হলে অন্ধ বেড়ালের কিছু করার নেই। হয় জল তাকে ছাপিয়ে উঠবে নয়তো ঘরের সঙ্গেই সে নদীতে তলিয়ে যাবে। কিন্তু ঝড় যদি কোন কারণে রাস্তা পালটায় বা অত ভয়াবহ না হয় তাহলে হোটেলটা যেমন আছে তেমনই থাকবে। এবং টেবিলের তলায়, অন্ধকারে বসে থাকবে অন্ধ বেড়াল। সকালে এসে বাচ্চাদুটোও দেখতে পাবে যে চেনা জায়গাতেই সে চুপ করে বসে রয়েছে।”
‘অন্ধ বেড়াল’ গল্পটি এখানেই শেষ হয়। শেষ হয় কথকের কাজ— লেখকের কাজও। কিন্তু লেখকের হাত ছেড়ে পাঠকের স্বাধীন বিচরণ শুরু হয় এখান থেকেই যেখানে ‘আনডিসাইডেবিলিটির’ কারণে ‘মাল্টিপল’ এন্ডিং-এর সম্ভাবনাময় প্রান্তর উন্মুক্ত হয়। এখানেই সেমিওটিক বিশ্লেষণে ‘ওপেন টেক্সট’ হয়ে ওঠে গল্পটি। এবং, এখান থেকেই ‘এসেন্সিয়ালাইজেশন’-এর বিরুদ্ধাচরণ শুরু হয়। গল্পটির এই এন্ডপয়েন্ট থেকেই আরও একটা, বা আরও একাধিক গল্প শুরু করা যায় কিন্তু। একটি গল্প শেষ হওয়ার পর সেই গল্পের এন্ডপয়েন্ট থেকেই আরও এক বা একাধিক গল্প লেখক নিজেই লিখেছেন অবশ্য। যেমন, “‘অটো’ উপন্যাসটির এক একটি উত্তরপাঠ হিসেবেই পড়ে ফেলা যাবে ‘মিউচুয়াল ম্যান’ বা ‘কড়াই’ গল্পগুলিকে। ‘গুপ্তঘাতক’, ‘নেকলেস’, ‘৯৮৬৪৪’ বা ‘সাংহাইতে এক সন্ধ্যা’ গল্প চারটিকে একভাবে একটিই বড়ো গল্পের চারটি পর্ব” বলাই যায়। একটি গল্প থেকে আরও একটি বা একাধিক গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে সন্দীপন সম্ভবত সবার থেকে অনেকটা, অনেকটা এগিয়ে। এও এক প্রথাগত পাঠাভ্যাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। সুবিমলের লেখাতেও এই ঘটনা ঘটেছে, তবে বিভিন্ন গল্পে নয়, বরং একই গল্পে একটিমাত্র বক্তব্য একাধিকবার পেশ করে প্রচলিত পাঠাভ্যাসকে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় তাঁর লেখায়।
এক ভিন্ন দার্শনিক আঙ্গিকে, আবার, এই কো-রিলেশন অফ টেক্সটস ‘ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির’ সঙ্কেতবাহী হয়ে ওঠে, যেখানে “any text is constructed in relation to another; thus signification is not based solely on the end product, but also on the exemplary discourse of otherness” [Prud’homme and Légaré]।
“ফরাসি গর্দভদের মিখাইল বাখতিনের সাহিত্যতত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে, সেই ১৯৬৬ সালে জুলিয়া ক্রিসতেভা যে intertextuality (sexuality নয়)-র বাত বোলিয়াছিলেন রসরাজের নাটকীয় আবির্ভাব কি তাই? মবলগে নভেল কি ‘constructed from a mosaic of quotations’ এবং ‘any text is the absorption and transformation of another’ বলতে যা বোঝানো হয়েছে তাই কি মবলগে নভেলে ঘটে গেল?” [“মবলগে নভেল”]
স্বয়ং লেখক নবারুণের এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই সদর্থক। কখনও সরাসরি, আবার কখনও ‘স্ট্রীম অফ কনশাসনেস টেকনিকের’ হাত ধরে নবারুণের কথনের ফাঁকে ফাঁকে অনায়াসে ঢুকে পড়ে কোনো নিখাদ ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা অথবা অন্য কোনো টেক্সট, এবং কাহিনীকে করে তোলে ‘হিস্টোরিওগ্রাফিক মেটাফিকশন’। সেখানেও কিন্তু ‘নন-লিনিয়ার’ ন্যারেটিভ টেকনিকের মাধ্যমে বাস্তব ও কল্পনার, অতীত ও বর্তমানের বিভাজনরেখায় ট্রাপিজের খেলা জারী রাখার প্রবণতা দেখা যায় লেখকের মধ্যে। তাই এই “মবলগে নভেল”-এ যখন জায়ান্ট বনবেড়াল রিভলভার তাক করে ছানাকালী ও পোনাকালীর দিকে তখন সরাসরি পাঠককে সম্বোধন করেই বলা হয়, “কমরেড পাঠক, কয়েক মোমেন্টের জন্যে হলেও আমরা মিখাইল বুলগাকভের মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিতা-র ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছি”। তাই “হারবার্ট” উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায় শুরু হয় মূলত উনিশ শতকের বাংলা কবিতার পঙক্তি দিয়ে যার মাধ্যমে নবারুণ “ইতিহাসের ফাঁকগুলোকে সাজানোর” চেষ্টা করেছেন। তাই ‘দীর্ঘ তরঙ্গ’ গল্পের শারীরিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকে পড়ে আর্নেস্ট ম্যান্ডেলের সত্য কাহিনী এবং তাঁর লেখা বই “Long Waves of Capitalist Development. Ernest Mandel. 1980. Cambridge”-এর রেফারেন্স যে বই বাস্তবে ভীষণ ভাবেই বিদ্যমান। এভাবেই “ঐ পরীর দিকে তাকিয়ে হারবার্ট কানে মৃতা পশ্চিমী নারীদের গান শুনতে পেয়েছিল। সেই গান দল বেঁধে বিলাপ করতে করতে এসে ধোঁয়াধুলো মাখা দোকানের কাচে ধাক্কা মারে। হায় নগ্ন পরী! জার্মান মেশিনগানের সামনে সেই রুশী যুবতী যেন— নগ্ন, দুহাত দিয়ে বুক ঢেকে দৌড়চ্ছে কালো মাটির ওপর। শুনতে সে কোন কথাই চাইছে না।” এখানে সাহিত্য ও সিনেমা এই দুই ভিন্নধর্মী মাধ্যমের প্রতিচ্ছেদন ঘটে অনাবিল ভঙ্গিমায়— ‘দ্য ফল অফ বার্লিন’ সিনেমার দৃশ্য অনায়াসে ঢুকে পড়ে গল্পকথনের স্বাভাবিক ছন্দের মধ্যে।
দুটি ভিন্নধর্মী টেক্সটের অনায়াস মিশ্রণের উদাহরণ হয়ে ওঠে সুবিমল মিশ্রের ‘রঙ যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন’ গ্রন্থটি, যেখানে সামঞ্জস্যহীন ন্যারেটিভের মাঝে মাঝে ঢূকে পড়ে খবরের কাগজের ‘নিউজ’। সুবিমল এই বইটির ভূমিকায় ঘোষণা করেন—
‘এই লেখায় প্রায় জায়গায়ই খবরের কাগজকে জ্যান্ত চিবিয়ে খাওয়া হয়েছে। দেশী বিদেশী প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষ বহু ঋণ। গৌতম বুদ্ধর সমান্তরালে রামরাম বসু, রূপচাঁদ পক্ষীর সঙ্গে আন্দ্রে ব্রেঁতো-রা সব মিলে-অমিলে একাকার। সমসাময়িক ইংরেজি বাংলা বহু লেখাকে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁকিয়ে দুমড়িয়ে নির্দয়ভাবে, নির্মমভাবেও, গা থেকে ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া, যেন, এই প্রবণতা।’
‘গা থেকে ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া’-র এই প্রবণতাই, আসলে, ‘ভাষার পোষাকীপনাকে’ বাঁকিয়ে দুমড়িয়ে জ্যান্ত চিবিয়ে খাওয়ার প্রবণতা! ফলস্বরূপ, ফিকশন এবং নন-ফিকশনাল ফ্যাক্ট স্টেটমেন্টের অদ্ভুত মিশেলে গোটা টেক্সটা হয়ে ওঠে এক অপরূপ খিল্লি!
পোষাকী ভাষা দিয়ে ভাষার পোষাকীপনার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার এই কূটাভাস অন্য আঙ্গিকে ধরা পড়ে নবারুণ ভট্টাচার্যের খিল্লি-প্রবণতা ও কথনশৈলীতেও: তিনি উত্তরাধুনিকতাবাদকে উপহাস করেন উত্তরাধুনিকতাবাদী উপস্থাপন-কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমেই। নবারুণীয় ‘সাবভার্সিভ’ খিল্লি-প্রবণতার অমোঘ অস্ত্র হিসেবে উঠে আসে উত্তরাধুনিক কৌশল ‘প্যারডি ও প্যাস্টিশ’ যা নবারুণীয়-কথনরীতির মধ্যে অনেকটা ‘প্যালিম্পসেস্ট’-এর ধাঁচে এক ডিসকার্সিভ পরিসর তৈরি করে। তাই কিছুটা ডাইগ্রেশন হিসেবেই ফ্যাতাড়ু-উপন্যাসের মধ্যে ‘মেটাফিকশন’ হিসেবে বজরা ঘোষের ‘খানকি সিরিজ’ চলতে থাকে। এই ‘খানকি সিরিজের’ কাহিনী উপস্থাপিত হয় বাংলা বটতলা সাহিত্যের এক অবশ্যম্ভাবী ‘প্যাস্টিশ’ রূপে। একইভাবে উপস্থাপিত হয় তার শিশুদের জন্যে রচিত ‘রাজা মেঢ্রবর্ধন ও মহাবাল রাক্ষসের গল্প’। এই বজরা ঘোষেরই ‘খানদানি খানকি’ নিয়ে ‘মবলগে নভেল’-এ যখন দুর্বোধ্যতার অভিযোগ তোলে কোনো এক ‘সাংবাদিক-কাম-ক্রিটিক’ তখন বজরা ঘোষের বয়ানে কোনোরকম তাৎক্ষণিক উল্লেখ ছাড়াই জবাব হিসেবে উঠে আসে জাক দেরিদার বক্তব্য:
“No one get angry at a mathematician or a physicist when he or she doesn’t understand, or at someone who speaks a foreign language, but rather at someone who tampers with your own language.”
এই ‘প্যাস্টিশ’-এর মাধ্যমেও উত্তরাধুনিকতাবাদী দুর্বোধ্যতার প্রতি এক চরম খিল্লি প্রকাশ পায়। এই খিল্লি প্রকটতর হয় যখন ‘fucktion’-লেখক বজরা ঘোষকে উত্তরাধুনিকতাবাদী সমালোচকের প্যারডি-চরিত্র পিশাচদমন পাল বা পেদো পাল ফ্যাতাড়ু-বাহিনীর চাপে পড়ে উচ্চকিত অথচ দুর্বোধ্য দার্শনিক স্তুতিতে ভরিয়ে দেয়, যেখানে হাইডেগার আসে, গুয়াত্তারি আসে, এবং খিস্তি করা হয় চোমস্কিকে, সঙ্গে সোকাল-ব্রিকমন্ট-ডকিংকেও। এখানে অ্যালান সোকালের প্রতি খিস্তি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ বাস্তবে সোকালের কুখ্যাত প্রবন্ধ ‘ট্রান্সগ্রেসিং দ্য বাউন্ডারিজ: টুওয়ার্ডস আ ট্রান্সফর্মেটিভ হার্মিনিউটিকস অফ ক্যোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি’ ঠিক যে যে দোষে দুষ্ট ছিল, পেদো পালের নিজস্ব প্রবন্ধও ঠিক একই দোষে দুষ্ট। দোষারোপ থেকে যায়, দোষও থেকে যায়, সোকাল ফিরে আসে পেদো পালের হাত ধরে।
ফিরে যাওয়া যাক এই লেখার শুরুতেই সুবিমলের ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’ বই থেকে দেওয়া পাতার ছবিটায়। ওখানে লেখা রয়েছে—
“বইটির জন্য কোনো নির্দিষ্ট নামই পর্যাপ্ত নয়
তবু…
সুবিধার্থে পছন্দমত একটা কিছু বেছে নিন”
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে “পছন্দমত একটা” এবং “কিছু বেছে নিন” এই শব্দবন্ধগুলির মাঝে বেশ কিছুটা ফাঁকা স্পেস ছেড়ে রাখা হয়েছে। ওই ফাঁকা স্পেস দিয়েই যেন পাঠকের প্রবেশ ঘটে, ওই স্পেসেই যেন অনেক না-বলা কথা রয়ে গেছে, যা কিনা পাঠকরা পূরণ করবে। ওই ফাঁকা স্পেস দিয়েই ঢুকে পড়ে রিডার রেসপন্স থিয়োরি। “যা লেখা হয় তার বাইরে না বলা কথাগুলো অপেক্ষা করে”— “মবলগে নভেল”-এর এই পর্যবেক্ষণে সূচিত হয় গল্পে লিখিত লাইনের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে লুকিয়ে থাকা অনুচ্চারিত কথার প্রতি ইঙ্গিত। নবারুণের ‘মহাযানের আয়না’ গল্পের নিম্নলিখিত লাইনগুলি ভিন্ন পাঠে এই থিওরিকেই মান্যতা প্রদান করে:
“বরং মনে হয়, না লেখা চুপই শ্রেয়; হওয়া না-হওয়া নিয়ে বাদানুবাদের বাইরে, যেখানে বিস্তার ও গতি কারও ওপরে নির্ভর করে না, কারও কাছে প্রমাণ করাতে আগ্রহ আর নেই। যে যে আছে অনুরূপ তাদের নাম দেওয়া হয়নি, তারা যা করে তাও গোচর নয়।”
‘না লেখা চুপ’-এর দার্শনিক ঝোঁক আভাসিত হয়ে ওঠে ‘ভাষাবন্ধন’ পত্রিকার নবারুণ রচিত শেষ সম্পাদকীয়তে:
“অনিবার্য কারণবশতই এবারেও ‘মবলগে নভেল’-এর পরবর্তী কিস্তি বার করা গেল না।
ধারাবাহিকতার মধ্যে একটা নিয়মের গতানুগতিকতা রয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ এভাবে কোনো কিছু থেমে গেলে একটা মজা তৈরি হয় বটে! যদি উপন্যাসের মধ্যে এরকম কতগুলো সাদা পৃষ্ঠাকে মাঝে মাঝে উপন্যাসেরই অ-ধারাবাহিক অংশ হিসেবে রাখা যেত— সেটাও একটা স্পেস বোঝায়।
আমার মতে অত্যন্ত জরুরি এক-একটা স্পেস।”
এই ‘জরুরি স্পেস’-এর ভাবনাকে বাস্তবে প্রয়োগ করে বইয়ের একেবারে শেষে বেশ কয়েকটি সাদা পৃষ্ঠা ছেড়ে রাখা হয় নবারুণের মৃত্যুর পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তাঁর অসমাপ্ত শেষ উপন্যাস “মবলগে নভেল”-এ। ঐ গ্রন্থেরই ভূমিকায় উঠে আসে নবারুণের ব্যক্তিগত এক ভাবনার কথা যা যে কোনো লেখকের স্বেচ্ছা-মৃত্যুকেই ইঙ্গিত করে: “একটা এরকম বইয়ের কথা যে বইটার প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সাদা…”।
লেখকের মৃত্যু হয়, কিন্তু রয়ে যায় তাঁদের স্পর্ধা, রয়ে যায় তাঁদের প্রবণতা। বহু অমিলের
মধ্যেও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল মিশ্র ও নবারুণ ভট্টাচার্যের লিখনশৈলীর ছেদবিন্দু হল তাঁদের ছাঁচভাঙ্গার প্রবণতা, সেই ছাঁচকে নাকচ করে তাকে নিয়ে মশকরা করার প্রবল স্পর্ধা। বর্তমানে সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের পোষাকী ভাষা তার ভাষার পোষাকীপনার বিরুদ্ধে কতটা স্বতস্ফূর্তভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে তা নিরূপন করা দুরূহ, বিশেষ করে ‘স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া’-র মাত্রা নিরূপন, তবে সন্দীপন-সুবিমল-নবারুণের অক্ষরেখা ছিল প্রচলিত কক্ষপথের বাইরে, এক উত্তরাধুনিক দৃষ্টান্তস্বরূপ, এবং তাঁদের বিচরণ ছিল এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়াই, যার ভরকেন্দ্রে ছিল সমস্ত আবহমান রীতি-নীতিকে নাকচ করার প্রতিস্পর্ধা। ‘প্রিন্সিপল অফ নেগেশন’।
***
ঋণ
এই প্রবন্ধটির শতকরা সত্তর ভাগ তথ্য ও তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে মূলত দুটি প্রবন্ধের উপরে, এবং দুটি প্রবন্ধই অদ্বয় চৌধুরী ও অর্ক চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত গ্রন্থ ‘নবারুণ ভট্টাচার্য: মনন ও দর্শন’ গ্রন্থে সংকলিত। প্রবন্ধ দুটি হল—
১) ‘সন্দীপন–সুবিমল–নবারুণ: বিরুদ্ধতার ধারাবাহিকতা’, শুভদীপ দেবনাথ।
(**সুবিমল মিশ্রের ‘ওয়ান পাইস ফাদার-মাদার’ বইয়ের যে পাতাটির ছবি এখানে দেওয়া হয়েছে, সেটিও সংগৃহীত হয়েছে এই প্রবন্ধটি থেকেই)
২) ‘নবারুণের কথনশৈলী: এক রাজনৈতিক রণনীতি’, অদ্বয় চৌধুরী।
বাকি ত্রিশ শতাংশ তথ্যের উৎস প্রবন্ধের ভিতরেই উল্লেখিত রয়েছে, কিন্তু বাকি তত্ত্বের উৎস অনুল্লেখিত থাকাই বাঞ্ছনীয়।
Posted in: January 2019, Prose